এমন দিন কখনো আসেনি আগে !
স্বপ্নের একটা দিন কেমন হয়?
উত্তরটা খুব সহজ। খুলনা টেস্টের চতুর্থ দিনটির মতো!
রঞ্জির ব্যাটিং নিয়ে নেভিল কার্ডাস লিখেছিলেন, ‘আসলেই কি আমরা তাঁর ব্যাটিং দেখেছি? নাকি পুরোটাই ছিল মধ্যদুপুরের মায়াবী বিভ্রম!’
এই লেখা লিখতে বসেও একই রকম মনে হচ্ছে। যা দেখেছি, আসলেই কি তা সত্যি? নাকি তামিম ইকবাল আর ইমরুল কায়েসের ওই ব্যাটিং ‘মধ্যদুপুরের মায়াবী বিভ্রম’?
শুধু মধ্যদুপুর বললেই তো এখানে চলছে না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, একটু স্তিমিত বৈশাখের খরতাপ। কিন্তু দুই বাঁহাতি ওপেনারের ব্যাটে একই রকম রুদ্র নাচন। সেই ব্যাট যেন খাপখোলা তলোয়ার। যা থেকে টুপটাপ রক্ত ঝরছে বোলারদের। না, টেস্ট ক্রিকেটে এমন কিছু আর দেখেনি বাংলাদেশ!
ক্লান্তি মুছে তৃপ্তির হাসি। ওপেনারেরই সেঞ্চুরি এর আগেও দেখেছে। ঠিক আগের টেস্টটিতেই। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চট্টগ্রামেও এই তামিম-ইমরুলই। ধেৎ, কোনো তুলনাই চলে না। বোলিংয়ে নয়, ম্যাচের পরিস্থিতিতেও না।
সকালে মাত্র ৩৪ রানে তুলে নেওয়া গেছে পাকিস্তানের শেষ ৫ উইকেট। তাতে কী! তার পরও তো ‘নিয়ম’ অনুযায়ী এই টেস্টের বড়জোর পঞ্চম দিনের চা বিরতি পর্যন্ত আয়ু পাওয়ার কথা। ওয়াহাব রিয়াজ-ইয়াসির শাহরা দারুণ বোলার। এখানে যে আসল ‘বোলার’ তাঁদের চেয়েও বড়—প্রথম ইনিংসে ২৯৬ রানের ঘাটতি।
সামনে পড়ে আছে পাঁচ সেশনেরও বেশি। চতুর্থ ও পঞ্চম দিনের উইকেট আঁকড়ে পড়ে থাকার মতো ব্যাটসম্যান কই বাংলাদেশ দলে? আঁকড়েই থাকতে হবে, কে বলেছে! এটিই যে টেস্ট বাঁচানোর একমাত্র উপায় নয়, তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েস নামলেনই যেন তা বুঝিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। যে ‘নিয়ম’-এর কথা বলছিলাম, সেটি বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাস থেকেই উদ্ভূত। ‘অনিয়মে’র পথে হেঁটেই সেই ‘নিয়ম’কে উড়িয়ে দিলেন তামিম-ইমরুল।
এমনভাবেই যে, মুঠোফোনে বিস্ময়াভূত এক কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘মাই গড! এ কী দেখছি! বাংলাদেশের এই রকম ব্যাটিং জীবনে দেখি নাই।’ বক্তাও ‘যৎসামান্য’ ক্রিকেট খেলেছেন। একটা সময় টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ছিলেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিটাও তাঁর ব্যাট থেকেই এসেছে। নাম হাবিবুল বাশার। যিনি সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমান নির্বাচক থেকে আপ্লুত দর্শকে পরিণত!
