‘কবি নজরুল আমাদের জাতীয় চেতনায় প্রতিচ্ছবি’
বাংলাদেশের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, গানের বুলবুল, প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি, বাংলার সবচেয়ে শক্তিমান কবি- এমন নানা ভূষণে-উপাধিতে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলাম। তার সৃষ্টি-কর্মে মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমের বাণী উচ্চারিত হয়েছে প্রবলভাবে। সেই মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমে উজ্জ্বীবিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সোমবার পালিত হয়েছে এ সব্যসাচী লেখক-সাহিত্যিকের ১১৬তম জন্মবার্ষিকী। রাজধানীসহ দেশের সকল জেলায় তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন সর্বস্তরের মানুষ ও বিভিন্ন সংগঠন।
নজরুল বাঙালীর মননশীলতার অনেকখানি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত আছে । আজীবন সংগ্রামী এই কবির জীবনী যেন এক জিয়নকাঠি । মুহূর্তেই জেগে উঠে মন প্রাণ। মৃত্যুর প্রায় অর্ধ শতাব্দী হতে চললেও নজরুল প্রাসঙ্গিক । নজরুলকে অনেক পরিচয়ে পরিচায়িত করা যায় । তিনি একাধারে কবি, সাংবাদিক, সৈনিক, সুরকার, সাহিত্যিক রাজনীতিবিদ তো বটেই । অসংখ্য ধর্মীয় গীত রচনা করে নজরুল হিন্দু- মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের প্রিয় পাত্রে পরিনত হয়েছিলেন জীবদ্দশায়। নজরুল কেমন ছিলেন সত্যিকার অর্থে, তেমনি কিছু বিষয় নিয়ে নিম্নে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি ।
বিদ্রোহের জয়ডঙ্কা বাজিয়ে ধুমকেতুর মত যার আগমন তিনি হচ্ছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম । তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সুরস্রষ্টা, সাংবাদিক, রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি, শিল্পী, সুরকার, প্রাবন্ধিক । নজরুলের কবিতায়, সাংবাদিকতায়, সঙ্গীতের প্রতিটি পরতে পরতে ফুটে উঠেছে নিপীড়িত, বঞ্চিত, খেটে খাওয়া মানুষের কথা । তিনিই প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন ।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকরেন কাজী নজরুলইসলাম। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়াথানায় অবস্থিত।পিতামহ কাজী আমিনউল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদেরদ্বিতীয়া পত্নী জাহেদাখাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম| তারা ছিলেন তিন ভাই এবং বোন। তার সহোদর তিন ভাইও দুই বোনের নাম হল: সবার বড় কাজী সাহেবজান, কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন, বোনউম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল “দুখু মিয়া”| ব্রিটিশশাসিত ভারতের অখন্ড বঙ্গভূমির বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নিলেও নন্দিত কবিপুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম আজ আমাদের জাতীয় কবি।
রাজনৈতিক উত্থান-পতনে নানা ভৌগোলিক বিভাজনের সূত্রে এক অর্থে ভিনদেশি হয়েও যে-কারণে তিনি আজ আমাদের জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত, এর পেছনে রয়েছে তাঁর প্রতি ও তাঁর সৃষ্টিকর্মের প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এবং একই সঙ্গে এদেশের মানুষের সঙ্গে তাঁর নিজের সম্পৃক্ততা, সম্প্রীতি ও আক্ষরিক অর্থেই প্রেমের বন্ধন।তিনিস্থানীয় মক্তবে (মসজিদ পরিচালিতমুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল) কুরআন, ইসলামধর্ম , দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে যখন তার পিতার মৃত্যু হয়, তখন তারবয়স মাত্র নয় বছর।পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে তাঁর শিক্ষা বাধাগ্রস্থহয় এবং মাত্র দশ বছরবয়সে তাকে নেমে যেতে হয় জীবিকা অর্জ্জনে। এসময়নজরুল মক্তব থেকে নিম্নমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াজ্জিন (আযানদাতা)হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলাম ধর্মের মৌলিক আচার অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা তারপরবর্তী সাহিত্যকর্মকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে।তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়।
কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতেকিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। এ সময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেনবিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মত কবিতা; ধূমকেতুর মত সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী। এই সবসাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণেরসাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক পরিচিতি লাভ করেন। বাংলাভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
