কবি নজরুলের ত্রিশালের জীবন
ভারতের আসানসোলের রুটির দোকান থেকে কিশোর নজরুলকে ১৯১৪ সালে দারোগা রফিজউল্লাহ নিয়ে এসেছিলেন ময়মনসিংহের ত্রিশালের কাজির শিমলা গ্রামের নিজবাড়িতে।
কবি নজরুলকে ভর্তি করে দেন ত্রিশাল উপজেলা সদরের দরিরামপুর একাডেমি স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে। এখান থেকে কবি নজরুলের স্কুল যাত্রা শুরু হলেও পরে বর্ষাকালে দারোগা তাঁকে যাতায়াতের সুবিধার জন্য জায়গীর করে দেন নামাপাড়া গ্রামের বিচুতিয়া বেপারী বাড়িতে।
ত্রিশাল উপজেলা সদর থেকে তিন কি.মি দূরে নামাপাড়া গ্রামের বিচুতিয়া বেপারীর বাড়িতে থেকে বটতলা হয়ে কিশোর নজরুল দরিরামপুর একাডেমি স্কুলে পড়তেন। নজরুল নেই, কিন্তু এখনো আছে সেই বটগাছ। যার নিচে বসে নজরুল আপন মনে বাঁশি বাজাতেন। কাটিয়ে দিতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এখনো আছে সুতিয়া নদী, যার কূল ঘেঁষে নজরুল হাঁটতেন।
কাজির সিমলায় নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। বটতলা নামাপাড়ায় সেই বিচুতিয়া বেপারী বাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে নজরুল যাদুঘর। দরিরামপুর হাইস্কুলের নাম পাল্টে এখন নজরুল একাডেমী রাখা হয়েছে । নজরুলের নামে ত্রিশালে গড়ে উঠেছে অনেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান।
কবি নজরুলের সেই বাল্য স্মৃতিকে ধরে রাখতে এই গ্রামেরই বটতলা নামক স্থানে স্থানীয় জনগণের দান করা জমিসহ ২৫ একরজমিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য, সঙ্গীত, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল এই চারটি বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালর যাত্রা শুরু করে। পরে পাঁচটি অনুষদের আওতায় ব্যবসায় প্রশাসন, সামাজিক বিজ্ঞানসহ বাংলাদেশের সমৃদ্ধলোকসাহিত্য, লোক সংস্কৃতির উন্নয়ন ও গবেষণারও উদ্যোগ নেয়া হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫টি বিভাগে প্রায় ৬ হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করার সুযোগ পাচ্ছে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. মোহিত উর আলম জানান, ত্রিশালে নজরুল কেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিবর্তন গোটা এলাকার শিক্ষাও যোগাযোগ অবকাঠামোসহ ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীসহ নজরুল প্রেমিক ভক্ত অনুরাগী ও গবেষকদের কাছে ত্রিশাল এখন নজরুল গবেষণার চারণভূমি ও পর্যটনের নগরী।
নজরুল জন্মজয়ন্তীর উৎসব ও এ উপলক্ষে আয়োজিত নজরুল মেলায় হাজারও মানুষের ঢল নজরুলের প্রতি ভালবাসারই জানান দিচ্ছে বলে মন্তব্য করছেন নজরুল প্রেমিক এই শিক্ষাবিদ। নজরুল ইনস্টিটিউট নজরুল চর্চা ও গবেষণায় আরও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে দাবি এই উপাচার্যের। এদিকে নজরুলের শেকড় নামাপাড়া গ্রামের বিচুতিয়া বেপারী বাড়ির আঙ্গিনায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র ও নজরুল আর্কাইভ।
বিচুতিয়া বেপারীর যে ঘরে নজরুল থাকতেন সেই শোবার ঘরটির ভিটি পাকা করে করা হয়েছে নজরুল আর্কাইভ। ৩ তলার স্মৃতি কেন্দ্রের নিচতলায় রয়েছে ২০০ আসনের অডিটরিয়াম, ২য় তলায় অফিস ও ৩য় তলায় জাদুঘর কাম পাঠাগার।
নজরুল জন্মজয়ন্তীকে সামনে রেখে বরাবরের মতো এবারও সাজানো হয়েছে এই স্মৃতি কেন্দ্রটি। বিচুতিয়া বেপারীর বংশধর আব্দুল বারেক বেপারী জানান, নজরুল কেন্দ্রিক উন্নয়নে তিনি খুশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পরিবারের জমি দানের কথা উল্লেখ করে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচুতিয়া বেপারীর নামে একটি হলের নামকরণের দাবি করেন তিনি। একই সঙ্গে স্মৃতিকেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ রাখার দাবিও জানান। নজরুলের বাল্য স্মৃতিবিজড়িত কাজির শিমলা গ্রামের দারোগা রফিজ উল্লাহর বাড়িতে করা হয়েছে কবি নজরুল স্মৃতি কেন্দ্র ও পাঠাগার।
দু’তলার এই ভবনের নিচতলায় রয়েছে সেমিনার কক্ষ। দু’তলায় রয়েছে রিডিংরুম কাম রেস্ট হাউস। নজরুলের দুর্লভ সব ছবি, নজরুল সংগ্রহ, বেশ কিছু বই ও একটি পুরনো খাট রয়েছে এখানে। ভবনের সামনের পুকুরটি সংস্কার করে এর ঘাট পাকা করা হয়েছে।
দারোগাবাড়ির বংশধর কাজী শাহাদত হোসেন কাজির শিমলা গ্রামে সরকারের এই উদ্যোগের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রের পাশে একটি খেলার মাঠ করার দাবি করেছেন।
স্মৃতি কেন্দ্রের কেয়ারটেকার আজিজুল হক জানান, স্মৃতিকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারত, শ্রীলঙ্কা, দুবাই ও অস্ট্রেলিয়াসহ দেশ-বিদেশের নানা স্থানে নজরুল প্রেমিক ভক্ত অনুরাগী ও গবেষকরা আসছেন নজরুলের শেকড় অনুসন্ধানে। অথচ স্মৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার এক দশকের প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগসহ এর কোন সংস্কার ও মেরামত কাজ করা হয়নি।
এদিকে, ত্রিশালে কবি নজরুলের ১১৭তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনে কবির স্মৃতিঘেরা ত্রিশালের দরিরামপুর নজরুল একাডেমি মঞ্চে তিন দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে জেলা প্রশাসন ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। ৩ দিন ব্যাপী এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে ত্রিশালে বিরাজ করছে সাজসাজ রব। কবির ভক্ত-অনুরাগীদের মধ্যে বিরাজ করছে বাড়তি উৎসাহ-উদ্দীপনা।
ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, আজ বুধবার বেলা ৩টায় এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি।
দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি।
সমাপনী দিন শুক্রবার সকাল ১০টায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ এমপি। প্রতিদিনই অনুষ্ঠান শেষে থাকবে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মন্তব্য চালু নেই