কলকাতার কিছু নিজস্ব ভয় এবং…
সব শহরেই নিজস্ব কিংবদন্তি থাকে। চরিত্রগতভাবে তাদের মধ্যে মিলও থাকে। কিন্তু শহরভেদে বদলে যায় তাদের রকম। দিল্লির নাগরিক লিজেন্ড আর বেঙ্গালুরুর শহুরে কিংবদন্তি এক হতে পারে না। কিন্তু। একটা জায়গায় তাদের বিপুল সাযুজ্য, সেটা ভয়ের জায়গা। প্রত্যেক শহরেরই নিজস্ব কিছু ভয় থাকে। তাকে ঘিরে গড়ে ওঠে আরবান লিজেন্ড। দিল্লির সুলতানি-মোগলাই ঐতিহ্যের মধ্যে আলো-আঁধারির খেলা বিপুল। সেখানে তাই ভয়ের চেহারা এক রকম। বেঙ্গালুরুতে এই বস্তু অলভ্য। আবার, মুম্বইয়ের সাগর-সান্নিধ্যে যে ধরনের জাহাজি ভয়ের হাওয়া ঘুরপাক খায়, তা কখনওই জয়পুরে পাওয়া যাবে না। তেমনই আমাদের কলকাতার আরবান লিজেন্ড ঘাঁটতে বসলে ভয়ের যে কানাচগুলো উঠে আসে, তা একেবারেই এক্সক্লুসিভ। ভারতের অন্য শহরে তাদের দেখা মিলবে না।
এখানে রইল শহর কলাকাতার বিভিন্ন সময়ের কিছু মার্কামারা ভয়ের কথা।
• নিশি: এর উৎস অবশ্যই শহরে নয়। শহরে উঠে আসা গ্রামজীবন তাকে নিয়ে এসেছিল ভুশণ্ডির মাঠ থেকে, উদ্ধারণপুরের ঘাট থেকে। নিশির ডাকের গল্প কলকাতায় বিপুল জনপ্রিয়তা পায় বিংশ শতকের গোড়ায়। তার পরে অবশ্য বার বার ফিরে এসেছে নিশির কাহিনি। বলা হয়, নিশুত রাতে যখন গভীর ঘুমে শহর মগ্ন তখন জানলার কাছে কেউ নাম ধরে ডাকবে। তার কণ্ঠস্বর শুনলে মনে হবে, একান্ত পরিচিত জনই ডাকছে। সে নাকি তিন বার ডাকে। তার সেই ডাকে সাড়া দিলেই বিপদ। মৃত্যু সুনির্ঘাত। যাঁরা আরও ডিটেলে যেতেন, তাঁরা বলতেন
— কাপালিকরাই নাকি নিশিডাকের পাণ্ডা। তারা হাতে একটা মন্ত্রপূঃত মুখকাটা কচি ডাব নিয়ে এই মায়াডাকটি ডাকে। যাকে তারা খতম করতে চায়, সে তিনটি ডাকের একটিতে সাড়া দিলেই তারা সেই ডাবের কাটামুখটি ঝপ করে বন্ধ করে দেয়। আর তাতেই সাড়া প্রদানকারীর ভবলীলা সাঙ্গ। কিন্তু এতে সেই কাপালিকের কী লাভ? শহরের রোয়াক-বৈঠকখানায় সর্বজ্ঞরা জানাতেন, এ নাকি এক ঘোর অপসাধনা। এমন ১০৮টি খতমকাণ্ড ঘটাতে পারলেই নাকি কাপালিকের পোয়াবারো। সিদ্ধি একেবারে হাতের মুঠোয়। নিশির লিজেন্ড আজও সচল এই শহরে।
• হিরামোতি রাক্ষুসী: ১৯৪০-এর দশকে তারা হানা দিত সাঁঝবেলায়, মূলত উত্তর কলকাতার গলি-উপগলির ভিতরে। সন্ধে লাগার আগে বাচ্চারা বিনা ঝামেলায় দুধ খেয়ে নিত। কহাবত ছিল, হিরামোতি (নাকি ‘হিরামতী’?) অবাধ্য বাচ্চাদের তার ঝোলায় পোরে। তার পরে তাদের নিজের ডেরায় নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে তাদের কী করে, তা অবশ্য কোনও দিনই জানা যায়নি। সন্ধে ঘনাতো কাঠ আর কয়লার উনুনের ধোঁয়ায়, শহরের উপগলির ভিতরে গ্যাসের বাতির ক্ষীণ আলো ঘুলিয়ে উঠত। আর সে আসত। সত্যিই আসত। ঝম ঝম করে শব্দ হতো তার পায়ের বাঁধা ঘুঙুরে। তার মুলোর মতো দাঁত, কুলোর মতো কান নিয়ে সে এসে দাঁড়াত গৃহস্থের সদর দরজায়। তার পরে হাত পাততো। গৃহকর্তা পয়সা দিলে নিষ্ক্রান্ত হতো। আসলে হিরামোতি ছিল এক বিশেষ শ্রেণির বহুরূপী। বাগবাজার, আহিরীটোলা, শোভাবাজার, এমনকী পটলডাঙাতেও ছিল তার অবাধ গতি। তার প্রকৃত সত্যটা জানলেও বাড়ির অভিভাবকরা লিজেন্ডকে বজায় রাখতেন অবাধ্য কনিষ্ঠদের জব্দ করতে।
• স্টোনম্যান: সে ভূত নয়। অশরীরীও নয়। তবু তার ভয়ে সিঁটিয়ে থেকেছে শহরবাসী। ১৯৮৯-এর জুন মাসে ফুটপাথবাসী জনৈক ব্যক্তিকে ঘুমন্ত অবস্থায় কেউ পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে দেয়। এর পর থেকে ক্রমান্বয়ে চলতে তাকে একের পরে এক সিরিয়াল কিলিং। পুলিশ বিরাট ধন্ধে পড়ে। অজানা খুনির নাম দেওয়া হয় ‘স্টোনম্যান’। তাকে খুঁজতে গিয়ে গ্রেফতার হন বেশ কিছু ভবঘুরে। গণধোলাই জোটে কিছু নেশাখোরের ভাগ্যে। রাতে পুলিশের টহলদারি বাড়। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠে নৈশ প্রহরার বাহিনী। কিছুদিন আতঙ্ক ছেয়ে থাকার পরে আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যায় স্টোনম্যানের তাণ্ডব। কিন্তু লিজেন্ড জেগে থাকে। তাকে তো জেগে থাকতেই হয়।
• ব্যান্ডেজ ভূত: বর্ণনা থেকে জানা যায়, তার চেহারা মিশরের মমির মতো। অর্থাৎ কিনা তার সর্বাঙ্গ ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়া। সে নাকি পাবলিক টয়লেটে ওৎ পেতে থাকে। ঝুঁঝকো আঁধারের রাতে সে রাস্তাতেও বিচরণ করে। ১৯৮০-র দশক থেকে ১৯৯০-র দশকের গোড়া পর্যন্ত যত্রতত্র ঘুরে বেরিয়েছে তার কাহিনি। সে নাকি সরাসরি এসে গলা টেপে। রাতের ফাঁকা লোকাল ট্রেনেও নাকি দেখা গিয়েছে তাকে। গুজবে গুজবে ভরে যায় শহরের পেট। তার পরে একদিন ব্যান্ডেজ ভূত উবে যায় কর্পূরের মতো। কিন্তু লিজেন্ড থেকে যায় ফল্গুস্রোতের কেতায়। তাকে তো থাকতেই হবে, না হলে শহর অসম্পূর্ণ।
মন্তব্য চালু নেই