একজন রোজাদারের গুণাবলী

সিয়াম সাধনার মাস রমজানুল মোবারকের রহমতের দশকের আজ শেষ দিন। আগামীকাল থেকে শুরু হবে মাগফিরাত বা ক্ষমার দশক। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সবসময় বান্দার প্রতি করুণাসিক্ত। কিন্তু রহমতের দশ দিনে আল্লাহ তার রোজাদার বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন। আর সব সময় তিনি বান্দার গুনাহ মাফ করলেও মাগফিরাতের দশকে তার ক্ষমা অবারিতভাবে দুনিয়াবাসীর প্রতি বর্ষিত হয়।

হাদিসে এসেছে, আমাদের মহান আল্লাহ তায়ালা যত বিধি-বিধান আমাদের দান করেছেন, তা সবই আমাদের সার্বিক কল্যাণের জন্য। যদিও অনেক সময় আমাদের অতি সামান্য জ্ঞানের দ্বারা তা সম্যক উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই। যেমন মাহে রমজানে সিয়াম পালন করা ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ নির্দেশ প্রদান করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)

কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, শুধু কাফির নয়, অসংখ্য মুসলমানের হৃদয়েও রয়েছে এ সিয়ামের লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয়। সে কারণেই দেখা যায়, অসংখ্য মুসলমান কোনো শরিয়তি ওজর ছাড়াই দ্বিধাহীনচিত্তে সিয়াম ত্যাগ করছে। মুষ্টিমেয় যারা এ সিয়াম বা রোজা পালন করেন, তাদের অনেকেই আবারো জানেন না, কেন এ সিয়াম পালন করছি, কী মহতী লক্ষ্য উদ্দেশ্যে আল্লাহতায়ালা আমাদের ওপর এ সিয়ামকে ফরজ করেছেন। সে কারণেই দেখা যায়, অনেক রোজাদার জীবনে শুধু এক-দুবার কী তিনবার নয়, অসংখ্যবার এ মহিমান্বিত সিয়াম পালনের সৌভাগ্য তার হয়েছে। কিন্তু সামান্যও পরিলক্ষিত হয়নি তার জীবনে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আর খুঁজে পাওয়া যায়নি সিয়ামের কোনো নিদর্শন। সিয়াম সাধনার আগেও তার জীবনাচরণ যেমন ছিল, দীর্ঘদিন সিয়াম সাধনার পরও ঠিক তেমনি রয়ে গেছে।

ইরশাদ হচ্ছে ‘হে ইমানদাররা! তোমাদের জন্য সিয়াম পালন ফরজ করে দেয়া হলো_ যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপরও ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা মুত্তাকিন বা প্রকৃত খোদাভীতির গুণাবলী অর্জনে সক্ষম হও।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩) এ আয়াতের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে যে মুত্তাকিন হওয়ার জন্যই আল্লাহ পাক সিয়াম সাধনাকে আমাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় করেছেন।

মুমিন জীবনে মুত্তাকিন হওয়ার প্রয়োজনিয়তা কতটুকু? এ প্রশ্নের জবাব অসংখ্য আয়াত ও হাদিস সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। কোরআনের একাধিক আয়াতে আছে ‘মুত্তাকিন হওয়া ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ অসম্ভব। কেননা জান্নাত তৈরি করা হয়েছে মুত্তাকিনদের জন্য।’ যেমন আল্লাহর ঘোষণা ‘তোমরা তীব্রগতিতে অগ্রসর হও স্বীয় প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও জমিনের মতো, যা নির্মিত হয়েছে মুত্তাকিনদের জন্য।’ (আল-ইমরান : ১৩৩)

