এ অশ্রু বিরহের নয়, মিলনের

(ঠাকুরগাঁও) দুই পাশে জড়ো হয়েছে অনেক মানুষ। মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া। তারা সবাই একে অন্যের স্বজন। কিন্তু থাকেন দুই দেশে। বেড়ার একপাশে ভারত, অন্যপাশে বাংলাদেশ।

কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে কেউ কেউ আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখছেন স্বজনদের। কেউবা একে অপরের দিকে ছুড়ে মারছেন খাবারের প্যাকেট। পরিচিতজনদের দেখে কেউ হাসছেন, কেউবা চোখের অশ্রু ঝরাচ্ছেন। তবে সে অশ্রু বিরহের নয়, মিলনের।

শুক্রবার দুপুর ১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার ভাতুরিয়া সীমান্তে নাগর নদীর পাড়ে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বসেছে দুই বংলার মানুষের মিলনমেলা।

ধর্মপুর গ্রামের পান্না লাল রায় এসেছেন মেয়ে ও জামাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। শিলিগুড়িতে থাকা মেয়ে রিনা রানীকে ১১ বছর ধরে দেখেন না বাবা পান্না লাল। এবার এত ভিড়ের মধ্যে জামাই-মেয়ের মুখ অবশ্য দেখতে পারেননি তিনি। তাই উপায় না পেয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলেন তারা।

কাঠাঁলডাঙ্গী গ্রামের সাদেকুল তার ভাই সেরেকুল ইসলামকে দেখলেন পাঁচ বছর পর। ইচ্ছা ছিল বুকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু মাঝখানে যে কাঁটাতারের বেড়া!

উষা ও নিরলার ভাই বিশ্বনাথ থাকেন শিলিগুড়িতে। ভাইয়ের জন্য পিঠা এনেছেন। কথা হলেও নিজ হাতে তৈরি পিঠা ভাইকে দিতে পারেননি। তবুও দেখার আনন্দ নিয়ে বিদায় নিলেন তারা।

রানীশংকৈল উপজেলার বাচোর থেকে মাধবী রানী এসেছেন ভারতের কাকরমনি গ্রামে থাকা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। মায়ের সঙ্গে দেখা করার অনুভূতি জানাতে গিয়ে মাধবী বলেন, ‘বিয়ের পর এই প্রথম মাকে দেখলাম। তবে তেমন কথা হয়নি। অসুস্থ মাকে একনজর দেখে এলাম। এখন একটু ভালো লাগছে।’

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির তনজিনা এসেছেন হরিপুরে তার বোন তাসলিমা বেগমের সঙ্গে দেখা করতে। যখন দেখা হলো দু’জনের চোখে বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে এলো। তারপর ছেলে-মেয়ের বিষয়ে একে অন্যের খোঁজ খবর নিলেন তারা।

সীমান্ত এলাকার অধিবাসীরা জানান, বাংলাদেশ-ভারতের যেসব সাধারণ মানুষ অর্থাভাবে পাসপোর্ট-ভিসা করতে পারে না, তারা এ দিনটির অপেক্ষায় থাকে। এই দিনে তারা আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে।

এদিকে, সকাল থেকে দুই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজন এসে জড়ো হন ভাতুরিয়া সীমান্তে নাগর নদীর পাড়ে। দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকা স্বজনরা একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ভালোবাসা আর মমতায় মিলনমেলায় আবেগময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

স্থানীয়রা জানান, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর এদেশের অনেক আত্মীয়-স্বজন ভারতীয় অংশে পড়ে। ফলে অনেকেরই যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে তারা উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অলিখিত সম্মতিতে প্রতি বছর এই নাগর নদীর পাড়ে দেখা করার সুযোগ পান।

এ ব্যাপারে হরিপুর উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম জানান, হরিপুরের অধিকাংশ এলাকা পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির আগে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অধীনে ছিল। এ কারণে দেশ বিভাগের পর আত্মীয় স্বজনেরা দুই দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সারা বছর তাদের সঙ্গে দেখা হয় না। অপেক্ষা করতে হয় এই দিনটির জন্য।



মন্তব্য চালু নেই