কি বলছে ইসলাম, কনে দেখা কি জায়েজ?

বিয়ে-শাদীর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পাত্র-পাত্রী নির্বাচন। দাম্পত্য জীবনের পরিধি যেমন অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত এর সমস্যাও তেমন খুবই বিস্তৃত, জটিল ও স্পর্শকাতর। এ জন্য বিয়ের পূর্বেই পাত্র-পাত্রী দেখে সকল দিক গভীরভাবে তলিয়ে দেখা জরুরী, যেন পরবর্তীতে এ সংক্রান্ত কোন সমস্যা দাম্পত্য জীবনকে দুর্বিষহ না করে তোলে। এ জন্য ইসলাম এর প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে যথেষ্ট।

সাহাবী আবু হুরায়রা রা. এর বর্ণনায় এসেছে, এক ব্যক্তি মহানবীর সা. নিকট এসে বলল, আমি একজন আনসারী রমণীকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। এ কথা শুনে মহানবী সা. বললেন, মেয়েটিকে দেখে নাও। কেননা আনসারীদের চোখে আবার সমস্যা থাকে। [মুসলিম:১/৪৫৬]

অন্য এক হাদীসে সাহাবী হযরত জাবির রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ যদি কোন নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তার জন্য যদি বিয়ের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী অঙ্গগুলো দেখার সুযোগ হয়, তাহলে সে যেন সে অঙ্গগুলো দেখে নেয়। [আবু দাউদ: ১/২৮৪]

অন্য বর্ণনায় হযরত মুগিরা বিন শো’বা রা. বলেন, আমি জনৈক নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। এটা শুনে রাসূলূল্লাহ্ সা. আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, তুমি কি তাকে দেখেছ? আমি বললাম, না দেখিনি। তখন তিনি নির্দেশ দিলেন যে, তুমি তাকে দেখে নাও। তোমার এই দর্শন তোমাদের মাঝে দাম্পত্য জীবনের প্রণয়-ভালোবাসা গভীর হবার বড় সহায়ক হবে। [তিরমিযী: ১/২০৭]

উপরোক্ত হাদীসগুলোর ভাষ্য এক ও অভিন্ন। তা হচ্ছে বিয়ের পূর্বে বর কনেকে দেখে নেয়া। তো মেয়ে দেখার শরীআত সম্মত নিয়ম হলো দীনদারীকে প্রাধান্য দিয়ে আনুসাঙ্গিক সকল বিষয় প্রথমে দেখে নিবে। মনঃপুত হলে বিয়ের ইরাদা নিয়ে যথাসম্ভব গোপনীয়তা রক্ষা করে মেয়ের মুখ ও উভয় হাত দেখে নিবে। বর ছাড়া অন্য কোন পুরুষের কনে দেখা শরীআতে নিষিদ্ধ। চাই সে বরের পিতা বা অন্য কোন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হোক না কেন। তাদের কেউ বরের পক্ষ হয়ে কনে দেখলে কবীরা গুনাহ হবে। সুতরাং আমাদের দেশে বাবা, ভাই, বন্ধু-বান্ধব মিলে ঘটা করে মেয়ে দেখার যে প্রচলন চালু আছে তা শরীআতের দৃষ্টিতে নাজায়িজ ও হারাম। পুরুষ সদস্য বাদ দিয়ে শুধু নারী সদস্য নিয়েও ঘটা করে মেয়ে দেখা শরীআত সম্মত নয়। কেননা এভাবে ঘটা করে কনে দেখার পর যদি কোন কারণবশতঃ বিয়ে না হয়, তাহলে এটা ঐ মেয়ে পক্ষের জন্য রীতিমত বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী সময়ে অন্যরা মেয়ের ব্যাপারে নানা রকম সন্দেহের মধ্যে পড়ে। ফলে এই মেয়ে বিয়ে দেয়া কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়। আর কোন মানুষকে এভাবে বিপদে ফেলা ইসলাম সম্পূর্ণ নিষেধ করেছে। [মুসলিম:১/৪৫৬; আবু দাউদ:১/২৮৪; তিরমিযী:১/২০৭;ফাতওয়ায়ে মাহমুদিয়া: ৩/২১২]

কনে দেখার ক্ষেত্রে কেবল মাত্র কনের হাত ও মুখই দেখা যেতে পারে। অবশ্য কাপড়ের উপর দিয়ে যদি শরীরের সামগ্রিক অবয়ব দেখে নেয়া হয়, তাহলে কোন অসুবিধা নেই। কেবল মাত্র বিয়ে করার উদ্দেশ্যেই কনে দেখতে পারবে এছাড়া নয়। বিয়ে করার উদ্দেশ্যে কনে দেখার সময় যদি কামোত্তেজনার সৃষ্টি হয়, তাতেও কোন আপত্তি নেই। কেননা এটাতো শরীআত অনুমোদিত একটি প্রয়োজন। [হিদায়া:৪/৪৪৩;আল মুগনী:৭/৭৪;]