সুতরাং আমি যদি সত্যিই জান্নাতপ্রাপ্তির প্রকৃত পথযাত্রী হতে চাই, তবে অবশ্যই আমাকে মুত্তাকিন হতে হবে। আর জান্নাতপ্রাপ্তির জন্য মুত্তাকিন হওয়ার শর্ত এ কারণে যে মুত্তাকিন হওয়া ছাড়া একজন মানুষ প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। এ গুণ অর্জনের মাধ্যমেই একজন মানুষ তার যাবতীয় লোভ-লালসা ও চাওয়া-পাওয়া এবং প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সব ধরনের অন্যায় বর্জনের প্রয়োজনিয়তা উপলব্ধি করতে পারে। কোনো প্রলোভনেই সে প্রলুব্ধ হয় না। কেননা তার অন্তঃকরণে এমনই এক মহাপরাক্রমশালীর ভয় সদা বিরাজমান থাকে। একজন মুত্তাকিনের মনে সব সময় ভয় জাগ্রত থাকে, আমি যে কোনো অন্যায় কাজে পৃথিবীর সব শক্তিকে আড়াল করে লিপ্ত হতে পারি। কেউ আমাকে হয়তো দেখবে না। অথবা আমার এত শক্তি রয়েছে যে কেউ দেখলেও আমাকে কিছু করতে পারবে না। কিন্তু আমি কোনো অবস্থাতেই মহামহীয়ান আল্লাহর কুদরতি চোখকে আড়াল করতে পারবো না, যত গোপনেই হোক না কেন। আর তিনিই হচ্ছেন সব শক্তির আঁধার। দুনিয়াতেও যখন ইচ্ছা যে কোনো শাস্তি প্রদানে তিনি সক্ষম। তাছাড়া এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে যখন আমি স্থায়ী আখেরাতে পাড়ি জমাব, তখন এ দুনিয়ার যাবতীয় কর্মকাণ্ডে হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তার কাছে আমাকে দিতেই হবে।’

একজন মুত্তাকিনের এ চিরন্তন বাস্তবতার অনুভূতি তখন তার জীবনের যাবতীয় অন্যায় কর্মকাণ্ডের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। আর এটাই হচ্ছে মুত্তাকিনের বৈশিষ্ট্য। আর একজন মুসলমানের মুত্তাকিন হওয়ার বাস্তব প্রশিক্ষণ কর্মশালা হচ্ছে সিয়াম পালন। কেননা একজন রোজাদার মহান আল্লাহর নির্দেশনা মতে সুবহে সাদিকের আগেই স্ত্রী সম্ভোগ ও যাবতীয় পানাহার বন্ধ করে অপেক্ষায় থাকে কখন সূর্যাস্ত যাবে, তখনই পানাহার করব। এর আগে তার প্রবৃত্তি যতই প্রলুব্ধ হোক, পিপাসা তাকে যতই কাতর করুক, ক্ষুধার যন্ত্রণা যতই অনুভব করুক সবই নীরবে সহ্য করে অপেক্ষায় থাকেন ইফতারের। একজন মুত্তাকিনের তাকওয়ার অনুভূতিই তাকে বিরত রাখে শত কষ্টের মধ্যেও পানাহার পরিত্যাগে। পবিত্র সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আরো অনেক উত্তম গুণাবলী অর্জিত হয়। যেমন আত্মীক পবিত্রতা, চিন্তার বিশুদ্ধতা, নৈতিক পরিচ্ছন্নতা, চারিত্রিক উন্নয়ন, রুহানি তৃপ্তি, ধৈর্য, মিতব্যয়ী, আল্লাহপ্রেমে নতুন উদ্যম, ভোগের বিপরীতে ত্যাগের অনুপ্রেরণা।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। পৃথিবীর মহান স্রষ্টার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মানুষের সৃষ্টি। যেহেতু মানুষ এ বসুন্ধরায় তারই রবের প্রতিনিধি, তাই তাকে অর্জন করতে হবে কতিপয় গুণ। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে রোজা ঐ গুণাবলি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। মানুষের মধ্যে দুই ধরনের শক্তি বিদ্যমান। পাশবিক শক্তি ও মানবিক শক্তি। পানাহার, নিদ্রা ও যৌন চাহিদা নিবারণের ক্ষেত্রে মানুষ ও পশুর মধ্যে তেমন কোন তফাৎ নেই, আর এসব কাজের মাধ্যমে মানুষের শক্তি বৃদ্ধি পায়। অবশ্য বিধাতার আরোপিত নিয়মনীতি, বিধিবিধান অনুসরণের মাধ্যমে এ পাশবিক শক্তি নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। বছরের এক মাস নিরবচ্ছিন্ন সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তথা সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন চাহিদা পূরণ থেকে বিরত এবং রাত জেগে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতপক্ষে মহান স্রষ্টার গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রয়াস চালায়। বৃদ্ধি পায় মানবিক শক্তি এবং ক্ষীণ হয় পাশবিক শক্তি। অর্জিত হয় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং সুদৃঢ় হয় এই পৃথিবীতে তার প্রতিনিধিত্ব করার গুণাবলী।

হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ বলেন- ‘রোজার প্রতিদান আমিই দেব, যেহেতু রোজাদার আমার জন্যই পানাহার ও প্রবৃত্তি পরিত্যাগ করে।’ (বুখারি ও মুসলিম) এছাড়া রোজার মাধ্যমে মানবতার বিকাশেও মানুষ এগিয়ে যায় এক ধাপ। এমনিভাবে সারাদিন উপবাস থেকে সিয়াম পালনের মাধ্যমে রোজাদার তার অভাবগ্রস্ত, দারিদ্র্যপীড়িত ও অর্ধাহার-অনাহারে দিনাতিপাতকারী ভাইদের দুঃখ-দুর্দশা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় এবং তাদের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করার মানসিকতা তার মধ্যে জন্ম নেয়। ফলে ধনী-গরিবের মধ্যকার বিদ্যমান বৈষম্য দূর হওয়া এবং দারিদ্র্যমুক্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ সুগম হয়।

সুস্থ মন ও উন্নত মানসিকতার জন্য প্রয়োজন সুস্থ দেহ। রোজা মানবদেহের সুস্থতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবন যাপনের মাধ্যমে মানুষের মনুষ্যত্ব বিকশিত হয়। আর এ সমাজবদ্ধ জীবন সংহত করার জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি। রোজা সমাজের প্রত্যেক নাগরিকের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি তৈরি করে। রোজা সমাজের প্রত্যেক নাগরিকের মধ্যে ঐক্য বিনির্মাণে সহায়তা করে। এক ও অভিন্ন সময়ে সেহরি খাওয়া, উপবাস থাকা ও ইফতার করার মাধ্যমে সে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ভদ্রতা, নম্রতা ও সহনশীলতা মানুষের অন্যতম মানবীয় গুণ। রোজার মাধ্যমে এই মহৎ গুণাবলীর অনুশীলন করা হয়ে থাকে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন রোজা রাখে তখন তাকে অশ্লীল কথা ও হৈচৈ পরিত্যাগ করা উচিৎ। কেউ যদি তাকে গালি দেয় বা তার সঙ্গে ঝগড়া করতে চায় তাহলে সে বলবে- আমি রোজাদার।’ (বুখারি ও মুসলিম)।

এমনিভাবে রোজা মানুষকে মিথ্যা বলা, প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার আশ্রয় নেয়া এবং তদনুযায়ী কাজ করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করে। তাছাড়া রোজা মানুষকে আতিথেয়তার মতো মহৎ মানবীয় গুণেরও প্রশিক্ষণ দেয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য রোজাদারকে ইফতার করানোর প্রতি উৎসাহ প্রদান করে ঘোষণা করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে সে ওই রোজাদারের সমান প্রতিদান পাবে। এতে ওই রোজাদারের সওয়াবের কোনো ঘাটতি হবে না।’ (তিরমিজি)।

রোজার মাধ্যমে ধৈর্যের বাস্তব প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে। আল্লাহর জমিনে তার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করতে হয়। ইসলাম ও মানবতার শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ ও আল্লাহর পথে আত্মোৎসর্গ করার মতো কষ্টসাধ্য বিষয়কে ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করার অনুশলীন হয় সিয়াম সাধনার মাধ্যমে। ইসলামের ইতিহাসে অনেক বিজয়ই অর্জিত হয়েছে রমজান মাসে। এছাড়া তালুত যখন শত্রুদের মোকাবিলা করতে উদ্যত হলেন তখন মহান আল্লাহ তার অনুসারীদের নদীর পানি পান করা থেকে বারণ করে পরীক্ষা করলেন। ইরশাদ হচ্ছে- ‘অতঃপর তালুত যখন সৈন্য-সামন্ত নিয়ে বের হলো তখন বলল: নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের পরীক্ষা করবেন একটি নদীর মাধ্যমে। সুতরাং যে লোক সেই নদীর পানি পান করবে সে আমার দলভুক্ত নয়। আর যে লোক তার স্বাদ গ্রহণ করল না নিশ্চয়ই সে আমার লোক।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২৪৯)। এছাড়া মানবীয় গুণাবলীর অন্যতম উপাদান সংযম ও তাকওয়া উপহার দেয়ার জন্যই যুগে যুগে ফরজ করা হয়েছে রোজা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের পূর্ববর্তীদের মতো তোমাদের ওপরও রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)।