পশ্চিমবঙ্গও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত।তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়।তার কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের প্রতি মানুষের অত্যাচার এবংদাসত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামেরমর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদএবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণাহাতেতাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে – কাজেই “বিদ্রোহী কবি”।
মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেননা। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ওনৃত্যেরমিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমান নাট্যদল)| দলে যোগ দেন। তার চাচাকাজী বজলেকরিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবংআরবি, ফারসি ওউর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায়গান রচনা করতেন।ধারণা করা হয় বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগদিয়েছিলেন।এছাড়া ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবংকবিয়াবাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটোদলেইসাহিত্য চর্চা শুরু হয়।
এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদেরসাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। নিজকর্মববং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরুকরেন।একইসাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন।সেই অল্পবয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন। এরমধ্যে রয়েছেচাষার সঙ, শকুনীবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবরবাদশাহ, কবিকালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের গান, বুড়ো শালিকের ঘাড়েরোঁ এবং মেঘনাদবধ। একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তব জীবন, অপর দিকে লেটো দলেরবিচিত্রঅভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে।নজরুলেরএসময়কার কবিতার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে:
“ আমি আল্লা নামের বীজ বুনেছি এবার মনের মাঠে
ফলবে ফসল বেচবো তারে কিয়ামতের হাটে। ”
১৯১০সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। লেটো দলে তারপ্রতিভায়সকলেই যে মুগ্ধ হয়েছিল তার প্রমাণ নজরুল লেটো ছেড়ে আসার পরতাকে নিয়েঅন্য শিষ্যদের রচিত গান: “আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদহীন /ভাবি তাইনিশিদিন, বিষাদ মনে / নামেতে নজরুল ইসলাম, কি দিব গুণের প্রমাণ”| এই নতুনছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল| এর পরভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্রইনস্টিটিউশননামে পরিচিতি লাভ করে। মাথরুন স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষকছিলেনকুমুদরঞ্জন মল্লিক যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।তারসান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস। কুমুদরঞ্জন স্মৃতিচারণ করতেযেয়েনজরুল সম্বন্ধে লিখেছেন,
“ ছোটসুন্দর ছনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাশপরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত।আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম।সে বড় লাজুক ছিল।
যাহোক, আর্থিক সমস্যা তাকে বেশী দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠশ্রেণীপর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেনবাসুদেবেরকবিদলে। এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবংসবশেষেআসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টেরমাঝেইতার বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময়আসানসোলেরদারোগা রফিজউল্লাহ’র’ সাথে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসেনজরুল যেসবকবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভারপরিচয় পান।তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালেরদরিরামপুরস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনিআবাররানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণীথেকেপড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন। ১৯১৭খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনিসেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। এই স্কুলে অধ্যয়নকালে নজরুল এখানকারচারজন শিক্ষক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এরা হলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতেরসতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী চেতনা বিশিষ্ট নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফারসিসাহিত্যের হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্য চর্চার নগেন্দ্রনাথবন্দ্যোপাধ্যায়।
