কোথাও আশ্রয় নেই নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের, এই অসহায়দের কে করবে সাহায্য?
পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী তারা। রাষ্ট্র তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না এবং সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ চরমপন্থীরা তাদের অবহেলার দৃষ্টিতে দেখে।
নিপীড়ন থেকে বাঁচতে হাজার-হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। জাতিসংঘের ধারণা গত একমাসে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
হত্যা, (—), অগ্নিসংযোগ এবং নির্যাতনের ভয়ঙ্কর চিত্র বর্ণনা করছেন এসব রোহিঙ্গা মুসলমানরা। যদিও মায়ানমারের সরকার এসব অস্বীকার করছে।
কিন্তু রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া যথেষ্ট নয় বলে মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন। বার্মার রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপর যে ধরনের দমন-পীড়ন চলছে সেটিকে ১৯৯০’র দশকে বলকান যুদ্ধের সময় সেব্রেনিৎসা গণহত্যার সাথে তুলনা করছে অনেকে।
সে যুদ্ধের সময় বসনিয়ার মুসলমানদের উপর নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছিল সার্বিয়ার বাহিনী। ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে আট হাজারের বেশি বসনীয় মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল। ইউরোপের মানবাধিকারের ইতিহাসে সেব্রেনিৎসা গণহত্যা একটি কালো অধ্যায় রচনা করেছে।
মায়ানমারে গত ২৫ বছরের মধ্যে অনুষ্ঠিত কোন সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি’র দল ক্ষমতায় আসে। কিন্তু তাতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভাগ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি। রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে অং সান সু চির নিন্দা না করায় অনেকে তার সমালোচনা করছেন। মায়ানমারের প্রতিবেশিরা কি একটু সাহায্য করবেন?
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো সাধারণত তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে একে অন্যের সমালোচনা করেন না। এটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ১০ সদস্যের এসোসিয়েশনের (আসিয়ান) একটি মূল নীতি।
কিন্তু বর্তমান অবস্থায় মায়ানমারের মুসলিম অধ্যুষিত প্রতিবেশিরা প্রতিবাদ সমাবেশসহ দেশটির কঠোর সমালোচনা করছে। প্রতিবেশি দেশগুলোতে মায়ানমার দূতাবাস লক্ষ্য করে বিক্ষোভ ও হামলার ঘটনা ঘটছে।
ইন্দোনেশিয়ান পুলিশ বলছে, তারা মায়ানমার দূতাবাস লক্ষ্য করে আইএস-লিঙ্ক বোমা হামলার একটি চক্রান্ত বানচাল করেছে।
রবিবার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক অং সান সু চির নোবেল পুরস্কার দেয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। তিনি বলেন, এ পুরস্কার তাকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে।
মায়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি’কে উদ্দেশ্য করে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক বলেন, ‘রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের
নির্বিচার গণহত্যায় বিশ্ববিবেক নীরব দর্শক হয়ে থাকবে না।’
সু চির নোবেল পাওয়াকে ব্যঙ্গ করে নাজিব রাজাক বলেন, ‘অং সান সু চির নোবেলের কাজ কী? আমরা তাকে বলতে চাই, যথেষ্ট হয়েছে…আমরা অবশ্যই মুসলমান ও ইসলামকে রক্ষা করব।’
রাখাইনে অগ্রহণযোগ্য সহিংসতার জন্য মালয়েশিয়ার ক্রীড়া মন্ত্রী খাইরি জামালউদ্দিন আসিয়ানে মায়ানমারের সদস্যপদ স্থাগিতের আহ্বান জানান।
অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে পালিয়ে যাওয়া শত শত রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ সীমান্তে আটক করা হয়েছে এবং জোর করে তাদের অনেককে এক অনিশ্চিত ভাগ্যের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। সংস্থাটি অবিলম্বে এ ধরনের নির্যাতন বন্ধের জন্য মায়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেয় না এবং অনথিভুক্ত হাজার হাজার রোহিঙ্গারা সেখানে বাস করছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
শীর্ষস্থানীয় আঞ্চলিক সংবাদপত্র ‘থাইল্যান্ডের নেশন’ আসিয়ানের নিষ্ক্রিয়তার নিন্দা জানিয়েছে। তারা এটিকে একটি ‘হত্যা ও মারপিটের’ আনুষঙ্গিক হিসেবে বর্ণনা করেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কর্মকর্তা ফিল রবার্টসন বলেন, বিষয়টি নিয়ে একটি জরুরি আঞ্চলিক মিটিং আহ্বান করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। উত্তর রাখাইন যা ঘটছে সে ব্যাপারে মায়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসিয়ানে ব্যাখ্যা করার আহ্বান জানান তিনি।
রবার্টসন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের সত্যিকার অর্থে সাহায্য করতে আমরা সংলাপ এবং সহিংসতা বন্ধে যথাযথ প্রদক্ষেপ দাবি করছি।’
লন্ডনে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত রিজাল সুকমা বলেন, বিষয়টি সমাধানে একটি ব্যাপক প্রদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, আঞ্চলিক সদস্যদের অংশগ্রহণে একটি তদন্ত হওয়া উচিত এবং তার দেশ এ ব্যাপারে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত আছে।’
কি করছে জাতিসংঘ?
