কান্তজীও মন্দিরে রামায়ণের গল্পে একদিন

বৈচিত্রময় টেরাকোটা অলংকরণে, ইন্দো-পারস্য ভাস্কর্য্য শৈলীতে নির্মিত কান্তজীউ মন্দির দেখার ইচ্ছা ছিল বহুদিন ধরেই। একটি মন্দির, তার সকল দেয়ালে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাস্কর্য্য তৈরি করে তার মাধ্যমে বয়াণ করা হয়েছে মহাভারতের কাহিনী। মন্দিরটির ছবি বা বর্ণনা যতবার পড়েছি শুধু মুগ্ধ হয়েছি। সরাসরি দেখার সুযোগ হয়ে গেল বন্ধুর বড় ভাইয়ের বিয়েতে!

আমার ছোটবেলার বন্ধু তন্বী। বড় ভাই নিকো ভাইয়ের বিয়ে ঠাকুরগাঁ এ শুনেই মনের মাঝে উঁকি দিল এতদিনের ইচ্ছাটা। যদিও বিয়ে বাড়ি, ঘোরাঘুরি কতটা করতে পারব এই নিয়ে সন্দেহ ছিল মনে। আবার ঠাকুরগাঁ থেকে দিনাজপুর অনেকটা পথ। আবদার করাটা ঠিক হবে কিনা এই চিন্তাও করতে লাগলাম। দ্বিধা-দ্বন্দ কাটিয়ে বলেই ফেললাম এক সময়, ‘চল, সবাই মিলে কান্তজীও মন্দিরটা দেখে আসি!’ বলার সাথে প্রস্তাব পাস হয়ে গেল! আমি তো মহা খুশী!

বড়দের সাথে তেমন জমে না আমার। এমনকি সমবয়সীদের সাথেও কেন জানি অনেক সময় লাগে বন্ধুত্ব হতে। তাই সঙ্গী হল একদল দুষ্টু মিষ্টি বাচ্চা ছেলে মেয়ে। সবাই মিলে নিকো ভাইয়ের হবু শ্বশুরবাড়ির গাড়িতে করে আমরা রওনা দিলাম। পৌঁছে গেলাম ঘন্টা দুই এর মাঝে।

মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আমি সত্যিই হতবাক। মানুষের এত ধৈর্য্য কি করে হয়? কি করে এত ছোট ছোট লক্ষ লক্ষ মূর্তি তৈরি করতে পেরেছে কারিগররা? অনেকের মতে কান্তনগরে স্থাপিত বলে-এর নাম কান্তজিউ মন্দির। জনশ্রুতি আছে, শ্রী-কৃষ্ণের বিগ্রহ অধিষ্ঠানের জন্য এ মন্দির নির্মিত হয়েছিল। দিনাজপুরের তৎকালীন জমিদার প্রাণনাথ রায় ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে পোড়ামাটির অলঙ্করণ সমৃদ্ধ এ মন্দিরটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তবে তার জীবদ্দশায় এ মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ করে যেতে পারেন নি। পরে ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তারই পালক পুত্র রাম নাথ রায় মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ করেন।

বাংলাদেশে এমন স্থাপত্যশৈলী সমৃদ্ধ মন্দির আর নেই। মন্দিরের গায়ে মূর্তির সংখ্যা লক্ষাধিক। ৩ ফুট উঁচু, ৬০ ফুট বর্গাকৃতির বেদীর উপর মন্দিরটি নির্মিত। সামগ্রিক দৃষ্টিতে মন্দিরটি দেখতে সুবৃহৎ রথের মতো। তিনতলা বিশিষ্ট এবং বর্গাকারে নির্মিত মন্দিরের প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ৫২ ফুট এবং উচ্চতা ৭০ ফুট। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ায় উপরের গম্বুজ ঘরের আকৃতি ধারণ করেছে। ভূমিকম্পে ভেঙে যাওয়ার আগে গম্বুজের উপরে ৯টি সুদৃশ্য চুড়া ছিল।

কান্তজীউ মন্দিরের ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতি বছর রাস পূর্ণিমায় এখানে বসে পক্ষকালব্যাপী মেলা। প্রাচীন এই স্থাপনাটি যদি আপনি এখনও না দেখে থাকেন তাহলে আর দেরী করবেন না। সংরক্ষণের প্রয়োজনে এখন আর মন্দিরে প্রবেশ করা যায় না। কিন্তু সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায় দুই চোখ ভরে। আর এত শুধু সৌন্দর্য্য নয়, বিস্ময়।

আমি প্রকৃতিপ্রেমী। দালান আমার ভাল লাগে না। কিন্তু কান্তজীও কোন দালান নয়, এটি একটি মূর্তিমান শিল্প। একটি গল্প, কিংবদন্তী। ঢাকা থেকে যেতে হলে প্রথমে বাসে দিনাজপুর যাবেন। এরপর দিনাজপুর কেন্দ্রীয় বাস স্টেশন থেকে পীরগঞ্জের বাসে কান্তনগর নামতে হবে। সেখানে নেমে ঢেপা নদী পার হয়ে একটু সামনেই মন্দিরটি। শীতের সময় নদী পায়ে হেঁটে পার হতে পারলেও বর্ষায় কিন্তু নৌকায় পার হতে হবে।



মন্তব্য চালু নেই