নজরুলের জীবনালেখ্য পর্যালোচনা করলে জানা যায়, এদেশের ভূখন্ডে তিনি পা রাখেন তাঁর কৈশোরেই। দারিদ্র্যকবলিত পরিবারে জন্ম-নেওয়া এই কবি-কিশোর আসানসোলের মাথরুন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ চুকিয়ে কিছুদিন প্রসাদপুরের এক বাঙালি খ্রিষ্টান পরিবারে বাবুর্চির কাজ করেন। আবারও আসানসোলে এসে যখন তিনি একটি রুটির দোকানে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করছিলেন তখন ঘটনাচক্রে তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার পরিচয় পেয়ে কাজী রফিজউল্লাহ নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে পরিবারের সদস্যের মতো নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেন। কিছুদিন পরই তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানায় দারোগা হিসেবে বদলি হলে নজরুলকেও সঙ্গে নিয়ে কাজীর সিমলা গ্রামে আসেন। ১৯১৪ সালের জানুয়ারি মাসে পার্শ্ববর্তী দরিরামপুর হাইস্কুলে নজরুলকে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়। নিজগুণেই নজরুল বিনাবেতনে লেখাপড়ার সুযোগ পান। বার্ষিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান পেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে চঞ্চলমতি নজরুল কাউকে না-জানিয়ে তাঁর নিজ গ্রাম চুরুলিয়ায় ফিরে যান। কিন্তু কাজীর সিমলা গ্রাম ও দরিরামপুর স্কুলকে তিনি ভুলে যাননি। ১৯২৬ সালের ১৭-১৮ জানুয়ারি ময়মনসিংহে এক কৃষক-শ্রমিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
আমন্ত্রণ পেয়ে সম্মেলনে যোগ দিতে না-পারলেও কৃষ্ণনগর থেকে পাঠানো এক বাণীতে কবি লেখেন : ‘ময়মনসিংহ জেলার কাছে আমি অশেষ ঋণে ঋণী। আমার বাল্যকালের অনেকগুলি দিন ইহারই বুকে কাটিয়া গিয়াছে… আজও আমার মনে সেইসব প্রিয় স্মৃতি উজ্জ্বল ভাস্বর হইয়া জ্বলিতেছে।’ পরিণত বয়সে আবারো ময়মনসিংহ অঞ্চলে নজরুল অনেক ঘুরেছেন। ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ঢাকা, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ জেলার বিস্তৃত অঞ্চল ছিল তাঁর নির্বাচনী এলাকা। জয়লাভ তো দূরের কথা, নির্বাচনে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। ভোটপ্রার্থী হিসেবে প্রত্যাখ্যাত হলেও কবি হিসেবে তিনি সর্বত্রই ছিলেন সমাদৃত। নজরুলের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য কাজী নজরুল ইসলামের নামে ময়মনসিংহে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে নানা কাজের সূত্রে, তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ও বহু সম্মেলনে যোগ দিতে নজরুল ইসলাম এদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন। যেখানে তিনি আজ চিরনিদ্রায় শায়িত, সেই ঢাকা শহর ও এর আশপাশের এলাকায় তাঁর কর্মময় দিনগুলোর দিকে তাকানো যাক।
নজরুল প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন বিত©র্র্কত তারিখ ১৯২৬ সালের ২৪ জুন (!) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ২৭-২৮ জুনে অনুষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের একটি অধিবেশনে যোগ দিতে। এখানে এসে প্রথমবারের মতো পরিচয় ঘটে কবি ও প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের উদ্যোক্তা কাজী আবদুল ওদুদ, আবদুল মজিদ সাহিত্যরত্ন ও অন্য অনেকের সঙ্গে। নজরুল সেই সম্মেলনে ইসলামি পুনর্জাগরণ বিষয়ে বক্তব্য রাখার পর গজল গাওয়া ছাড়াও তাঁর ‘খালেদ’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন এবং ‘খোশ আমদেদ’ নামে একটি নতুন গান পরিবেশন করেন। চট্টগ্রামের সাপ্তাহিক সম্মিলনী এবং মাসিক যুগের আলো পত্রিকার সম্পাদক দিদারুল আলম এ-সময়ে ঢাকায় আসেন। তাঁর অনুরোধে নজরুল আট পঙ্ক্তির প্রশস্তি লিখে দেন, যা যুগের আলোর একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে নজরুল আবারও ঢাকায় আসেন; ওঠেন ড. কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের বাসায়। এখানে বসে তিনি ‘এ বাসী আসরে আসিলে কে ছলিতে’ এবং ‘চল চল চল’ গানটি রচনা করেন, যা এখন আমাদের রণসংগীতের মর্যাদা পেয়েছে। এ-সফরে তিনি পরিচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক প্রখ্যাত কবি ও প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু এবং কাজী মোতাহার হোসেনের দূরসম্পর্কের বোন ফজিলতুননেসার সঙ্গে। ফজিলতুননেসা ছিলেন প্রথম মুসলমান নারী, যিনি গণিতশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন এবং পরে সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিলেতে যান। ফজিলতুননেসার রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে নজরুল তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং এ-বিষয়ে কাজী মোতাহার হোসেন ও ফজিলতুননেসাকে অনেক চিঠি লিখেন ও বই পাঠান।
কাজী মোতাহার হোসেন একটি চিঠিতে ফজিলতুননেসার অনাগ্রহের কথা জানালে নজরুল অনুশোচনা করে এ-বিষয়ে বিরত হন। এরপর হঠাৎ করেই তিনি একই বছরের জুন মাসে আবারো ঢাকায় এলে ঘনিষ্ঠতা জন্মে রানু সোম নামে এক সুকণ্ঠী তরুণীর সঙ্গে, যিনি পরে বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী হওয়ার পর প্রতিভা বসু নামে খ্যাতি অর্জন করেন। সেবারের ঢাকা সফরকালে নজরুল রানু সোমকে তাঁদের বনগ্রামের বাসায় গানের তালিম দিতে শুরু করেন এবং তাঁদের বাসায় বসে তিনি ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী এ কোন্ সোনার গাঁয়’ গানটি রচনা করেন।
