এর পরও নিম্নমানের কাগজেই প্রাথমিকের বই!
প্রাথমিকের বইয়ের মান নিয়ে ইতিমধ্যে জল কম ঘোলা হয়নি। বই ছাপার কাজে বরাদ্দ অর্থের একটি অংশের জোগানদাতা বিশ্বব্যাংক মানের বিষয়ে সংশয় থেকে একবার বেঁকেও বসেছিল। পরে তাদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে ছাপার কাজ শুরু হয় প্রাথমিকের বইয়ের।
কিন্তু এত কিছুর পরও সেই নিম্নমানের কাগজেই ছাপা হচ্ছে বই। একই সঙ্গে সংশয় আছে ১ জানুয়ারির মধ্যে সারা দেশে বই পৌঁছানো নিয়ে। কেননা সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এখন পর্যন্ত বই ছাপার কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৩২ শতাংশ।
এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
সূত্র জানায়, ২০১৬ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তুরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের দায়িত্ব পায় ২২টি প্রতিষ্ঠান। বইয়ের মান শতভাগ সমুন্নত রাখার নির্দেশনা মানতে রাজি হয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোও কাজ শুরু করে। কিন্তু বই ছাপানোর পর দেখা যাচ্ছে, বইয়ের মলাট সুন্দর দেখালেও ভেতরের পাতা খুবই নিম্নমানের কাগজের। পাতায় পাতায় ভাঁজের সারি। বিভিন্ন ছবিতে রং ছড়ানো-ছিটানো।
প্রাথমিকের বই ছাপার জন্য আহূত দরপত্রে কাগজের মানের বিষয়ে বলা হয়েছে- প্রাথমিকের বইয়ে গ্রামস পার স্কয়ার মিটার-জিএসএম হবে ৮০ শতাংশ, ব্রাইটনেস হবে ৮০ শতাংশ, ভারজিন পালপ থাকবে ৭০ শতাংশ। এ ছাড়া আরও কিছু শর্ত ছিল। এসব চাহিদা পূরণ করে বই ছাপানো হলে মান খারাপ হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না বলে সূত্র জানায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির এক কর্মকর্তা বলেন, এখন যে বই ছাপা হচ্ছে সেগুলো এনসিটিবির শর্ত পূরণ করেনি। বইয়ে ৭০ শতাংশ ভারজিন পালপ দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। বরং পুরনো কাগজ রিসাইকেল করে সেগুলো দিয়ে বই ছাপানো হচ্ছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, বিস্ময়কর হলো, এই ধরনের কারসাজি প্রমাণ করার মতো যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে নেই। যেসব যন্ত্র আছে, সেগুলো রিসাইকেল করা কাগজ আর ভারজিন পালপে তৈরি কাগজের মান প্রভেদ করতে পারে না।
এ রকমই উদাহরণ দিয়ে একটি সূত্র জানায়, প্রাথমিকের বইয়ের মান দেখভালের জন্য দায়িত্ব দেয়া কন্টিনেন্টাল নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে। তারা বইয়ের মান যাচাই করে ইতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছে। কিছুদিন আগে প্রেস থেকে বইয়ের নমুনা নিয়ে তা অধিকতর যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) আর সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পাঠায় এনসিটিবি। তারাও প্রতিবেদন দিয়েছে ইতিবাচক। অথচ বিভিন্ন প্রেসে ছাপা বইয়ের মান সাদা চোখেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তক বিশেষজ্ঞ এক কর্মকর্তা বলেন, “এখন প্রেসে প্রাথমিকের যে বইগুলো ছাপা হচ্ছে, সেগুলোর স্থায়িত্ব হবে সর্বোচ্চ ৯০ দিন। এরপর এই বই পড়ার উপযোগী থাকবে না। শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর ৩০ দিন পর যদি বইযের পাতায় কয়েক ফোঁটা পানি পড়ে, তাহলে ওই পাতা ছিঁড়ে যেতে পারে।”
এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে ওই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ হলো, সরকারের উচিত হবে বই ছাপার পর প্রেস মালিকদের পুরো টাকা পরিশোধ না করে একটা অংশ ‘গ্যারান্টি মানি’ হিসেবে রেখে দেয়া। ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক উৎসবের পর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে বইয়ের নমুনা সংগ্রহ করে তার মান যাচাইয়ের পর বাকি অংশ পরিশোধ করা যেতে পারে।
ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ভারতের কলকাতায় জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্টিং টেকনোলজি ইনস্টিটিউট থেকে এই পরীক্ষা করানো যায়। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ও কোটি কোটি টাকা গচ্ছা থেকে রক্ষা পাবে।
এই ‘মানের’ প্রশ্নেই প্রকল্পের শুরুতে প্রাথমিকের পাঠ্যবই মুদ্রণ নিয়ে মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান, বিশ্বব্যাংক ও এনসিটিবির মধ্যে ত্রিমুখী সংকট তৈরি হয়েছিল। দরপত্রের শর্তের বাইরেও বিশ্বব্যাংক নতুন করে পাঁচটি শর্ত দিয়েছিল। এর মধ্যে ছিল মুদ্রণ শেষে বইয়ের গুণগত মান নিশ্চিত হওয়ার পর বিল পরিশোধ, বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব তদারকি টিম যেকোনো সময় যেকোনা জায়গায় গিয়ে বইয়ের মান যাচাইয়ের করতে পারবেন এমন সুযোগ রাখা। মুদ্রণকারীরা এ শর্তের বিরোধিতা করে বলেছিল, বিশ্বব্যাংক নয়, এনসিটিবিই বইয়ের মান যাচাই করবে।
এসব ঘটনার মধ্যে শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপে গত ৩১ অক্টোবর এক বৈঠকে সবাই যথাসময়ে বই ছাপা ও মানসম্মত বইয়ের ব্যাপারে একমত হয়। একই সঙ্গে মানসম্মত বই দেওয়ার ব্যাপারে পরিদর্শন বাড়ানো এবং মুদ্রণকারীদের অঙ্গীকারের বিষয়টিও বৈঠকে অবহিত করা হয়।
দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বই ছাপার কাজ শেষ করার কথা। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রাথমিকের বই ছাপা হযেছে মাত্র ৩২ শতাংশ। তাই নির্ধারিত সময়ে সারা দেশে বই পৌঁছাবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক মোস্তাক আহমেদ ভুঁইয়া বলেন, “আমরা বইয়ের মান সমুন্নত রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের মান নিয়ন্ত্রক কমিটি কাজ করছে। বুয়েট ও সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে বইয়ের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। তারা ইতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে মোস্তাক আহমেদ ভুঁইয়া বলেন, “ছাপানো বইয়ের পাতা দেখলে মনে হয় মান ভালো নয়। কিন্তু পরীক্ষাগার থেকে রিপোর্ট আসছে মান ঠিক আছে।”
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র পাল বলেন, “আমরা বইযের মান ঠিক রাখতে বদ্ধপরিকর। এখন আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ বইগুলো সঠিকভাবে ছাপা হওয়ার পর সারা দেশে পৌঁছানো। এরপর আমরা কাগজের মান নিয়ে বসব। প্রয়োজনে বিদেশে এর নমুনা পরীক্ষা করা হবে। কোনো সমস্যা পেলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যভস্থা নিয়ো হবে।”
প্রাথমিকের বই ছাপার জন্য প্রাক্কলন বাজেট ছিল ২৯২ কোটি টাকা। কিন্তু আন্তর্জাতিক দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ১৯৮ কোটি টাকায় কাজ পায় দেশীয় সব প্রতিষ্ঠান। প্রাক্কলিত বাজেটের চেয়ে ৯৪ কোটি টাকা কম মূল্যে কাজ হচ্ছে বলে মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে বই ছাপার কাজে সাড়ে ৯ শতাংশ ঋণ দেয়া বিশ্বব্যাংক। তারা প্রথমে দরপত্র বাতিল করে নতুন করে দরপত্র আহ্বানের প্রস্তাব করে। কিন্তু প্রক্রিয়া শেষ করতে অনেক সময় লাগবে্- এনসিটিবির পক্ষ থেকে এমনটি জানালে তারা নতুন করে কয়েকটি শর্ত দেয়।
শর্তে উল্লেখ রয়েছে, বই ছাপার বিষয়ে তারা সন্তুষ্ট না হলে এবং সম্মতি না দিলে বিল পরিশোধ করা যাবে না। এ জন্য বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব দল বই ছাপাপূর্ব, ছাপাকালীন এবং ছাপা-পরবর্তী পরিদর্শন, তদারকি, দেখভাল এবং তদন্ত করবে। এর অংশ হিসেবে বই ছাপার আগে কাগজের নমুনা, ছাপার নমুনা এবং বই বাঁধাইয়ের পর বইয়ের নমুনা তাদের কাছে পাঠাতে হবে। ছাপার সময় তাদের টিম আকস্মিক যেকোনো প্রেস পরিদর্শন করতে পারবে। এ ছাড়া প্রেস মালিকদের জামানত বিদ্যমান ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার শর্ত দেয়া হয়।
এসব শর্ত পালন করা হলে প্রাথমিকের বইয়ের মান খারাপ হওয়ার সুযোগ থাকত না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।ঢাকাটাইমস
মন্তব্য চালু নেই