ওয়েলকাম করা গেল না
বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ক্যান্সারের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছেন। এই আবিষ্কারের ফর্মুলা ও স্বয়ং বিজ্ঞানীকে হাইজ্যাক করতে সচেষ্ট একটি আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র।
আর তাদের হাত থেকে বিজ্ঞানীকে রক্ষা করতে সচেষ্ট বাংলাদেশের এক পুলিশ অফিসার। এই হলো অনন্ত জলিল পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘মোস্ট ওয়েলকাম টু’র মূল কাহিনী। থিম হিসেবে মন্দ নয়, চলচ্চিত্রটিকে আন্তর্জাতিক একটি প্রেক্ষাপটে স্থাপন করতে সুযোগ করে দিয়েছে গল্পটি। কিন্তু যখনই এই থিমটিকে বিস্তার করার প্রয়োজন পড়েছে ও কাহিনীর ডালপালা ছড়িয়েছে, উদ্ভটত্ব ও বাস্তবতাবিবর্জিত সব ব্যাপারস্যাপার গল্পটাকে খেয়ে ফেলেছে।
অনন্ত জলিল প্রযোজিত ও অভিনীত ষষ্ঠ চলচ্চিত্র ‘মোস্ট ওয়েলকাম টু’। আগের প্রিকুয়েল ‘মোস্ট ওয়েলকাম’ সুপারহিট হয়েছিল, সিকুয়েলও ভালোই চলছে। কিন্তু মৃতপ্রায় চলচ্চিত্র কারখানায় প্রাণসঞ্চারকারী নায়ক-পরিচালক-প্রযোজক অনন্ত জলিলকে তার পরের প্রজেক্টগুলো নিয়ে আরেকটু ভাবতে হবে। কারণ শেষ চলচ্চিত্র ‘নিঃস্বার্থ ভালবাসা’য় একটা গল্প ছিল, কিছুটা বাস্তবতার ছোঁয়াও ছিল তাতে। কিন্তু ‘মোস্ট ওয়েলকাম টু’-র মতো এতটা গল্পহীন ও বাস্তবতাবিবর্জিত হলে, তার ছবি দর্শক এক পর্যায়ে প্রত্যাখ্যান করবে। উপরে বলা থিমটুকু ছাড়া এই চলচ্চিত্রের কাহিনীতে আর কিছুই নেই। বিজ্ঞানীর নিরাপত্তার দায়িত্ব পাবার পর বিজ্ঞানীর নাতনী অধরার সঙ্গে পুলিশ অফিসার আরিয়ানের প্রেম হয়। আর বারবার বিজ্ঞানী ও তার পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করলেও মাত্র একবারের ব্যর্থতায় আরিয়ানকে পুলিশের চাকরি ছেড়ে চলে আসতে হয়, ভিলেনকূলের সহযোগী এক উচ্চপদস্থ অফিসারের হস্তক্ষেপে তাকে গ্রেফতারও করা হয়। বাকি পুরো সময়ই ভিলেনকূলের সঙ্গে আরিয়ানকে মারামারি করতে দেখা গেছে। অবশ্য নায়িকার সঙ্গে অনেকগুলো অপ্রাসঙ্গিক গানেও তাকে অংশ নিতে হয়েছে।
গল্পে মনোযোগ না দিয়ে পরিচালক ও নায়ক অনন্ত জলিল নিজস্ব ফাইটিং অ্যাকশন দেখাতে বেশি আগ্রহী ছিলেন এই চলচ্চিত্রে। ফলে অপ্রয়োজনীয় অ্যাকশন দৃশ্য, সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ও ইফেক্ট সাউন্ডের পীড়নে পুরো চলচ্চিত্র থেকে রূপ-রস-নন্দন বিতাড়িত হয়েছে। চলচ্চিত্রের অতি সাধারণ একটি ধারণা যে দৃশ্য বা ঘটনা পরম্পরা এক ধরনের দ্বান্দ্বিক বিন্যাসের মধ্য দিয়ে এগোয়। যদি একটি সিকোয়েন্সে বা দৃশ্যে বিপুল গোলযোগ থাকে তবে পরের সিকোয়েন্সে বা দৃশ্যে আশা করা হয় নিরবতার প্রাবল্য থাকবে। কিন্তু এসব নিয়মের ধার ধারেন নি পরিচালক। বিরতিহীন ধ্বংসলীলা ও মৃত্যুমিছিলের ভিতর দিয়ে সুপারহিরো আরিয়ান এগিয়ে গিয়েছেন একা, সঙ্গে গল্পকে নেননি, মাঝে মাঝে প্রেমিকাকেও ফেলে গিয়েছেন।