এ-সময়ে তিনি একদল গোঁড়া তরুণের আক্রমণের শিকার হন; তারা লাঠিসোটা নিয়ে নজরুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু সৈনিক হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নজরুলের সঙ্গে তারা পেরে ওঠেনি। রানু সোম পরে কলকাতায় গিয়ে নজরুলের কাছে গান শেখেন এবং নজরুলের প্রচেষ্টায় তিনি গ্রামোফোনে ও বেতারে গান গাওয়ার সুযোগ পান। নজরুলের সঙ্গে রানু সোম ওরফে প্রতিভা বসুর সম্পর্ককে ব্যঙ্গ করে শনিবারের চিঠি পত্রিকায় নজরুলের ‘কে বিদেশী মন উদাসী’ গানটির প্যারোডি ‘কে উদাসী বনগাঁবাসী’ ছাপা হয়।
১৯২৬ সালে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্যপ্রার্থী হিসেবে নজরুল নির্বাচনী প্রচারের কাজে ঢাকা হয়ে জয়দেবপুরে গিয়েছিলেন। পথে যেতে যেতে তিনি ‘চাঁদনী রাতে’ নামে কবিতাটি লেখেন। কবি আবদুল কাদিরের বিয়ে উপলক্ষে ১৯৩৪ সালের ২১ অক্টোবর কবি ঢাকায় আসেন এবং ‘বন্ধন’ শীর্ষক ‘অনন্তকাল এ অনন্তলোকে’ আশীর্বাণী রচনা করেন। নারায়ণগঞ্জ সংগীত সংসদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আববাসউদ্দীনসহ কয়েকজন শিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে নজরুল ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জে আসেন ১৯৩৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর।
ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নজরুল ঢাকায় আসেন বুদ্ধদেব বসু ও একদল শিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৪০ সালের ১৬ ডিসেম্বর। তাঁর রচনা ও পরিচালনায় ‘পূবালী’ নামে একটি সংগীত-বিচিত্রা প্রচারিত হয় ঢাকা বেতার থেকে। পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে আসার সময় রচিত ‘পদ্মার ঢেউ রে’ এবং নৌকায় ভাসমান বেদে সম্প্রদায়ের মেয়েদের দেখে লেখা ‘আমি পূরব দেশের পূরনারী’ গানগুলো সেই সংগীত-বিচিত্রার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪০ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত শচীন সেনগুপ্তের ‘ঝড়ের রাতে’ নাটকের সংগীত পরিচালনায় ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সংগত কারণে ঢাকায় কাটানো নজরুলের শেষ-জীবনের তথ্যাবলি এ-লেখার শেষাংশে তুলে ধরা হলো।
নজরুল প্রথমবারের মতো কুমিল্লায় আসেন ১৯২১ সালের ৪ এপ্রিল। আসার পথে ট্রেনে বসে তিনি লেখেন ‘নীলপরী’ নামে একটি কবিতা। দৌলতপুর যাওয়ার পথে তাঁদের যাত্রাবিরতি ঘটে কান্দিরপাড়ে, সফরসঙ্গী আলী আকবর খানের পরিচিত ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে। ইন্দ্রকুমারের স্ত্রী বিরজাসুন্দরীর স্নেহে আপ্লুত হয়ে নজরুল তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন; পরে তাঁকে নিয়ে কবিতা লেখেন ও তাঁর নামে বই উৎসর্গ করেন; সে-বাড়িতেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা জন্মে বিরজাসুন্দরীর দেবর বসন্তকুমার সেনগুপ্ত ও গিরিবালা দেবীর মেয়ে আশালতার সঙ্গে, যাঁর ডাকনাম ছিল দোলন বা দুলি – নজরুল নিজে যাঁর নাম দিয়েছিলেন প্রমীলা। একই যাত্রায় একদিন পর দৌলতপুর গিয়ে ঘটে আরো এক নাটকীয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে নজরুল পরিচিত হন আলী আকবর খানের পিতৃহীন ভাগ্নি সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে, নজরুল যার নাম দিয়েছিলেন নার্গিস।
সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে নার্গিসের গান শুনে ও রূপ দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রেমে পড়েন। অল্পদিনের মধ্যেই দৌলতপুরে বসে অনেক কবিতা ও গান লিখে ফেলেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে : ‘অ-বেলায়’, ‘হার-মানা হার’, ‘পাপড়ি খোলা’, ‘অনাদৃতা’। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন নার্গিসকে তিনি বিয়ে করবেন। খবর পেয়ে কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদসহ কবির বহু সুহৃদ বিয়ের ব্যাপারে তাঁকে সাবধানে এগোতে পরামর্শ দেন। তাঁর ও নার্গিসের একান্ত আগ্রহে ১৯২১ সালের ১৭ জুন নজরুল-নার্গিসের ‘আক্ত’ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। অজ্ঞাত কারণে কনের মামা আলী আকবর খান কাবিননামায় শর্ত জুড়ে দেন, নজরুল নার্গিসকে নিয়ে কখনো দৌলতপুর ছেড়ে যেতে পারবেন না। এই অন্যায় আচরণ ও শর্তে মর্মাহত কবি পরের দিনই নার্গিসকে ফেলে রেখে হেঁটে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে পৌঁছেন। কিন্তু এরই মধ্যে দৌলতপুরে বসেই তিনি লিখে ফেলেন ‘বিদায়-বেলায়’, ‘বেদনা-অভিমান’, ‘বিধুরা পথিক-প্রিয়া’, ‘মুকুলের উদ্বোধন’, ‘লাল সালাম’, ‘হারা-মণি’, ‘মানস বধূ’ ও ‘মনের মানুষ’ কবিতাগুলো। কান্দিরপাড়ে প্রমীলার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থেকে কবি নার্গিসকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। জুনের শেষ সপ্তাহে তিনি কুমিল্লায় বসে ‘আজি রক্তনিশি ভোরে’, ‘ভিক্ষা দাও’ – এ দুটি দেশাত্মবোধক গান এবং ‘আমি এ-দেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তমা’ – এই প্রেমের গানটি রচনা করেন।
