কুষ্টিয়ায় অলৌকিক মাজার!

হাজারো মানুষের ভিড়। কারো হাতে মোরগ, কারো হাতে ছাগল, কারো হাতে বাড়ির গাভির দুধ, কারো হাতে মিষ্টি। কেউ এসেছে রোগ সারাতে, কেউ মানত, আবার কেউ এসেছে ছোট বাচ্চার মুখে ভাত দিতে। এমন নানা মানতে নানা সমস্যায় চলছে মানুষের আসা-যাওয়া। এই চিত্র কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের সুলতানুল আউলিয়া হযরত করম আলী শাহ্ (রহ.) এর মাজার শরিফ প্রাঙ্গণের।

গ্রামের মানুষের দাবি, মাজারটি অলৌকিক। এখানে এলে অনেক কঠিন রোগ ভালো হয়ে যায়, সংসারে সুখ আসে। এরা বলে মাজারটি এক রাতে তৈরি হয়েছে। কিন্তু কবে হয়েছে, কীভাবে হয়েছে, এ সন্ধান কেউ জানে না। এদিকে মাজারটি এমনভাবে তৈরি যে সেটা বোঝার উপায় নেই। মাজারের ওপরে বিশাল এক বটগাছ। গাছের ভেতরেই মাজার।

গ্রামের এক কোণে কবরস্থান, পাশেই জামে মসজিদ, দাখিল মাদ্রাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয়, এতিমখানা ও সুলতানুল আউলিয়া হযরত করম আলী শাহ (রহ.)-এর মাজার। মাজারকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এগুলো। বসেছে বাজার।

প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে ভিড় করে হাজারো ভক্ত আশেকান ও নানা সমস্যায় পীড়িতরা। এদের আগমনের কারণে জায়গাটি এক ব্যস্ত এলাকায় পরিণত হয়েছে।

মাজারে শিশু নিয়ে আসা পুরাতন আজমপুর গ্রামের আসমা খাতুন বলেন, ‘এটা আমার মেয়ের বাচ্চা। এর নাম জান্নাত। আমার মেয়ের দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বাচ্চা হতো না। সবাই আমার মেয়েকে বন্ধ্যা বলত। এতে আমার মেয়ের সংসার প্রায় ভেঙেই গিয়েছিল। তারপর এক প্রতিবেশী বলেছিল যে, সুলতানুল আউলিয়া হযরত করম আলী শাহ্ (রহ.) এর মাজার মানত করতে। আমি এখানে মানত করি। তারপর আমার মেয়ে মা হয়। এ জন্য আমি আমার নাতনির মুখে ভাত দেওয়ার জন্য এখানে নিয়ে এসেছি।’

মাজারে আসা এলাকার ময়না খাতুন জানান, তার গাভির দুধ একদম কম হতো। বাছুরই দুধ পেত না। তারপর তিনি মানত করেন, যদি গাভির ভালো দুধ হয়, এখানে প্রতি বৃহস্পতিবার দুধ দিয়ে যাবেন। এখন তার গাভি দিনে তিন-চার কেজি দুধ দেয়। তাই তিনি দুধ নিয়ে এসেছেন।

মাজারে আসা রিকাত আলী জানান, তার ছেলের সুন্নতে খতনা দেওয়ার জন্য এখানে এসেছেন। এখানে ‘শিরনি’ দিয়ে ছেলের সুন্নতে খতনা করাবেন।

অনেকের মতো কুলসুম, হাজিরন ও বানু বেগম এসেছেন এই মাজারে। তারাও এসেছেন মানত পূরণ করতে। একেক জনের একেক রকম ইচ্ছা। কেউ রান্না করে নিয়ে এসেছেন, আবার কেউ নিয়ে এসেছেন হাতে বানানো পিঠা।

শুধু যে এলাকার মানুষেরা এখানে আসেন না, আশপাশের এলাকাসহ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্তরা আসে এখানে। এ ছাড়া জেলার বাইরে মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ আসে এখানে।

মাজারে চুয়াডাঙ্গা থেকে আসা হাসিনা খাতুন জানান, তার ছেলে জয়ের খুব অসুখ হয়েছিল। ডাক্তারের কাছে গিয়ে অনেক টাকা খরচ করেছি কিন্তু লাভ হয়নি। সে প্রায় মরেই যাওয়ার মতো হয়ে গিয়েছিল। তারপর তাকে এই মাজারে নিয়ে আসেন এবং একটি মোরগ মানত করেন। কিছুদিন পরে ছেলে সুস্থ হওয়ায় মোরগ দিতে এসেছেন।

মাজারে মিষ্টি বিলি করছিলেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এক মাস হলো তার ছেলে বিদেশ গিয়েছে। সে সেখানে যাতে ভালো থাকে সুস্থ থাকে এ জন্য আমি মাজারে সকলের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করছি।’

মাজারের খাদেম আমোদ মোল্লা জানান, সুলতানুল আউলিয়া হযরত করম আলী শাহ্ (রহ.) ছিলেন একজন ওলি। তিনি ইসলাম প্রচার করেতে এখানে এসেছিলেন। পাশের এই (ন্যাংটা) নদীতে ভাসতে ভাসতে এখানে এসেছিলেন বলে শুনেছেন।

তিনি জানান, হযরত করম আলী শাহ্ (রহ.) কবে জন্মগ্রহণ করেছিল এবং কবে মৃত্যু বরণ করেছিলেন, তা কেউ জানে না। তবে এখানে তার কবর দেওয়া হয়েছিল। কোন একদিন রাতে হঠাৎ করেই অলৌকিকভাবে এখানে মাজার তৈরি হয়েছিল। তিনি প্রায় ১৩-১৪ বছর ধরে এই মাজারের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

তিনি জানান, এখানে যারা তবারক নিয়ে আসে তার মধ্যে কিছু অংশ মাজারের তবারকে জমা করা হয়। বাকিগুলো তাদের ফেরত দেওয়া হয়। পরে মাজারের তবারকগুলো জোহরের নামাজের পর সবার মাঝে বিতরণ করা হয়।

মাজারের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘আমাদের গ্রামে সুলতানুল আউলিয়া হযরত করম আলী শাহ্ (রহ.) মাজার হওয়ায় আমরা গর্বিত। এই মাজারের জন্য এলাকায় মহামারি রোগ হয় না, বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় না। এলাকার মানুষ সুখে বসবাস করছে। এখানে প্রতিদিন অনেক মানুষ আসে। তা ছাড়া প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে ওরস মোবারক অনুষ্ঠিত হয়। এতে এলাকার মানুষসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ অংশগ্রহণ করেন।’

তিনি জানান, শুধু মানুষের মঙ্গলের জন্য এই মাজারটি পরিচিত, তা নয়। এই মাজারে অনেক পাখির বসবাস এবং তারা কারো কোনো ক্ষতি করে না আর এলাকার মানুষও পাখিদের কোনো ক্ষতি করে না।



মন্তব্য চালু নেই