অন্যসব ফরজের মধ্যে বান্দার কিছু না কিছু ব্যক্তিগত স্বার্থ নিহিত থাকতে পারে, কিন্তু রোজা শুধু আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। এ সম্পর্কে আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আদম সন্তানের নেক আমলের সওয়াব ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত দেয়া হয়; কিন্তু রোজার ব্যাপারে তেমন নয়। রোজা আমার জন্য। সেজন্য আমি নিজেই এর প্রতিদান দেবো।’ এ মাসের ‘নফল’ নামাজ অন্য মাসের ‘ফরজ’ নামাজের সমান। এ মাসের একটি ‘ফরজ’ নামাজ অন্য মাসের ৭০টি ‘ফরজ’ নামাজের সমান। রোজার একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য নেয়ামত হচ্ছে, এর পারলৌকিক ও ইহলৌকিক উপকারিতা।

পারলৌকিক উপকারিতা
১. রোজাদারের অল্প সময়ের সাধনা অনেক বেশি সওয়াবের। রোজাদারের শুধু সৎকর্ম নয়, প্রতিটি সৎচিন্তাও গভীর সাধনার তুল্য। শুধু সৎচিন্তাই নয়, হাদিস শরিফে বর্ণিত, ‘রোজাদারের নিদ্রা তার ইবাদতের তুল্য এবং নীরবতা “তাসবিহ” পাঠের তুল্য।’ তাহলে দেখা যাচ্ছে, একজন রোজাদার সামান্য একটি কাজে যত বেশি সওয়াব লাভ করতে পারে, কঠোর সধনাবলে সারাটা বছর ধরেও তা পারে না।

২. রোজাদারের শুধু কর্ম ও চিন্তা নয়, তার দেহের প্রতিটি অঙ্গই পবিত্রতা লাভ করে। তার গোটা দেহটাই যেন পরিণত হয় একটি পবিত্র সাধনার আলয়ে। এমন কি রোজাদারের মুখের গন্ধ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে মিশকের চেয়ে সুগন্ধিময়।

৩. আল্লাহ পাকের লক্ষ কোটি অতুলনীয় এবং অসীম গুণাবলীর মধ্যে কোনো একটির পরিপূর্ণ অধিকারী হওয়া কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু একমাত্র রোজাদারই সেই পরম সৌভাগ্যের নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হয়। আল্লাহ পাক পানাহারমুক্ত। রোজাদার একটি মাসে দিনের বেলাতে পানাহারমুক্ত থেকে স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করে থাকে। সৃষ্টির এমনি ত্যাগ সাধনাতে স্রষ্টা বড়ই খুশি হন।

৪. বেহেশতে প্রবেশের আটটি দরজা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ‘রাইয়ান’ দরজাটি সবচেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ। আর এ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হতে পারবে শুধু রোজাদাররাই। অর্থাৎ শুধু রোজাদারদের জন্যই এ দরজাটি সংরক্ষিত রয়েছে। এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য রোজাদারদের জন্য আর কী হতে পারে?

৫. রোজাদারের প্রতি ফেরেশতারাও কৃপাবান থাকেন। এ সময় তারা রোজাদারদের সব পাপ মুক্তির জন্য দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে থাকেন এবং আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের সম্মান রক্ষা করেন। অর্থাৎ রোজার সাহায্যে রোজাদার শুধু নিজের পথই আলোকিত করে না, তার চলার পথের সাহায্যকারী বন্ধুকেও খুঁজে পায়।

৬. কেয়ামতের দিনে রোজাদারদের জন্য রোজা শাফায়াতকারীর কাজ করবে। রোজার পরম বন্ধু রোজাদার। তাই বন্ধুর মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত সে কিছুতেই শান্তি পাবে না। বন্ধুর শাফায়াতের জন্য অবিশ্রান্তভাবে সে করুণাময়ের কাছে নিবেদন করতে থাকবে।