১৯২১ সালের ১৮ নভেম্বর নজরুল আবারও কুমিল্লায় আসেন এবং যথারীতি ওঠেন প্রমীলাদের বাসায়। সেখানে পৌঁছেই ‘বন্দনা গান’ নামে একটি গান লেখেন, যা পরে ‘বিজয় গান’ নামে সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একই সময়ে তিনি ‘নিশীথ-প্রীতম’ ও ‘বিজয়িনী’ নামে দুটি কবিতা লেখেন। ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারত সফর উপলক্ষে দেশব্যাপী তখন হরতাল চলছে। কুমিল্লায় একটি মিছিলে কাঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে তিনি সরকারবিরোধী গান গেয়েছেন, মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তরুণদের জন্য ‘জাগরণী’ নামে একটি নতুন কোরাস গান লিখে দিয়েছিলেন। সেই গান রচনা ও প্রচারের দায়ে একরাত তাঁকে থানায় আটকে রাখা হয়।
নজরুল তৃতীয়বারের মতো কুমিল্লায় আসেন ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এ-সময়ে তিনি প্রায় চার মাস প্রমীলার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কাটান। একশ্রেণির গোঁড়া হিন্দু ও উগ্র তরুণ একটি মুসলমান ছেলের সঙ্গে প্রমীলার এই সম্পর্ককে খারাপ চোখে দেখতে শুরু করে এবং এলাকায় এ নিয়ে বেশ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে নজরুল তাঁর ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘প্রিয়ার রূপ’ কবিতাগুলো এবং ‘শায়ক-বেঁধা পাখি’ ও ‘চিরচেনা’ গান দুটি রচনা করেন। প্রমীলার সঙ্গে তাঁর মেলামেশা নিয়ে এলাকাবাসীর উত্তেজনার কারণে জুন মাসের কোনো একসময়ে নজরুল কলকাতায় ফিরে যান। এরপর ২২ নভেম্বর প্রমীলা ও তাঁর মা গিরিবালা দেবীর সঙ্গে তিনি আবারও কুমিল্লায় আসেন এবং আসার পরদিনই পুলিশ তাঁকে আটক করে। প্রমীলার সঙ্গে সম্পর্কজনিত উত্তেজনার কারণে নয়, ধূমকেতু পত্রিকার সরকারবিরোধী ভূমিকার দায়ে তাঁকে আটক করা হয়। ট্রেনে করে পুলিশ তাঁকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যায়।
রাজনীতি সচেতন এবং ভারতবর্ষের মুক্তি আন্দোলনের একজন মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন কবি ইংরেজদের কাছে । সবসময় তিনি ইংরেজেদের রোষানলে ছিলেন। ১৯২৩ সালে তিনি প্রকাশ করেন আনন্দময়ীর আগমনে । কবিতাটির শুরুর পংতিতে ছিল ক্ষোভ আর হতাশা আর ঘৃণার কথা । যেমন লিখেছেন তিনি –
আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল ?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী চাঁড়াল ।
দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভু-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী ?
রাজনৈতিক কবিতা হওয়ার অপরাধে ১৯২২ সালের ৮ ই নভেম্বর ইংরেজরা এটিকে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে এবং একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯২৩ সালে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে জবানবন্দী দেন যা রাজবন্দীর জবানবন্দী নামে খ্যাত । তিনি বলেছেন –
আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।… আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়,সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে…
প্রহসনের বিচারে কবির ১ বছরের সাজা হয়, তাকে এই সময়ে সমর্থন জানিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। তিনি তখন রচনা করেছিলেন আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে । যেমনটি লিখেছেন –
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে ।
আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার-ভাঙা কল্লোলে ।
আসল হাসি, আসল কাঁদন,
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে ।
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে-
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে ।
এক বছরের কারাদন্ড শেষে নজরুল জেল থেকে ছাড়া পেয়েই ১৯২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর কুমিল্লায় চলে আসেন। কিন্তু প্রমীলার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে এলাকার লোকজন বাড়াবাড়ি শুরু করলে তিনি গোপনে কুমিল্লা ছাড়তে বাধ্য হন। এর চার মাস পর ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল কলকাতার একটি বাড়িতে প্রমীলার সঙ্গে তাঁর বিয়ের কাজটি সম্পন্ন হয়।
নজরুলের বহুশিল্পিত রচনার জন্মভূমি চট্টগ্রাম। তিনি প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামে আসেন ১৯২৬ সালের ২৬ জুলাই। সিন্ধু-হিন্দোল কাব্যগ্রন্থের বহু কবিতা সেখানে রচিত হয়। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন হবীবুল্লাহ বাহার ও তাঁর বিদুষী ভগ্নি শামসুন নাহার মাহমুদকে, যাদের সান্নিধ্যে তিনি কাটিয়েছিলেন সেই দিনগুলো। ‘অ-নামিকা’, ‘গোপন প্রিয়া’, ‘শিশু যাদুকর’, ‘সিদ্ধু-প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তরঙ্গ’, ‘বাংলার আজিজ’ ও ‘কর্ণফুলী’ কবিতাগুলো তখন তিনি রচনা করেন। ১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রায় পুরোটাই তিনি চট্টগ্রামে কাটান। কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে সীতাকুন্ড পাহাড়ে উঠে ও সাম্পানে চড়ে তিনি অত্যন্ত উল্লাসের মধ্যে সেই দিনগুলো কাটিয়েছেন। চক্রবাক কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা তিনি সেখানে বসে রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’, ‘ওগো ও চক্রবাকী’, ‘বাদল রাতের পাখি’, ‘স্তব্ধ রাতে’, ‘নবীন চন্দ্র’ (অঞ্জলি পুরিয়া মম) ও ‘শীতের সিন্ধু’ কবিতাগুলো (পরবর্তীকালে ‘শীতের সিন্ধু’র নামকরণ করা হয় ‘সিন্ধু-চতুর্থ তরঙ্গ’)। এছাড়া ‘সাম্পানের গান’ (ওরে মাঝি ভাই), ‘আমার সাম্পান যাত্রী না লয়’ (যার মুদ্রিত রূপ ‘আমার এ না’ যাত্রী না লয়’), ‘কী হইব লাল বাওটা তুইল্লা’, ‘তোমার কূলে তুলে বন্ধু’ গানগুলোও তিনি এখানে বসে রচনা করেন।