আর যদি মেয়েরা কনে দেখে তাহলে প্রয়োজনে শরীআতের সাধারণ রীতি অনুযায়ী নাভি থেকে হাটু পর্যন্ত স্থানটুকু বাদ দিয়ে অবশিষ্ট পূর্ণ শরীর দেখতে পারবে। [টীকা-আবু দাউদ:২/২৮৪] এ

জন্যই কোন অঙ্গ সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিলে নির্ভরযোগ্য কোন নারীর মাধ্যমে তা যাচাই করে নিতে পারবে। পাত্রী দেখার জন্য পাত্রীর অভিভাবকগণের পূর্ব অনুমতি জরুরী নয়। কোন রুপ ঘোষণা ছাড়া কনে কিংবা কনের অভিভাবকদের অলক্ষ্যে যদি দেখে নেয় তাতেও অসুবিধে নেই। বরং বিভিন্ন রেওয়ায়েত ও নীতিমালার আলোকে মনে হয় অঘোষিত ও গোপনীয়ভাবে দেখাটাই অধিক সঙ্গত। যেমন, সাহাবী হযরত জাবের রা. এর বর্ণনায় এসেছে, “আমি একটি মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার পর তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে নেই।” এই হলো কনে দেখার ইসলামের সোনালী দর্শন। যা অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ। এতে না আছে বাড়াবাড়ি না আছে ছাড়াছাড়ি। এই দর্শন ও নীতিগুলো মেনে কনে দেখলে মেয়ে পক্ষও আপদ মুক্ত থাকল। আবার ছেলে পক্ষেরও কনে দেখার ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হলো না। পক্ষান্তরে পশ্চিমা সভ্যতা এ ক্ষেত্রে করেছে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি। তুলেছে এক নষ্ট শ্লোগান।

এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য হলো বিয়ের পূর্বেই ছেলে-মেয়ে এক ছাদের নিচে এক সাথে দীর্ঘ সময় কাটাতে হবে। একে অপরের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ ও ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এভাবে সহাবস্থান ও ঘনিষ্ঠতার ভিতর দিয়ে একে অপরকে জানবে, বুঝবে। এরপর নিবে বিয়ের সিদ্ধান্ত। এতে ফল যা হবার তাই হয়েছে। এক ছাদের নিচে পার করল দীর্ঘদিন। মধু বিতরণকারী নারী মধু বিতরণ করল আর চুষে চুষে খেল মধুলোভী পুরুষ। এভাবে চলল বেশ কিছুদিন। এরপর কোন একজন বলে উঠলো তোমাকে আমার ভালো লাগেনি। ব্যাস! ঝামেলা চুকে গেল। তখন পাড়ী জমালো আরেক পুরুষের বাহুতলে। এভাবে একদিন তার যৌবনের মধুর হাড়ি খালি হয়ে গেল। মধু সন্ধানীরাও তার থেকে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখল।

এখন কি করবে এই নারী? এই জীবন সায়াহ্নে তার তো আশ্রয়দানের কেউ নেই। কে তাকে আশ্রয় দিবে। আদর-সোহাগের হাত আলতো করে বুলিয়ে দিবে তার গায়ে। পাঠক! একবার ভেবে দেখুন অবস্থার ভয়াবহতার গভীরে গিয়ে। আর চিন্তা করুন নিজেকে দিয়ে যদি আপনার এই করুন দশা হয়, তাহলে কেমন হবে? এজন্যই ইসলাম পশ্চিমা নষ্ট সভ্যতার এই নির্লজ্জ ও জঘন্য চিন্তাকে নিষিদ্ধ করেছে কঠোরভাবে এবং বলেছে এটি জঘন্যতম অপরাধ। [বুখারী:২/১০০৬-১০০৯;মুসলিম:২/৬৫-৭০;তিরমিযী:১/২৬৪-২৬৫]

পক্ষান্তরে উপমহাদেশীয় কালচার অনেকটা এমন, কনে দেখবে ছেলের অভিভাবকরা। ছেলে কনেকে দেখলে দোষের মনে করা হয়। এই চিন্তাও ভুল। কারণ কনে দেখা সংক্রান্ত হাদীসগুলোতে বরকেই কনে দেখার নির্দেশ হয়েছে। সেখানে অভিভাবকদের সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। তাছাড়া বর কনেকে না দেখে শুধুমাত্র অভিভাবকগণ দেখে বিয়ে সম্পাদন করলে বরের কনেকে পছন্দ নাও হতে পারে। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে দাম্পত্য জীবনে সৃষ্টি হয় অশান্তি। যার নজীর আমাদের সমাজে নেহায়েত কমও নয়।

তাই বর নিজে কনেকে দেখে নেওয়াটাই অধিক সঙ্গত ও নিরাপদ। পাত্রী নির্বাচনের মাপকাঠি: পাত্রী নির্বাচন ও আত্মীয়তা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মাপকাঠি কি হবে? মহানবী সা. তা স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। সাহাবী আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, মহানবী সা. ইরশাদ করেছেন, চারটি বৈশিষ্ট্যের কারণে কোন মেয়েকে বিয়ে করা যায়।