টেস্ট ম্যাচের টিকিট নিয়ে খুলনায় যে কাড়াকাড়ি, সেটির তুলনা বর্তমান ক্রিকেট বিশ্বে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ দিন আবার মে দিবসের ছুটি। স্টেডিয়াম তাই লোকে লোকারণ্য। বাকি জীবন গল্প করার রসদ পেয়ে গেলেন তাঁরা। অবিচ্ছিন্ন উদ্বোধনী জুটিতে ২৭৩ রানই অনেক কিছু বলে। এত বছর ধরে টেস্ট ক্রিকেট হচ্ছে, ইনিংসের শুরুতে এর চেয়ে বেশি রানের জুটি মাত্র ২১টি। যেকোনো উইকেটেই বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ডও হয়ে গেছে এরই মধ্যে। এ সব বলেও আসলে কিছুই বলা হচ্ছে না।
এভাবেই মিলল হাতে হাত! প্রতি প্রায় সাড়ে চার গড়ে ওই ২৭৩ রান। ক্রিকেট বইয়ে যত শট আছে, তার একটা প্রদর্শনীই যেন হয়ে গেল। ইচ্ছামতো ছক্কা মারছেন, ইচ্ছামতো রিভার্স সুইপও। কখনো কখনো ভয়ও হচ্ছিল, একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে কি না! গত নভেম্বরে এই খুলনাতেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তামিমের ঠুকঠুক ব্যাটিং দেখে আক্ষেপে ভরা একটা লেখা লিখেছিলাম—কোথায় হারাল সেই তামিম! হারিয়ে যাওয়া সেই তামিমই ফিরে এলেন কাল। যে দর্প তাঁর ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে বড় অলংকার, সেটিরই অপরূপ প্রকাশ এ দিনের তামিম।
ইমরুলই বা কম গেলেন কোথায়! মুশফিকুর চোট পেয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় প্রায় দেড় দিন কিপিং করতে হয়েছে। শুধুই বোলিংই নয়, লড়তে হয়েছে সেই ক্লান্তির সঙ্গেও। তামিম তামিমের মতো খেললে অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যানের আবছা হয়ে যাওয়াই নিয়তি। এই ‘নিয়ম’ও ভেঙে খানখান। দিন শেষে দেখা যাচ্ছে, স্ট্রাইক রেটে তামিমের চেয়ে ইমরুল সামান্যই পিছিয়ে। তামিম একটি ছক্কা বেশি মেরেছেন, ইমরুল আবার চার মেরেছেন ৩টি বেশি।
স্ট্রাইক রেট, চার-ছয় নিয়ে এত কথা বলছি, এটা তো টেস্ট ম্যাচ, না কি? ওই দুজনের রুদ্ররূপই শুধু নয়, এটা টেস্ট ম্যাচ কি না, এই সংশয় জাগাচ্ছিল পাকিস্তানের ফিল্ড প্লেসিংও। বাউন্ডারি লাইনে পাঁচজন। মিসবাহ-উল-হককে রীতিমতো উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে। পাকিস্তান অধিনায়কও যেন মধ্যদুপুরের মায়াবী বিভ্রম দেখছেন!
টেস্টে চতুর্থ দিনের উইকেট যেমন হওয়ার কথা, খুলনার উইকেট মোটেই তেমন নয়। লাইনটা লিখেই মনে হচ্ছে, যতটা ভালো মনে হলো, আসলেই কি উইকেট ব্যাটিংয়ের জন্য এতটা ভালো? নাকি তামিম আর ইমরুলের কারণেই মনে হচ্ছে এমন! ২৮টি চার ও ৭টি ছয় যেমন বোঝাচ্ছে, বোলিং কি আসলেই ওরকম ছিল? মোটেই না। ওয়াহাব রিয়াজ দুর্দান্ত বোলিং করেছেন। তাঁর শেষ দুই স্পেল তো রিভার্স সুইংয়ের অনুপম প্রদর্শনী। বাউন্সারগুলোও ফণা তুলেছে সাপের মতো।
উইকেটে ভালোই টার্ন আছে এবং পাকিস্তান দলে এমন এক লেগ স্পিনার আছেন, যাঁকে প্রথম দেখে শেন ওয়ার্ন পর্যন্ত উচ্ছ্বাসভরা টুইট না করে পারেননি। তামিম-ইমরুলের যুগল তাণ্ডবে সেই ইয়াসির শাহও এ দিন যেন গলির বোলার!
না, উইকেটে মাথা গুঁজে পড়ে থেকে এই বোলিংয়ে পার পাওয়া যেত না। শুধু ব্যাটিংয়ের জন্যই নয়, আক্রমণই যে এখানে সেরা প্রতিরোধ—এই বিশ্বাসের জন্যও দুই ওপেনারের হাততালি প্রাপ্য। ওভাবে খেলেছেন বলেই তো পঞ্চম দিনে মাঠে নামার সময় শুধু উইকেট তুলে নেওয়া নয়, রান আটকানোর কথাও ভাবতে হবে মিসবাহকে। চাইলেই ব্যাটসম্যানকে ঘিরে ফিল্ডারের ছাতা বানিয়ে রাখতে পারবেন না।
টেস্ট ম্যাচ রঙ বদলায়। একটা সেশনই ভোজবাজির মতো বদলে দিতে পারে ম্যাচের গতিপথ। এই টেস্ট শেষ দিনের জন্য কী পাণ্ডুলিপি লিখে রেখেছে, কে জানে! বাংলাদেশ এখনো ২৩ রানে পিছিয়ে। কাজ এখনো অনেক বাকি। দিনের প্রথম ঘণ্টাটাই হয়তো বলে দেবে, ‘পথের শেষ কোথায়, কী আছে শেষে! ’
যা-ই থাকুক না কেন, তাতে থোড়াই কেয়ার! সকালে বোলিং আর দুপুর-বিকেলে দুঃসাহসী সুন্দর তামিম-ইমরুল মিলিয়ে এটি টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সুন্দরতম দিন।
না, এমন দিন কখনো আসেনি আগে!
মন্তব্য চালু নেই