কবির অকৃত্রিম সুহৃদ কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদের পৈতৃক নিবাস সন্দ্বীপ। ২৮ জানুয়ারি তিনি জাহাজে ও নৌকায় চড়ে সেখানে যান। বিতর্ক থাকলেও জানা যায় : তিনি তাঁর ‘খেলিছে জলদেবী সুনীল সাগরজলে’ গানটি তখন রচনা করেন। ১৯৩৩ সালের ৭ মে নজরুল আবারও চট্টগ্রাম জেলা সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। বিকেলের অধিবেশনে তিনি গান ও কবিতা আবৃত্তি করেন।
নজরুল প্রথমবারের মতো ফরিদপুরে আসেন ১৯২৫ সালের ১ মে, কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগ দিতে। তিনি সেই সম্মেলনে মহাত্মা গান্ধী ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উপস্থিতিতে অসহযোগ আন্দোলনকে নিয়ে লেখা তাঁর ‘চরকার গান’ এবং এর সঙ্গে ‘শিকল-পরা ছল’ ও ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ গানগুলো গেয়ে শোনান। এ-সময়ে ঘনিষ্ঠতা জন্মে কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে। দ্বিতীয়বার ১৯২৬ সালের ১০ মার্চ তিনি ফরিদপুরের মাদারীপুর আসেন। মাদারীপুরে নিখিল বঙ্গীয় ও আসাম প্রদেশীয় মৎস্যজীবী সম্মিলনীর তৃতীয় অধিবেশনে ‘ধীবর’ বা ‘জেলেদের গান’ শীর্ষক ‘আমরা নিচে পড়ে রইবো না আর’ উদ্বোধনী গান হিসেবে পরিবেশন করেন। গানটি অবশ্য কৃষ্ণনগরে বসে লেখা। সেই সম্মেলনে কুমিল্লা থেকে আগত রাজনৈতিক নেতা বসন্তকুমার মজুমদার ও তাঁর স্ত্রী নারীনেত্রী হেমপ্রভার সঙ্গে পরিচিত হন। নজরুল তখন হেমপ্রভাকে নিয়ে একটি দেশাত্মবোধক গান ‘কোন অতীতের অাঁধার ভেদিয়া’ রচনা করেন। নিজের নির্বাচনী প্রচারের কাজে নজরুল আবারো ফরিদপুরে আসেন একই বছরের ৩ নভেম্বর। এবার তিনি ওঠেন কবি জসীমউদ্দীনের বাড়িতে। পানীয় হিসেবে চা তখনো এদেশে সব মহলে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। কলকাতা থেকে নিয়ে-আসা চা বানাতে দিলে এক বাড়ির মেয়েরা পেঁয়াজ-রসুনসহ রাজ্যের সব মশলা সহযোগে রান্না করে তা কবিকে খেতে দেয়। বিষয়টি বহুদিন বহু লোকের হাসির খোরাক জুগিয়েছে।
১৯৩৬ সালের ২৭ জানুয়ারি কবি ফরিদপুর আসেন জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মিলনীতে সভাপতি হিসেবে যোগ দিতে; ১৯৩৮ সালে ফরিদপুর সংসদের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করতে এবং সবশেষে ১৯৪১ সালের ১২ আগস্ট ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগ দিতে। অবশ্য সেই সম্মেলনস্থলে ১৪৪ ধারা জারি হওয়ায় তা পন্ড হয়ে যায়। একটি মসজিদে ধর্মীয় আলোচনায় অংশ নিয়ে নজরুল কলকাতায় ফিরে যান।
১৯২৭ সালের ১৫ থেকে ২০ জুন তিনি উষ্ণ সংবর্ধনা পান নোয়াখালিতে। আটটি ঘোড়ায়-চালিত এক শৌখিন গাড়িতে চড়িয়ে সোনাপুর রেলস্টেশন থেকে কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় খাদেমুল ইসলাম অফিসে; পথে পথে নির্মিত হয়েছিল সুসজ্জিত বহু তোরণ: এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁকে উপহার দেওয়া হয় সোনার তৈরি দোয়াত ও কলম; লক্ষ্মীপুরের জেলেরাও তাঁকে সংবর্ধনা জানান। সেখানে তাঁকে উপহার দেওয়া হয় রুপার তৈরি মালা ও বাটি। এমন প্রাণঢালা সংবর্ধনা পেয়েছেন তিনি সিলেটেও ১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে। সেখানকার পর্দাপ্রথার কঠিন নিয়ম ভঙ্গ করে বহু মুসলমান নারী তাঁর অনুষ্ঠানে যোগ দিলে গোঁড়া মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে; কিন্তু দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ও অন্য তরুণদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
আমাদের উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের এবং পশ্চিম সীমান্তের জেলাগুলোতে নজরুল প্রায়ই আসতেন। ১৯২৪ থেকে ১৯৩২ সালের বিভিন্ন সময়ে তিনি দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর ও বাকেরগঞ্জে এসেছেন একাধিকবার। বিভিন্ন সম্মেলনে অতিথি হিসেবে যোগদান কিংবা তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনা উপলক্ষে এসব সংক্ষিপ্ত সফরে এসেছেন কবি। এসব সফরের সময় রচিত কোনো কবিতা বা গানের কথা আমাদের জানা নেই। তবে ১৯২৮ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি রংপুরের হরগাছায় বসে ‘ভোরের পাখী’ কবিতাটি লিখেছেন।
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের অবসান চেয়ে যে-নজরুল এতকিছু লিখেছেন, কারাবরণ করেছেন, জাপানকে পরাজিত করার কাজে সহায়তা করলে ব্রিটিশরা চলে যাবে সে-আশ্বাসে ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধেও গিয়েছেন, সেই তিনি ১৯৪৭-এর বিতর্কিত স্বাধীনতা ও ১৯৭১-এর বাংলাদেশের স্বাধীনতা কিছুই দেখে যেতে পারেননি, যদিও শারীরিকভাবে তিনি বেঁচে ছিলেন। এক অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪২ সাল থেকেই তিনি বোধশক্তি ও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তবে, বলতে গেলে এরপরই বাংলাদেশে নজরুল-চর্চা আরো বেগবান হয়ে ওঠে। বাংলা একাডেমীসহ বহু প্রকাশনা সংস্থা থেকে নজরুলের বইগুলোর নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হতে থাকে এবং বিভিন্ন জায়গায় তাঁর জন্মজয়ন্তী উদযাপিত হতে শুরু করে। ১৯৬৩ সাল থেকে বেতারে তাঁর গান ‘নজরুল গীতি’ হিসেবে স্বতন্ত্র মর্যাদা পায়। ১৯৬৪ সালের ২৪ মে ঢাকায় নজরুল একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭০ সালে নজরুলের জীবন ও কর্ম নিয়ে আমাদের দেশে সরকারি উদ্যোগে বিদ্রোহী কবি নামে প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়।