রোজার ইহলৌকিক বা পার্থিব উপকার
১. মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনে রোজা বিশেষভাবে সাহায্য করে। মিথ্যা কথা, গিবত, হিংসা, অহঙ্কার ইত্যাদি অসৎ স্বভাবগুলো রোজাদারের জন্য বিশেষভাবে পরিত্যাজ্য। প্রকৃত রোজাদার এসব বদ স্বভাব থেকে দূরে থেকে মহৎ চরিত্র গঠন করে নিতে সমর্থ হয়।

২. রোজা দরিদ্র লোকদের প্রতি ধনী লোকদের সমবেদনাবোধ জাগাতে সহায়তা করে। নানাবিধ প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করে ধনীরা দরিদ্রের ক্ষুধার যন্ত্রণা অনুভব করতে পারে না। কিন্তু শুধু রোজার মাধ্যমেই ধনীরা তা অনুভব করতে সক্ষম হয়। এমনি করেই তাদের হৃদয়ে দরিদ্রের প্রতি একটা স্বাভাবিক সহানুভূতিবোধ জাগরিত হয়।

৩. রোজা মানুষকে ফাঁকি দেয়ার অভ্যাস থেকে দূরে রাখে। রোজাদার ইচ্ছা করলে লোকচক্ষুর অন্তরালে গিয়ে অনেক কিছু পানাহার করতে পারে। কিন্তু সে তা করে না। কারণ সে উপলব্ধি করতে পারে, অপরকে ফাঁকি দিতে ইচ্ছে করলে নিজেই ফাঁকির শিকার হতে হয়।

৪. রোজা মানুষকে ধৈর্য, সংযম ইত্যাদি মহৎ গুণাবলী শিক্ষা দেয়। অনেক সংযমতার সঙ্গে সে রোজার নিয়মাবলী পালন করে এবং ইফতারির মুহূর্ত পর্যন্ত আহারসামগ্রী সম্মুখে নিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু লোভের বশবতী হয়ে সময় হওয়ার আগে তা ভক্ষণ করে না। এমনি করে রোজা মানুষের লোভী স্বভাব নিবৃত্ত করে।

৫. রোজা মানুষের আয়ু বৃদ্ধি করে। কোনো প্রাণী যতদিন পর্যন্ত বাড়তে থাকে, ততদিন বার্ধক্য আসে না। বাড়া বন্ধ হয়ে গেলেই দেহের মধ্যস্থিত যন্ত্রগুলোর ক্ষয় শুরু হয় এবং মৃত্যুর সময় নিকটবর্তী হয়। তাই দেহের বৃদ্ধিসাধন ধীরে ধীরে হওয়াই মঙ্গলজনক। এক মাসের রোজা বা উপবাস দেহের এ ধীরবর্ধনে সহায়তা করে। এ তত্ত্বটি চিকিৎসাশাস্ত্রে স্বীকৃত।

৬. এক মাসের রোজা মানুষের দেহের মধ্যকার দুর্বল হৃৎপিণ্ড, রক্ত চলাচল, যকৃৎ প্রভৃতিকে সবল ও সতেজ করে তোলে। এটা ফুসফুসের পুরনো দুরারোগ্য ‘কফ’ দূর করে। তাছাড়া বহুমূত্র রোগীদের পক্ষে রোজা বিশেষ উপকারী। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ‘যারা নিয়মিতভাবে রোজা পালন করেন, সাধারণত তারা বাত, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপ ব্যাধিতে আক্রান্ত হন না।’

আমাদের উচিৎ, আমরা প্রকৃত রোজাদারের গুণাবলী লাভ করে ধন্য হতে পারি, তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। যখনই আমাদের এ প্রচেষ্টা সার্থক হবে, শুধু তখনই আমরা আল্লাহ পাকের এ পবিত্র নেয়ামতের সৌভাগ্যবান অধিকারী হতে পারব। তখনই ধন্য হবে আমাদের মানব জীবন। সার্থক হবে আমাদের ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ নাম।

রোজার মাধ্যমে রোজাদারদের জীবনে নেমে আসুক অনাবিল শান্তি, বিকশিত হোক মানবতা ও মনুষ্যত্ব, অর্জিত হোক মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত এ মোনাজাত আমাদের।

লেখক: বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও প্রবাসী রাজনীতিবিদ।



মন্তব্য চালু নেই