এটিই বিশ্বের একমাত্র শহর, যেখানকার মানুষ জানেনই না টাকাপয়সা কী জিনিস!
এ এক অভিনব শহর, যেখানে কার্যত টাকাপয়সার কোনও প্রচলনই নেই। কোথায় রয়েছে এমন আজব শহর, কীভাবেই বা চলে সেই শহরের বাসিন্দাদের জীবন? জেনে নিন, সেই আশ্চর্য শহরের উপাখ্যান।
গত ৮ নভেম্বর ভারতে নোটবাতিল ঘোষণার পরে সরকার জোর দিচ্ছে ক্যাশলেস ইকনমির উপর, অর্থাৎ এমন এক অর্থব্যবস্থা যেখানে আর্থিক লেনদেন হবে নগদ টাকা ছাড়াই। সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ই বলবে। কিন্তু শুনে অবাক লাগতে পারে যে, ভারতের বুকেই ১৯৬৮ সাল থেকে এমন এক শহর রয়েছে, যেখানে কার্যত নগদ টাকার কোনও মূল্যই নেই। কারণ ব্যাপকতর অর্থে, এই শহরে টাকাপয়সা ব্যবহারই হয় না।
তামিলনাড়ুতে চেন্নাই থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শহর অরোভিল। ১৯৬৮ সালে ইউনেস্কোর সহযোগিতায় শ্রী অরবিন্দ সোসাইটির ‘মা’ মীরা আলফানসা এই শহর প্রতিষ্ঠা করেন। রজার অ্যাঙ্গার নামের এক ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট এই শহরের পরিকল্পনা করেছিলেন। ব্রহ্মাণ্ডের গঠনকে মাথায় রেখে সেই ধাঁচে এই শহরকে গড়ে তোলেন অ্যাঙ্গার, এবং শহরের মাঝখানে স্থাপন করেন একটি মাতৃমন্দির। বর্তমানে এই মাতৃমন্দিরে শহরের মানুষজন সমবেত হন ধ্যান করার জন্য। ১৯৬৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অরোভিলের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে ১২৪টি দেশের প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন।
বর্তমানে এই শহরের জনসংখ্যা আড়াই হাজারের কাছাকাছি। ৪২টি দেশের বাসিন্দারা এখানে মিলেমিশে বসবাস করেন। এঁদের মধ্যে ৩০ শতাংশ ভারতীয়। সুযোগ-সুবিধার বিচারে পৃথিবীর বহু বড়ো শহরকেই টেক্কা দিতে পারে অরোভিল। এখানে স্কুল, হাসপাতাল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আধুনিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় পরিষেবা মজুত রয়েছে। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র নিয়মনীতি মেনে পরিচালিত হয় এই শহর, যার ফলে অরোভিলে টাকাপয়সার কোনও প্রচলনই নেই।
কিন্তু তাহলে কীভাবে চলে অরোভিলের বাসিন্দাদের জীবন? আসলে ‘সেবার বদলে সেবা’ নীতি অনুসরণ করে এই শহর, যা আদপে প্রাচীন বিনিময় প্রথারই একটি আধুনিক সংস্করণ। এখানে থাকা, খাওয়ার জন্য কোনও পয়সাই লাগে না। বরং নিজের সাধ্যমতো ‘সেবা’ দিয়ে প্রত্যেকে শহরের উন্নয়নে নিজস্ব অবদান রাখেন। ‘সেবা’ বলতে মূলত তেল, সাবান, ধূপকাঠি তৈরি-সহ অন্যান্য কুটির শিল্পে হাত লাগানো। এইভাবে উৎপাদিত দ্রব্য অরোভিল ফাউন্ডেশন দেশের অন্যান্য অংশে বিক্রির বন্দোবস্ত করে। সেই থেকে যা আয় হয়, তা শহরের বাসিন্দাদের জীবন নির্বাহ, এবং শহরের উন্নয়নে কাজে লাগানো হয়। নিজেদের শ্রমের বিনিময়ে অরোভিল ফাউন্ডেশনের তরফে সামান্য কিছু বেতনও পান নাগরিকরা। কিন্তু সেই উপার্জিত অর্থ অরোভিলের চৌহদ্দির মধ্যে খরচ করার প্রয়োজন পড়ে না কখনও। ভারত সরকারও এই শহরকে এবং এর অভিনব অর্থব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রয়োজনমতো অরোভিল ফাউন্ডেশনকে আর্থিক সাহায্যও করা হয় সরকারের তরফে।
১৯৮৫-৮৬ সালে অরোভিলে একটি ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস সেন্টার(এফএফএস) প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের যে মর্যাদা, অরোভিলে এফএফএস-এরও সেই মর্যাদা এবং ভূমিকা। এখানকার বাসিন্দারা নিজেদের অর্থ অনলাইন এবং অফলাইন পদ্ধতিতে এই ব্যাঙ্কে জমা করার সুযোগ পান। ব্যাঙ্ক তার পরিবর্তে গ্রাহককে একটি অ্যাকাউন্ট নম্বর দেয়। অরোভিলের অন্তর্গত প্রায় ২০০টি কমার্শিয়াল সেন্টারে এবং ছোট-বড়ো অন্যান্য দোকানে এই অ্যাকাউন্ট নম্বরের মাধ্যমেই বিকিকিনি চলে। নগদ লেনদেনের প্রয়োজনই হয় না।
প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অরোভিলে ঘুরতে আসা পর্যটকরা নামমাত্র মূল্যে এখানে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পান। এখানে আগত অতিথি ও স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে তুলে দেওয়া হয় একটি বিশেষ ‘অরো কার্ড’, অরোভিলের চৌহদ্দিতে যে কার্ড আদপে ডেবিট কার্ডের সমতুল। এই কার্ডের মাধ্যমেই অরোভিলে যাবতীয় কেনাকাটা করতে পারেন মানুষজন।
দেশের মধ্যেই এক অভিনব ও বিকল্প অর্থব্যবস্থা চালিয়ে দিব্যি রয়েছে অরোভিল। আগামী দিনে ক্যাশলেস ইকনমির লক্ষ্যে এই শহরই হয়তো হয়ে উঠবে সারা দেশের আদর্শ। -এবেলা।
মন্তব্য চালু নেই