১৯৭১ সালে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় বোধশক্তিহীন নির্বাক কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের ৩৩০-বি ভবনটি এবং একটি গাড়ি কবির নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ডাক্তার-নার্সসহ সেবা-শুশ্রূষার সবরকম ব্যবস্থা করা হয়। ভবনটির নতুন নাম রাখা হয় ‘কবিভবন’ যা এখন আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান নজরুল ইনস্টিটিউট। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি লিট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৭৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। একই বছর তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় এবং ‘চল চল চল’ গানটি আমাদের রণসংগীতের মর্যাদা পায়।
সৈনিক জীবন
১৯১৭খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতারফোর্টউইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশেরনওশেরায় যান।প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরুকরেন। তিনিসেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০খ্রিস্টাব্দেরমার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়েরমধ্যে তিনি ৪৯বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক থেকে কোয়ার্টার মাস্টারহাবিলদার পর্যন্তহয়েছিলেন। উক্ত রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে তিনিফারসি ভাষাশিখেন।
এছাড়া সহসৈনিকদের সাথে দেশী-বিদেশী বিভিন্নবাদ্যযন্ত্র সহযোগেসঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন, আর গদ্য-পদ্যের চর্চাওচলতে থাকে একই সাথে।করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেনতার মধ্যে রয়েছে, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা); গল্প:হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধিইত্যাদি। এই করাচি সেনানিবাসে থাকা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্নসাহিত্যপত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্যপত্রিকা। এইসময় তার কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়এবং ফারসি কবিহাফিজের কিছু বই ছিল।
এ সূত্রে বলা যায় নজরুলের সাহিত্যচর্চার হাতেখড়িএই করাচি সেনানিবাসেই। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথমবিশ্বযুদ্ধে অংশনেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তুযুদ্ধ থেমেযাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গলরেজিমেন্টভেঙে দেয়া হয়। এর পর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায়ফিরে আসেন।
সাংবাদিক জীবন ও বিয়ে
যুদ্ধশেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিমসাহিত্যসমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতমকর্মকর্তামুজফ্ফর আহমদ। এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূলকাজগুলোশুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্যপত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যেরয়েছেউপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতেরশরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্ম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দম্। এই লেখাগুলোসাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিতহয়। এর প্রেক্ষিতে কবি ও সমালোচকমোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায়তার খেয়া-পারের তরণী এবং বাদলপ্রাতের শরাবকবিতা দুটির প্রশংসা করেএকটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন। এথেকেই দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ওসমালোচকদের সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয়শুরু হয়। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্যসমিতির অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদশহীদুল্লাহ্, আফজালুল হক প্রমুখেরসাথে পরিচয় হয়। তৎকালীন কলকাতারদুটি জনপ্রিয় সাহিত্যিক আসর গজেনদারআড্ডা এবং ভারতীয় আড্ডায়অংশগ্রহণের সুবাদে পরিচিত হন অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশিরভাদুড়ী, শরৎচন্দ্রচট্টোপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, ধুর্জটিপ্রসাদমুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্রবন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ প্রমুখের সাথে। ১৯২১ সালের অক্টোবরমাসে তিনিশান্তিনিকেতনে যেয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকেরবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কাজীমোতাহার হোসেনের সাথে নজরুলের বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।