বাস্তবতার বলি কিভাবে দেয়া হয়েছে তার কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথম উদাহরণটা চেনা – বহু গুলিবর্ষণ, ব্রাশফায়ার, গ্রেনেড নিক্ষেপ হয়েছে, আরিয়ান নিহত তো দূরের কথা একবারও আহত হননি। অথচ একহাতে তিনি সাবাড় করেছেন সব শত্রুকে। বিদেশি শত্রুদের ছেড়ে দেয়া ভাইরাসে লক্ষ লক্ষ লোক অসুস্থ হচ্ছে, হাসপাতালে হাজার হাজার মানুষ ভর্তি হয়েছে, মানবদরদী নায়িকা অধরা হাসপাতালে রোগীদের পরিদর্শনে গিয়েছেন; ডাক্তার-নার্সরা পর্যন্ত মাস্ক পরে আছেন, কিন্তু অধরা এত ভাইরাস পেরিয়েও সুস্থ থেকে গিয়েছেন। বিজ্ঞানীর নাতিকে স্কুলের সামনে থেকে কিডন্যাপ করেছে শত্রুরা, খবর পেয়ে বিজ্ঞানী রওয়ানা দিয়েছেন, অজানা আশঙ্কা থেকে বোন অধরা ও মা রওয়ানা দিয়েছেন, রওয়ানা দিয়েছে শত্রু গুণ্ডারাও – সবার দেখা হলো এক চৌরাস্তায়। না, জনবহুল ঢাকা শহরের কোনো ব্যস্ত চৌরাস্তা নয়, ঢাকার উপকণ্ঠে সবুজ শনে ঘেরা জনমানবহীন নিরিবিলি কোনো এক হাউজিং প্রজেক্টের চার-রাস্তার মাথায় তাদের দেখা হলো। অপ্রাসঙ্গিক গানের প্রাসঙ্গিকতা স্থাপনের কোনো চেষ্টাই করা হয় নি। বলিউড বা আমাদের দেশের সব রোমান্টিক গানই ফ্যান্টাসি হিসেবে চিত্রায়িত হয়। নায়ক বা নায়িকার কল্পনায় এগুলো ঘটে, ঘটার আগে নায়ক বা নায়িকার ফটোগ্রাফের ওপরে প্রায়ই জুম করা হয়। কিন্তু এই চলচ্চিত্রে একটা গান ব্যবহার করা হয়েছে অসম্ভব এক পরিস্থিতিতে, ফলে পুরো ব্যাপারটা অগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। আরিয়ান চাকরি খুইয়েছেন, এমনকি গ্রেফতার হয়েছেন অন্যায়ভাবে। অধরা গিয়ে দেখা করেন পুলিশের প্রধানের সঙ্গে। প্রতিবাদ করেন সবকিছুর। সবমিলিয়ে কাহিনীতে রীতিমতো এক ক্লাইমেক্স। ক্ষুব্ধ অধরা পুলিশ প্রধানের সঙ্গে হৈ চৈ করে বেরিয়ে এসে গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে বসেন। গাড়িতে রাখা প্রেমিক আরিয়ানের ছবির দিকে তাকান, তারপর শুরু হয় এক মহারোমান্টিক গান। এভাবে গানটি পরিস্থিতির সঙ্গে দারুণভাবে বেমানান লাগে।
অনন্ত জলিলের চলচ্চিত্রে স্পেশাল ইফেক্টের ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু এই চলচ্চিত্রে তা প্রয়োগেও তিনি ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষত গানগুলোতে যে ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে তিনি পেছনে হাঁটছেন। কোনো বিচিত্র কারণে প্রায় সবগুলো গানে তিনি স্বাভাবিক লোকেশন ব্যবহার না করে ভিন্ন একটি ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে নায়ক-নায়িকার মুভমেন্ট যুক্ত করেছেন। নায়ক ও নায়িকাকে ধারণ করা হয়েছে ক্লোজ বা মিড শটে, আর নির্বাচিত ব্যাকগ্রাউন্ড (যা অন্য কোনো স্থান থেকে কপি করা) শটগুলো এক্সট্রিম লং শটে ধারণ করা। ফলে ফোরগ্রাউন্ড ও ব্যাকগ্রাউন্ডের পারস্পেক্টিভ একেবারেই মেলেনি। ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে তখন যখন চরিত্রদ্বয়কে অন্য একটি ছবিতে স্থাপন করার কাজটি সূক্ষ্মভাবে করা হয় নি। ফলে ফোরগ্রাউন্ডের ফিগারগুলোকে আলগা লাগে, কাকের গায়ে ময়ূরপুচ্ছ যেমন বেমানান লাগে। দেশের ও দেশের বাইরের নানান লোকেশনে যাবার পরও এই কাণ্ডটা কেন করতে হলো কে জানে? অনন্তর যে টার্গেট অডিয়েন্স তারা ব্যাপারটা সহজেই ধরে ফেলতে পারবেন, এটা মাথায় রাখা দরকার ছিল।
বলতে হয়, স্পেশাল ইফেক্ট কিংবা কম্পিউটার গ্রাফিক্স ব্যবহারে পরিচালককে আরও সংহত হতে হবে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চিত্রধারণ ও সম্পাদনায় আরও দক্ষতা অর্জন করতে হবে তার টেকনিশিয়ানদের। কারণ অ্যাকশন দৃশ্যগুলো ধারণে ও পরিবেশনে আগের ছবির তুলনায় অবনমন ঘটেছে। একবার দেখা গেল মারামারির এক পর্যায়ে ভিলেনদের কেউ আরিয়ানের পোশাক টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। দেখা গেল, তার শার্টে হাত দিয়েছে ভিলেন, পরক্ষণেই আরিয়ানের উদোম শরীর। কিংবা হাজতে কেবল এক ছুরিতে ক্যামেরা ফোকাস করেই দায়িত্ব সারা হয়েছে, পরের শটেই বাঁধা হাত অবমুক্ত আরিয়ানের। হলিউড কিংবা বলিউডের ছবিতে এই বাঁধা হাতের দড়ি কেটে নিজেকে মুক্ত করার দৃশ্যটি দীর্ঘক্ষণ ধরে দেখানো হয়, বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য। জলপ্রপাতের ধারে পলায়নপর আরিয়ান ও অধরার সিকোয়েন্সটিতে সম্পাদনা যাচ্ছেতাই। কোনো কার্যকারণ ছাড়াই চরিত্রদ্বয়ের দৌড়ানোর দৃশ্য দেখানোর মাঝে মাঝে জলপ্রপাতকে দেখানো হয়েছে। আর নিহত ভিলেনরূপী পুলিশ অফিসার জলপ্রপাতে যে ভেসে গেল, দূর থেকে দেখা গেল একটা সবুজ রঙের শার্ট অনায়াসে ভেসে যাচ্ছে, ওর ভেতরে কোনো মানুষ আছে বলে মনে হলো না। আর এই সিকোয়েন্সটা কাহিনীর ভেতরে কীভাবে ঢুকলো বোঝা মুশিকল – সুপারহিরো নায়ক, দুর্বল লাস্যময়ী নায়িকাকে নিয়ে দৌড়াবে, তাদের তাড়া করবে প্রশিক্ষিত কুকুরদল, ভিলেনকূল – এ হলো অ্যাকশন ছবির ফর্মুলা সিকোয়েন্স। কিন্তু পরিচিত এই ফর্মুলা কাহিনীতে প্রবিষ্ট করতে পারম্পর্য তো চাই!
অনন্ত জলিলের কাছে প্রত্যাশা বেড়েছে দর্শকের। একহাতে তিনি চলচ্চিত্র কারখানা থেকে বিক্রয়যোগ্য অনেক পণ্য তৈরি করে চলেছেন। তার ব্র্যান্ডের প্রডাক্ট আরও ভালো চলবে যদি তিনি অ্যাকশন কমিয়ে কাহিনী ও চিত্রনাট্যে আরও মনোযোগ দেন।
লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক। চলচ্চিত্র সমালোচক।
মন্তব্য চালু নেই