২০০৯ সালে জাতিসংঘের মুখপাত্র রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বন্ধুহীন মানুষ।’
গত বুধবার জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস হাইকমিশনারের’ অফিস থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চালানো নির্যাতন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শামিল।
গত জুন মাসের একটি রিপোর্টের তথ্য পুনর্ব্যক্ত করে এতে বলা হয়, ‘সরকার মূলত জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে…। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের ধরন স্পষ্টতই মানবতাবিরোধী অপরাধ।’
এছাড়াও, মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খোলা রাখার আহ্বান জানায় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
রাখাইন প্রদেশে সহিংসতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। তিনি অবিলম্বে সেখানে রক্তপাত বন্ধের জন্য দেশটির প্রতি আহ্বান জানান।
অং সান সুচি কোথায়?
কয়েকদিন আগে সিঙ্গাপুর সফরকালে সেখানকার ‘নিউজ এশিয়া চ্যানেলকে’ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘কোন সমস্যা নেই সে কথা আমি বলছি না।’
তিনি বলেন, সমস্যা বাস্তবে যতটা বড় নয়, অতিরঞ্জিত করে দেখালে পরিস্থিতি খারাপ মনে হয়।
অং সান সু চির গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বহু বছর ধরে সমর্থন করেছেন তুন খিন। তিনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সমর্থক হিসেবে পরিচিত। তুন খিন বলেন, রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে না পারা গভীর হতাশার বিষয়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর উপর সু চির কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন? সেনাবাহিনী এখনো সে দেশের ক্ষমতার একটি বড় অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে।
খিন বলেন, ‘বিষয় হচ্ছে অং সান সু চি মায়ানমার সেনাবাহিনীর অপরাধকে ঢাকার চেষ্টা করছেন।’
কিন্তু অন্য অনেকে বলছেন, রাখাইন রাজ্যের জটিল পরিস্থিতি বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মায়ানমার বিষয়ক গবেষক খিন মার মার খি বলছেন, রাখাইনরা হচ্ছে মায়ানমারের সবচেয়ে প্রান্তিক সংখ্যালঘু। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তাদের উপেক্ষা করছে। তিনি মনে করেন, মানবাধিকারের বিষয়টিকে ‘একতরফাভাবে’ তুলে ধরা হচ্ছে।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোনান লি মনে করেন এটি কোন যুক্তি হতে পারে না। সমাজের কোন একটি অংশ খারাপ অবস্থায় আছে বলে আরেকটি অংশের মানবাধিকার ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করা হবে সেটি কোন সমাধান হতে পারে না, বলছিলেন গবেষক রোনান লি।
অং সান সু চি সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, রাখাইন বৌদ্ধরা মনে করছে তারা সংখ্যার দিক থেকে কমে যাচ্ছে। সেজন্য তারা বেশ উদ্বিগ্ন। তাই বৌদ্ধ এবং মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দেয়া হচ্ছে বলে সু চি উল্লেখ করেন।
কিন্তু বাংলাদেশে যেসব রোহিঙ্গা মুসলমান দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে তাদের আশা ছিল অং সান সু চির দল ক্ষমতায় আসলে তারা মায়ানমারে ফিরে যেতে পারবে।
কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। রোহিঙ্গারা বলছেন পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। সেজন্য বাংলাদেশকে রোহিঙ্গারা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে। সুত্র: বিবিসি
মন্তব্য চালু নেই