একজন সাহসী মেয়ের দুঃসাহসিক গল্প

সে নিরস্ত্র মেয়ে ছিল। তবুও বন্দুকধারীরা তাকে ভয় পেত। কারণ সে বন্দুকের প্রতিবাদ করত মুখের ভাষায়। এ প্রতিবাদের জন্য তিনি কোনো সৈন্যবাহিনীও গড়ে তুলেনি। শুধুমাত্র একটি গুশা আমান (শান্তির নীড়) বানিয়ে সেখানে ভালবাসার মানুষদের নিয়ে সংলাপে বসত।

আর তিনি এমন এক শহরে এ সাহসিকতা দেখিয়েছে যে শহরে যে কাউকে যে কোনো মুহূর্তে বন্দুকের টার্গেট বানিয়ে ফেলা হয়। আর মামলা হয়ে যায় আত্মায়ীদের নামে। আত্মায়ীরা তাকে একটি চিঠি পাঠায়। চিঠির ভেতর গুলিও ছিল। চিঠির ভাষা ছিল স্পষ্ট। চিঠিতে বলা হয়েছে, আমাদের বিরোধিতা বন্ধ করো। না হয় এ গুলি তোমাকে চিরনিদ্রায় পাঠিয়ে দিবে। এটা এমন এক সমাজ যেখানে ঘৃণার ভাষাও গুলি দ্বারা করা হয় আবার আনন্দের প্রকাশও গুলি চালিয়ে করা হয়।

একদিন সন্ধায় আত্মীয়রা মাত্র একটি গুলি নয়, কয়েকটি গুলি ওই নিরস্ত্র বালিকার শরীরে ঢুকিয়ে দেয়। তাকে চির নিদ্রায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু তার আওয়াজ বিলীন হয়ে যায়নি। হত্যার পরপরই সারা বিশ্বে তার আওয়াজ ছড়িয়ে পরে। আওয়াজ আসতে থাকে হত্যাকারীরা অজ্ঞাত নয়, সকলের জানা। তাদের নাম কেউ কেন মুখে নেয় না?

মেয়েটার নাম সাবিন মেহমুদ। ২৪ এপ্রিল সন্ধায় করাচিতে আত্মীয়দের গুলিতে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়। জানা যায়, সাবিন মেহমুদ তার কফি হাউসে মামা কাদির আব্দুল্লাহ ও ফারজানা মাজিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিল। বৈঠক শেষে মায়ের সঙ্গে বাসায় ফিরছিলো সাবিন। পথে অজ্ঞাত মোটরসাইকেল আরোহীরা তাকে গুলি করে। মারা যায় সাবিন। আহত হয় তার মা।

এর আগে পেশোয়ারের একটি চার্চে হামলা হয়। তখন তিনি ইসলামাবাদে আসে। তার বন্ধুদের জড়ো করে ইসলাবাদের একটি চার্চের বাহিরে হাতে হাত রেখে তার বন্ধুদের নিয়ে মানববন্ধন করে। সাবিন পাকিস্তানের খৃৃষ্টানদের এ বার্তা দিয়েছিলেন, দু:খ-দুর্দশার এ ঘরে যেন তারা নিজেদের একা না ভাবে।

সাবিন মেহমুদ ছিলো একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তার মা একজন স্কুল শিক্ষিকা। সাবিন মেহমুদ করাচির একটি স্কুলেই পড়তেন। পড়াশোনার পর একটি কম্পিউটার কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন। কিন্তু বিচ্ছিন্নবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন সাবিন। নিজের দেশকে পরিবর্তনের বাসনা ছিল প্রবল। নিজের মাতৃভূমিকে নিরাপদ শহরে পরিণত করতে চেয়েছিলেন তিনি। এ জন্য একটি গুশা আমান (শান্তির নীড়) গড়ার সিদ্ধান্ত নেন।

তার মামা নানির জন্য ঔষধ-পত্রের খরচের জন্য বিদেশ থেকে কিছু টাকা পাঠাতেন। সেখানে থেকে সাবিন কিছু পয়সা নিয়েছিলেন। কিছু ধার করে আর কিছু বন্ধুদের সহযোগিতায় করাচির একটি মার্কেটের সেকন্ড ফ্লোরে কফি হাউস খুলেন। কফি হাউসের ভিতর একটি বুক স্টোর ও আর্ট গ্যালারিও বানান। এই আর্ট গ্যালারিকে কখানো সখনো থিয়েটারের কাজে ব্যবহার করা হয়। ‘সেকেন্ড ফ্লোর’ নামে প্রসিদ্ধ এ কফি হাউসে শহরের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা আড্ডা দিত। যদি কোনো গরিব যুবক সাবিন মেহমুদকে বলত এ বইটি কিনার মতো পয়সা নেই, সাবিন তাকে বইটি দিয়ে বলত পড়ে ফেরত দিয়ে যেও। এ কফি হাউসে কবিরা কবিতা আবৃতি করে আর অভিনেতারা কমেডির মাধ্যমে লোকদের হাসাতেন। এ কফি হাউস হয়ে উঠেছিল কবি, শিল্পী ও রাজনৈতিকদের সংলাপস্থল।

সাবিন মোহমুদ এ কফি হাউসকে ব্যবসার জন্য নয় বরং শান্তি ভালবাসার বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য গড়ে তুলেছিলেন। যে কথা কোথাও বলা যেত না সে কথা গুশা আমানে (শান্তির নীড়) বলা যেত। যে কারণে সংলাপকারীদের শত্রুরা সাবিন মোহমুদেরও শত্রু হয়ে গিয়েছিল। কামেলা শামছি সাবিন মেহমুদকে বলেন, সতর্কতা অবলম্বন করো। উত্তরে সাবিন বলেছিল, শেষ পর্যন্ত তো কাউকে না কাউকে লড়তে হবে। সে লড়াইয়ের সঙ্গে সাবিনের হাতিয়ারটাও একটু সাহসিকতা ও হাস্যকৌতুকের সঙ্গে বেঁচে থাকুক। তার ভাল বই পড়া ও পড়ানো, হাস্যকৌতুক করা ও করানো, ভাল কথা শোনা ও ভাল কথা শোনাতে আগ্রহ ছিল।

তবে কারো জানা নেই সাবিন মেহমুদের হত্যাকারীরা গ্রেফতার হবে কি না? কিন্তু এ সময়টা তার গুসা আমান (শান্তির নীড়) বাঁচানোর সময়। তাহলে সংলাপ বেঁচে থাকবে। সংলাপ বেঁচে থাকলে সাবিন মেহমুদ বেঁচে থাকবে। আর সাবিন মেহমুদ বেঁচে থাকলেই হত্যকারীদের পরাজয় হবে।



মন্তব্য চালু নেই