১.তার সম্পদ।

২.বংশ-মর্যাদা।

৩.রুপ-লাবণ্য।

৪.তার দীনদারী।

তন্মধ্যে দীনদার নারীকে বিয়ে করে দাম্পত্য জীবনকে সফল ও বরকতময় করে তোল। [তিরমিযী:১/২০৭]

উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, দীনদারীর সাথে সাথে কনের রুপ-লাবণ্য, খান্দান, অর্থ-সম্পদ এবং প্রকৃতিগতভাবে ভালোলাগে এমন গুনকেও পাত্রী নির্বাচনের মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করা যায়। এই কথার সমর্থন পাওয়া যায় সূরা নিসার এক আয়াতে। আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, “যেসব নারী তোমাদের পছন্দ হয় তাদের বিয়ে কর।” [সূরা নিসা.৩]

উক্ত আয়াতের মর্মকথা হলো, যে সকল হালাল নারী প্রকৃতিগতভাবে তোমাদের মনঃপুত হয়, তাদের তোমরা বিয়ে করতে পারবে। [মাআরিফুল কুরআন:২/২৭০]

অনুরুপ বিবেচনা পাত্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে উত্তম হলো সর্বাবস্থায় বর-কনের দীনদারী ও চারিত্রিক এবং আখলাকী দিকটিকেই মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করা। যেমন, আমরা জানতে পেরেছি ইতিপূর্বে বর্ণিত এতদসংক্রান্ত হাদীসটি দ্বারা। এছাড়াও এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সা. ইরশাদ করেন, দীনদারী ও চারিত্রিক দিক বিবেচনায় তোমাদের পছন্দ হয়, এমন বিয়ের প্রস্তাব তোমাদের নিকট আসলে তোমরা বিয়ের কার্য সম্পাদন কর। যদি সম্পাদন না কর, তাহলে সমাজে দেখা দিবে বিরাট ফিতনা ও ভয়াবহ বিপর্যয়। [তিরমিযী:১/২০৭;বাদায়েউস সানায়ে:২/৩১৭]

সমতা: হযরত রাসূলে কারীম সা. থেকে বর্ণিত কোন কোন হাদীসে বর-কনের মাঝে কুফূ তথা সমতার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেই হাদীসগুলোকে সামনে রেখে আমাদের ফকীহগণ বর-কনের মাঝে সমতার ক্ষেত্রে ১০টি বিষয় বিবেচনায় রাখতে বলেছেন।

যথা-
১.বংশ-খান্দান।
২.স্বাধীনতা ও দাসত্ব।
৩.বংশগত মুসলমান ও নওমুসলিম।
৪.তাক্বওয়া ও দীনদারী।
৫.অর্থনৈতিক অবস্থা ও সম্পদশালিতা।
৬.আভিজাত্য।
৭.পেশা।
৮.শারীরিক সুস্থতা।
৯.আখলাক-চরিত্র।
১০.বিবেক-বুদ্ধি।

তবে অকাট্য সত্য হলো দীনদারী ও চারিত্রিক বিষয়টি সর্বিশেষে লক্ষনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। বংশ-খান্দান ইত্যাদির বিচারে বাড়াবাড়ি করা ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ সা. দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র, যিনি তোমাদেরকে মূর্খযুগের মন্দ স্বভাব ও তার অহংকার থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন। মানুষ হয়তো হবে মুমিন-মুত্তাক্বী নতুবা পাপী-দুর্ভাগা। [আবু দাউদ]

মহানবী সা. ও তাঁর সাহাবাদের মহান জামাত এ ক্ষেত্রে অতি সুন্দর উপমা পেশ করেছেন স্ব স্ব আমল দ্বারা। রাসূলুল্লাহ্ সা. স্বীয় চাচাতো বোন যায়নাব রা. কে বিয়ে দিয়েছেন স্বীয় গোলাম হযরত যায়েদ ইবনে হারিসার রা. সাথে। এভাবে মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ এর সাথে বিয়ে দিয়েছেন হযরত যাবআহ বিনতে যুহাইর ইবনে আ. মুত্তালিবকে। এরপর তিনি বলেছেন, “আমি মিকদাদ ও যায়েদের বিয়ে তাদের সাথে এজন্য দিলাম যেন, আল্লাহ্র কাছে মর্যাদার বিচারে তারাই শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত যারা তোমাদের মধ্যে চরিত্রের বিচারে উত্তম। [বায়হাক্বী:৭/১৩৪-১৩৫]

মহানবী সা. ও সাহাবায়ে কেরামের আলোকময় জীবনে এ জাতীয় উপমা প্রচুর। তাই বিয়ে-শাদীতে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের মাপকাঠি হওয়া উচিৎ দীনদারী, তাক্বওয়া ও আখলাক। তবে মানুষের স্বভাবগত বৈচিত্রের বিবেচনায় উপরোক্ত অন্যান্য বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখার অনুমতি রয়েছে।-আল জান্নাত



মন্তব্য চালু নেই