১৯২০খ্রিস্টাব্দের জুলাই ১২ তারিখে নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিকপত্রিকাপ্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেপ্রকাশিতএই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। এইপত্রিকারমাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। ঐ বছরই এইপত্রিকায় “মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে?” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেনযার জন্যপত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশেরনজরদারী শুরুহয়। যাই হোক সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ওসামাজিক অবস্থাপ্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। একইসাথে মুজফ্ফর আহমদের সাথেবিভিন্ন রাজনৈতিকসভা-সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতি বিষয়ে প্রত্যক্ষঅভিজ্ঞতা অর্জনেরসুযোগ পেয়েছিলেন। বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমেকবিতা ও সঙ্গীতেরচর্চাও চলছিল একাধারে। তখনও তিনি নিজে গান লিখে সুর দিতেশুরু করেননি। তবে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতজ্ঞ মোহিনী সেনগুপ্তা তার কয়েকটিকবিতায় সুর দিয়েস্বরলিপিসহ পত্রিকায় প্রকাশ করছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে:হয়তো তোমার পাবদেখা, ওরে এ কোন স্নেহ-সুরধুনী। সওগাত পত্রিকার ১৩২৭বঙ্গাব্দের বৈশাখসংখ্যায় তার প্রথম গান প্রকাশিত হয়।
গানটি ছিল: “বাজাওপ্রভু বাজাও ঘন”।১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্যসমিতির অফিসেগ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানেরসাথে পরিচিত হন। তার সাথেইতিনি প্রথমকুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিতহন প্রমীলাদেবীর সাথে যার সাথে তার প্রথমে পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল।তবে এর আগেনজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসারখানমেরসাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনের নজরুলের ঘর জামাইথাকার শর্ত নিয়েবিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবংবাসর সম্পন্ন হবারআগেই নার্গিসকেরেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীরবাড়িতে চলে যান।তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলেরপরিচর্যা করেন। একপর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
বিদ্রোহী নজরুল
তখনদেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। নজরুল কুমিল্লাথেকেকিছুদিনের জন্য দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে থেকে আবার কুমিল্লাফিরেযান ১৯ জুনে। এখানে যতদিন ছিলেন ততদিনে তিনি পরিণত হন একজন সক্রিয়রাজনৈতিক কর্মীতে। তার মূল কাজ ছিল শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দিয়ে গানগাওয়া। তখনকার সময়ে তার রচিত ও সুরারোপিত গানগুলির মধ্যে রয়েছে “এ কোনপাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়, আজি রক্ত-নিশি ভোরে/ একি এ শুনিওরে/ মুক্তি-কোলাহল বন্দী-শৃঙ্খলে” প্রভৃতি। এখানে ১৭ দিন থেকে তিনিস্থানপরিবর্তন করেছিলেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে আবারকুমিল্লায় ফিরেযান। ২১ নভেম্বর ছিল সমগ্র ভারতব্যাপী হরতাল। এ উপলক্ষেনজরুল আবার পথেনেমে আসেন; অসহযোগ মিছিলের সাথে শহর প্রদক্ষিণ করেন আর গানকরেন, “ভিক্ষাদাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী”। নজরুলের এসময়কার কবিতা, গান ওপ্রবন্ধের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশিত হয়েছে। এরসর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণহচ্ছে বিদ্রোহীনামক কবিতাটি। বিদ্রোহী কবিতাটি ১৯২২খ্রিস্টাব্দেপ্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ করে।এই কবিতায়নজরুল নিজেকে বর্ণনা করেন –
“ আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ জ্বালা, চির লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর !
আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালবাসা তার কাকন চুড়ির কন-কন ।
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব বহ্নি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল অগ্নিপাথার কলরোল কলকোলাহল ।
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সঞ্চারী ভুবনে সহসা সঞ্চারী ভূমিকম্প ।
আমি চির বিদ্রোহী বীর –
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির !”
১৯২২খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করে। এটিসপ্তাহেদুবার প্রকাশিত হতো। ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন একসময়ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্রবিপ্লববাদেরআবির্ভাব ঘটে তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। এইপত্রিকাকেআশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
মন্তব্য চালু নেই