এইচএসসি পাস করেও ভিক্ষা করেন মিন্টু
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট। জাতির ইতিহাসে এক দুঃস্বপ্নের দিন। এই দিন দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)। উগ্রপন্থি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে জেএমবি সেদিন বেলা ১১টার পর থেকে ১২টার মধ্যে দেশের আদালত, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি আধাসরকারি স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়।
দেশে তিনশ জায়গায় সেদিন তাদের ৫০০ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে মারা যান দু’জন। আহত হন প্রায় দুই শতাধিক লোক।
সিরিজ বোমা হামলার আহতদের অনেকেই এখনও পার করছেন দুর্বিসহ জীবন। তাদেরই একজন রংপুরের মিন্টু প্রামাণিক। দীর্ঘ ১১ বছর শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন বোমার স্প্লিন্টার।
এইচএসসি পাস এ মানুষটি এক সময় আদালতে চাকরি করলেও বর্তমানে রাস্তায় বসে ভিক্ষা করেন। আজ ঈদুল ফিতরের দিন তিনি ভিক্ষা করতে বসেছিলেন বায়তুল মোকারমের ফুটপাতে। ওই সময় তিনি সেই দুঃসহ জীবনের বয়ে চলা স্মৃতি তুলে ধরেন—
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সকাল ১১টা ৫ মিনিট। নথিপত্র নিয়ে কোর্টে ডুকছি রংপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। ওই মুহূর্তে দরজার সামনে দেখি একটি কালো ব্যাগ। ময়লা-আবর্জনা ভেবে ব্যাগটিকে বাম পায়ে একটু সরিয়ে দিতেই হঠাৎ বিকট শব্দ। ধাক্কা খেয়ে অনেক দূরে গিয়ে পড়ি।
বামপাসহ দুই হাত বোমায় জ্বলসে যায়। স্প্লিন্টার ডুকে হাতে পায়ে। ম্যাজিস্ট্রেট ও নাজির সাহেবরা আমাকে উদ্ধার করে ঢাকার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনেন। সেখানে চিকিৎসার পর আমাকে ভর্তি করানো হয় মহাখালীর একটি হাসপাতালে। সেখান থেকে চিকিৎসার জন্য সরকার আমাকে মাদ্রাজও পাঠায়।
মাদ্রাজে সাত মাস থেকে এসে সিলেট মেডিকেল ভর্তি হই। তারপর আমাকে ভর্তি করা হয় চট্টগ্রামের লিচুবাগানের খ্রিস্টান হাসাপাতালে। এসব জায়গায় বার বার স্প্লিন্টারগুলো অপসারণ করতে অপারেশন করা হয়। সব খরচ সরকার বহন করে।
এখন আগের থেকে অনেকটা সুস্থ আছি। এ মাসের ১৮ তারিখে পায়ের মাংসের ভিতরের পিন আউট করা হবে। ঢাকার একটি হাসপাতালে এ অপারেশন করা হবে। মাংসে থাকা পিনগুলো আউট করতে পারলেই হয়তো হাঁটতে পারবো। ঠিক মতো হাঁটাচলা করতে পারলে ভিক্ষা করতে চাই না। আবার কোনো কাজ জোগার করবো। ভিক্ষা করতে অনেক লজ্জা লাগে।
সেদিনের বোমায় আমি ছাড়াও আরো দুজন আহত হয়। তার মধ্যে ওই আদালতের এমএলএস শাহজাহান মৃত্যুবরণ করেন। আর টাইপিস্ট আশরাফুল আমার মতোই এখনও বার বার চিকিৎসা নিচ্ছে।
মিন্টু প্রামাণিকের বাড়ি রংপুর শহরেই। জেলখানার কাছাকাছি। ধনতলা আরইউ স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। টাকার অভাবে একপর্যায়ে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় তার। কিছুদিন বেকার থাকার পর রংপুরে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মাস্টার রুলে অর্ডারলির চাকরি নেন। ম্যাজিস্ট্রেটের অর্ডারসিট লিখতেন মিন্টু। আর সেখানেই বোমা হামলার শিকার হন।
বোমা হামলার সময় মিন্টুর বয়স ছিল ২২ বছর। তার ইচ্ছা ছিল আরো কিছুদিন গেলে ডিগ্রি ভর্তি হবেন। এলএলবি শেষ করে কোর্টেই প্র্যাকটিস করবেন। তারপর বিয়ে করে বউ আনবেন ঘরে।
কিন্তু সে সব এখন শুধুই স্বপ্ন। যে হাতে ম্যাজিস্ট্রেটের অর্ডারসিট লিখতেন, সে হাত দিয়েই মানুষের কাছে ভিক্ষার থালা বাড়িয়ে দেন মিন্টু।
ছেলের এই যন্ত্রণা দেখতে দেখতে মনে অনেক কষ্ট নিয়ে মারা গেছেন বৃদ্ধ বাবা। সংসারে আছেন মা ও ছোট ভাই। তাই আগাখান লেনের একটি মেসে থেকে ভিক্ষা করেই এখনো মায়ের খরচাপাতির জন্য টাকা পাঠান মিন্টু।
লাঠিতে ভর দিয়ে কিছুটা হাঁটতে পারলেও বসে বসেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হয় মিন্টুকে। নামাজ শেষে তিনি প্রতিদিনই দুহাত তুলে বলেন, ‘বিনা অপরাধে যারা আমার জীবনটা শেষ করে দিল আল্লাহ আপনি তাদের হক বিচার করুন।’
শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছে নয়। দেশের সরকারের কাছেও বিচার চান মিন্টু। বলেন, ‘সরকারের কাছে আমার অনুরোধ এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে অতিদ্রুত যেন বিচার করা হয়। আমি চাই না আমার মতো আর কাউকে যেন বোমার আগুনে এভাবে পুড়ে পুড়ে কষ্ট পেতে।- বাংলামেইল
মন্তব্য চালু নেই