একজন স্বাধীনতাকামী কবি কার্টুনিস্ট শেখ তোফাজ্জেল হোসেন ও কিছু কথা
‘আকাশ আছে সন্ধ্যা আছে/ নদীর জলে সবুজ’ খুঁজে ফেরেন যে মানুষ, সে আমাদের তোফা ভাই। কার্টুন জগতে তিনি তোফা নামে সর্বাধিক পরিচিত। পুরো নাম শেখ তোফাজ্জেল হোসেন। লেখালেখি শুরু তাঁর ষাটের দশকে। তিনি ছোট বেলা থেকেই স্বাধীন চেতা। পাকিস্তানী শোষনের চিত্র তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। আবেগ আর পরাধীনতার বিরুদ্ধে তার মন সব সময় কেঁদেছে। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানী শোষণের বিরুদ্ধে কার্টুন এঁকে দীর্ঘদিন কারা জীবন ভোগ করেন। অন্ধকারকে সেই প্রথম দেখা। তারপর থেকে মুক্ত আলোয় যতো লিখেছেন, প্রকাশনা প্রচারনায় নীরব থেকেছেন তার চেয়ে বেশি। ফলে পাঠক মহলে এক ধরনের ধীর-পরিচিতির সিড়ি বেয়ে এতোদুর আসা। তিনি লিখেছেন অসংখ্য ছড়া, কবিতা, কার্টুন বই, গদ্যসহ অনেক প্রবন্ধ।
শেখ তোফাজ্জেল হোসেনের পিতা শেখ শমসের আলী আসামের মরিরানী শহরে ব্যবসা করতেন। মা সারা খাতুনও সেখানে থাকতেন। ওখানেই তার জন্ম। পিতার বাড়ী রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের চরদক্ষিণবাড়ী গ্রামে। নানাবাড়ী বালিয়াকান্দি ইউনিয়নের শালমারা গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা শালমারা ভবন আমিন বাজার ঢাকা। শৈশবে অসমিয়া ভাষায় কথা বলতে হতো। অসমিয়া স্কুলে পড়তেন।
১৯৫৮ সালে বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের মধুপুর প্রি প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হন। ফাইভে বৃত্তি পান। নারুয়া হাই স্কুল থেকে বালিয়াকান্দি স্কুলে নবম শ্রেনীতে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে এস,এস,সি পাশ করেন এবং ঢাকায় যান। তিনি শৈশব থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। কবিতা, ছড়া লিখতেন।
১৯৬২ সালে প্রথম লেখা কবিতা সিলেটের আল ইসলাহ পত্রিকায় ছাপা হয়। তারপর বহু দৈনিক ও মাসিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ১৯৭৪ সালে বিএ পাশ করেন। তারপর আর লেখাপড়া হয়নি। আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও আর হয়ে ওঠেনি। নিজের চেষ্টা ও কার্টুনিস্ট আবুল কাশেমের অনুপ্রেরনায় কার্টুনিস্ট হয়ে উঠা। ১৯৬৮ সালে আর্তনাদ (শহীদ দিবসের একমাত্র) সংকলনে শোষন বিরোধী কার্টুন আকেন। গরু ঘাস খাচ্ছে পুর্ব পাকিস্তানে, দুধ যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। আরো কার্টুন ছিল। আর্তনাদ বাজেয়াপ্ত হয়। তাকে কেন্দ্রিয় কারাগারে পাঠানো হয়। তখন তিনি আল্লামা আবুল হাশিমের ব্যাক্তিগত সহকারী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে আটক।
গণ আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী কারাগার থেকে মুক্ত হন। তাকে ১১ মাস কারাগারে কাটাতে হয়। তখন মাওলানা ভাসানী সন্তোষ্ট হয়ে তাকে ও কবি জসিম উদ্দিনকে ঢাকায় সংবর্ধনা দেন। তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব আদর করতেন। আবুল হাশিম তাকে চাকুরীতে ফিরিয়ে নেন। ৪০ বছর চাকুরী করার পর ২০০৭ সালে অবসর গ্রহন করেন। ১৯৮৭ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ বেতার নিয়মিত খবর পাঠ করেছেন। টিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, অংশগ্রহন ও নিজেই কবিতা আবৃতি করেছেন। চাকরীর পাশাপাশি তিনি ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন দৈনিকে ও হলিডে দেশবাংলা প্রভৃতি সাপ্তাহিক পত্রিকায় কার্টুন একেছেন। ছাপা কার্টুনের সংখ্যা ৫ সহ¯্রাধিক। শেষ কার্টুন একেছেন দৈনিক আমাদের সময়ে। বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।
তিনি লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতায়ও অনেক অবদান রেখেছেন। মাসিক সবুজ পাতা পত্রিকায় সম্পাদক ১২ বছর ও মাসিক অগ্রপথিক এ ৬ বছর সম্পাদক ছিলেন। নিজের সম্পাদনায় অমনিবাস, অনুশিলন ও উত্তরকাল, নামে কতিপয় সাহিত্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। কবি জসিম উদ্দিনের সাহিত্য সাধনা সংঘে তিনি জড়িত ছিলেন। ১৯৭৪ সালে অনুশীলন সংঘ করতেন। টানা ৯বছর সাপ্তাহিক সাহিত্য সভা করেছেন। সেই সব সভা থেকে অনেক গুনিজন বেরিয়েছে। আজ তারা প্রতিষ্ঠিত, বিভিন্ন পুরস্কার প্রাপ্ত কবি, সাহিত্যিক। খালেক বিন জয়েনউদ্দিন, আমিরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান রিটন, আবু সালেহ, ফরিদুর রেজা সাগর, মইনুস সুলতান তাদের মধ্যে অন্যতম। বই-পত্রপত্রিকায় ছবি আকতেন এখনও আকেন।
তিনি ছড়া, কবিতা লিখেছেন বিস্তর, কিন্তু সেই তুলনায় প্রকাশ পেয়েছে কম। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও কম। কবিতার বই ১টা, ছড়ার বই ৩টা, সংকলন ২টা, বিভিন্ন ভাবে প্রকাশিত গদ্য-পদ্যের সংখ্যা প্রায় ৩শতাধিক। প্রকাশিত হয়েছে ৬-৭টি গ্রন্থ। ২০০৫ সালে জিবিএস হয়েছিল তার কারণে অসুস্থ। বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ও হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হয়। এখনও গদ্যচর্চা করছেন।
এক সময় বেতারের উত্তরন ম্যাগাজিন পর্বে তার ধারাবাহিক রম্য কাহিনী “দুবাই মিয়ার কড়চা ”ও রম্য কথা প্রায় ৪বছর চলেছিল। তৃতীয় পক্ষ নামে একটি রম্য কলাম একটা দৈনিকে প্রকাশ পেয়েছিল। বর্তমানে জরাগ্রস্থ জীবনে প্রায় কিছুই করতে পারছেন না। কর্মহীন ধৈর্যহীন জীবনে সামনে গুছিয়ে নেয়াই কষ্টকর। তিনি কবিতার জন্য ২০১১ সালে কবি মনির উদ্দিন সাহিত্য পুরস্কার পান। তার ২ মেয়ে একজন ডাক্তার অন্যজন বৈশাখী টেলিভিশনে সাংবাদিকতা করেন। ঢাকার আমিনবাজারের শালমারা ভবনে এখন একাকীত্ব জীবন কাটাতে হচ্ছে।
লেখক : সোহেল রানা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মন্তব্য চালু নেই