উত্তাল রোকেয়া চরম সঙ্কটে
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বিভিন্ন পদ থেকে পদত্যাগ, প্রশাসনিক ভবনে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের তালা, দুর্নীতি, দ্বন্দ্ব, গ্রুপিং, আন্দোলন আর সহিংসতায় চরম সংকটে পড়ছে সপ্তম বর্ষে পা রাখা এ বিশ্ববিদ্যালয়টি।
আন্দোলনের নামে শিক্ষকদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ও সংকটের আওয়াজে উত্তাল হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ।
বন্ধ হয়ে পড়েছে প্রশাসনিক কার্যক্রম, বিভিন্ন বিভাগের সেমিস্টার ও ভর্তি পরীক্ষা। ফলে দিন দিনই পিছিয়ে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। অস্থিরতার কারণে চার বার বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে নবীন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। এতে করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। সেশনজটের কবলে পড়ছেন তারা।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে পদোন্নতিসহ নানা দাবিতে ২৯টি পদ থেকে ১৯ শিক্ষক পদত্যাগ করেছেন। এর আগে শিক্ষকরা বিক্ষোভ, সংবাদ সম্মেলন, স্মারকলিপি প্রদান করেছিলেন উপাচার্যকে। কিন্তু এসবে কোনো সমাধান না হওয়ায় অবশেষে তারা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
অন্যদিকে কোনো কারণ ছাড়াই আগামী ৪, ৫ ও ৬ ডিসেম্বর অনার্স ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করে দেন উপাচার্য। অসময়ে শিক্ষকদের আন্দোলন আর হঠাৎ ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ছেন ভর্তিচ্ছু রেজিস্ট্রেশন করা হাজারো শিক্ষার্থীরা।
সবশেষ গত বুধবার রাতে ক্যাম্পাসের বাইরে সংবাদ সম্মেলন করে উপাচার্যকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেন আন্দোলনরত শিক্ষক সমিতির নেতারা। পদোন্নতিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট সমাধানে কোনো সুরাহা না করে উপাচার্য এবার ক্যাম্পাস ছেড়ে কোথাও গেলে তাকে আর ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারী দেন তারা।
এদিকে চাকরি বৈধকরণ ও বেতনভাতার দাবিতে ১৫২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারি প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি। আর প্রসাশনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে পদোন্নতিসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষক সমিতির একাংশ।
অন্যদিকে ছাত্রদের আবাসিক হল, ক্যাফেটেরিয়া ও মসজিদের কাজ শেষ হলেও অজ্ঞাত কারণে এগুলো এখনো শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের পাঁচটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা স্নাতক ডিগ্রি শেষ করলেও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির বিধিমালা করার ব্যাপারটি দিক নির্দেশনাবিহীনভাবে পড়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী প্রয়াত ড. ওয়াজেদ মিয়ার নামে গড়ে ওঠা রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ভর্তিকৃত এমফিল ও পিএইচডি গবেষকদের গবেষণাও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে শুধুমাত্র সিলেবাসের অভাবে।
এসবের জন্য উপাচার্যকেই দায়ী করছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারারী। কারো কারো দাবি উপাচার্যের বিভিন্ন অনিয়ম, দূর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, একগুয়েমি ও সমস্যা সমাধানে উদাসীনতার কারণেই নবীনতম এ বিশ্ববিদ্যালয়টি দিন দিন সংকট থেকে উত্তোরণে বদলে পাল্টা চরম সংকটরে দিকে ধাবিত হচ্ছে।
এদিকে, ক্যাম্পাসে বর্তমানে শিক্ষকরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ, দুর্নীতি বিরোধী মঞ্চ, নীল দল, সাদা দল, বেরোবি শিক্ষক সমিতির ব্যানারে সময় অসময়ে কারণে অকারণে আন্দোলন, কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে মিটিং মিছিল করে আসছেন।
অন্যদিকে বিভক্ত দেখা দিয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠণেও। মাঝে মাঝে ছাত্রসংগঠণগুলোতেও গ্রুপিং দেখা গেছে। বিশেষ করে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনটিতে এর প্রবণতা বেশি। তাদের প্রভাব আর জোরদবস্তির কারণেই বঙ্গবন্ধু হলে আসন প্রত্যাশী ছাত্রদের সাক্ষাতকার স্থগিত করতে বাধ্য হয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
আন্দোলনের ফলে স্থবির হয়ে পড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম যেমন ব্যহত হচ্ছে। তেমনি সেশনজট থেকে মুক্তি মিলছে না শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, দুই বছরের সেশনজট মাথায় নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার স্বপ্ন এখন ফিকে হতে বসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী লাকী আখতার ও শামসুল আলম বলেন, ‘বড় আশা নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। যাতে করে সেশনজটের কবলে পড়তে না হয়। ঠিক সময়ে লেখাপড়া করে চাকরি জীবনে যেতে পারি। কিন্তু সে আশা আর হবে না। সংঘর্ষ আর সহিংসতা, শিক্ষক ধর্মঘট ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়ে উঠলে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু তারা একবারও ভাবেন না যে এতে করে আমাদের লেখাপড়ার কত ক্ষতি হয়। আমাদের শিক্ষা জীবন থেকে ঝড়ে পড়ে অনেক মূল্যবান সময়’।
এব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. পরিমল চন্দ্র বর্মণ জানান, উপাচার্য স্যারের স্বেচ্ছাচারিতা, একগুয়েমি মনোভাব ও বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে উদাসীনতার কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থার জন্য তিনিই দায়ী’। তবে আন্দোলনের কারণে পরীক্ষা ও ক্লাশ বন্ধ নেই বলে দাবি করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘শিক্ষর্থীদের লেখাপড়ার যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তা মাথায় রাখতে হবে সবাইকে। আর নবীন এ বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে’।
এব্যাপারে উপাচার্য অধ্যাপক ড. একেএম নুর-উন-নবী চেীধুরী বলেন, ‘আন্দোলনসহ নানা কর্মসূচিতে নতুন এ বিশ্ববিদ্যালয়টি পিছিয়ে পড়ছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া বিঘ্ন হচ্ছে। এসব বিবেচনা করে শিক্ষকসহ সবাইকে আন্দোলন ছেড়ে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। তাহলেই বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব’।
উল্লেখ্য, সেশনজটমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে তোলা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান রংপুর টিচার্স ট্রেনিং কলেজে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন করেন। এরপর সেখানেই ভাড়া করা ভবনে চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। পরবর্তীতে কারমাইকেল কলেজের ৭০ একর জায়গার উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখররুদ্দীন আহম্মদ। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজস্ব জায়গায় নিজস্ব ভবনে ক্লাসসহ সব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এম লুৎফর রহমান।
পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা অধ্যাপক ড. আবদুল জলিল মিয়া ২০০৯ সালের ১১ মে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বভার নেন। কিন্তু ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ভিসি বিরোধী আন্দোলনের মুখে ২০১৩ সালের ৫ মে সরকার উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল জলিল মিয়াকে অপসারণ করে নতুন উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক ড. একেএম নুর-উন-নবীকে নিয়োগ দেয়। এরপর ৬ মে তিনি মন্ত্রাণালয়ে যোগদান করেন। ৯ মে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্বভার বুঝে নেন।
মন্তব্য চালু নেই