ইসলাম, নারী ও যৌনতা : আমরা কি বাড়াবাড়ি করছি না?

[ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ তারিখে ফ্রিল্যান্স লেখিকা উম্মে যাকিয়া বিশ্ববিখ্যাত ইসলামিক অনলাইন মিডিয়া onislam.net-এ ‘Good Muslims Don’t Think About Sex’ শীর্ষক একটি আর্টিকেল লেখেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ১০ নভেম্বর, ২০১৩ তারিখে মালয়েশিয়ার আরেক ফ্রিল্যান্স লেখিকা রাওদাহ মুহাম্মদ ইউনুস ‘Islam, Women and Sex: Do We Overdo Things?’ শিরোনামে একটি আর্টিকেল লেখেন। রাওদাহ মুহাম্মদ ইউনুসের আর্টিকেলটি বাংলায় অনুবাদ করেছে সিএসসিএস ]

ইসলামের সবকিছুতে যৌনতার একটা প্রেক্ষিত বের করার চেষ্টা করা এবং নারী-পুরুষের সম্পর্ককে প্রধানত যৌন প্রকৃতির মনে করাটা একটা যুগ-প্রাচীন অজ্ঞতা। উম্মে যাকিয়া’র ‘ভালো মুসলমানেরা যৌনতা নিয়ে আগ্রহী হয় না’ [Good Muslims Don’t Think About Sex] শীর্ষক প্রবন্ধটি সম্প্রতি আমার নজরে পড়েছে। তিনি একজন স্কুল শিক্ষক। সেখানকার একটা ছোট্ট মেয়ে ‘আমি একজন মা হতে চাই’ বলাতে তিনি যে ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাতে এটি স্পষ্ট যে, আমাদের আশপাশে এমন প্রচুর মানুষ আছে যারা বিষয়গুলোকে নিজেদের মর্জি-মাফিক ব্যাখ্যা করে সেগুলোকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে।

আমার টিন-এজে’র সময়েও আমি কম-বেশি অনুরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। এসব (যৌনতা) বিষয়ে আনাড়ি হওয়ার কারণে আমি মারাত্মক গোঁড়ামির শিকার ছিলাম। আমি বিশ্বাস করতাম, যৌনতা সংশ্লিষ্ট যে কোনো কিছুই ইসলামবিরোধী এবং একজন ভালো মুসলমান হতে হলে যৌনতার উদ্রেক করে এমন যে কোনো চিন্তা বা কথা-বার্তাকে যথাসম্ভব দমন করতে হবে।

হাই স্কুল শেষ করার পরে আমি স্থানীয় একটা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা পূর্ব কোর্সে ভর্তি হই। এই কোর্স করে যেহেতু আমাদের আরব বিশ্বে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়ার কথা তাই স্বভাবতই সব ছাত্ররা এসেছিলো মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড হতে। আমি ছিলাম একমাত্র ছাত্র যে কিনা মেইনস্ট্রিম পাবলিক স্কুল পাস করা। যার ফলে আরবী ভাষাও আমার জানা ছিলো না। শুধুমাত্র প্রচন্ড আগ্রহ, বিশেষ করে ইসলাম সম্পর্কে গভীর ভালোবাসাই আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলো।

প্রথম প্রথম বিষয়গুলোকে বেশ ভালোই মনে হলো। ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই প্রচলিত ইসলামী পোশাক পরিধান করতো। মেয়েরা ‘তুদুং’ নামের দীর্ঘ হিজাব আর ছেলেরা পোশাকের অংশ হিসেবে মাথায় ‘কোপিয়া’ নামের সাদা টুপি পড়তো। আমাদের সমাজে এ ধরনের পোশাককে ধর্মীয় পবিত্রতা তথা তাক্বওয়ার নিদর্শন মনে করা হতো। এ রূপ দ্বীনি পরিবেশে থাকার স্বপ্ন দেখতাম। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের স্বর্গীয় পরিবেশ প্রথম কয়েক সপ্তাহ আমাকে বেশ আহ্লাদিত করে। আমাকে অবশ্যই সঠিক পথে থাকতে হবে– আমি নিজেকে শক্ত অটো-সাজেশান দিলাম। ‘ভালো’ হবার অত্যধিক আগ্রহের কারণে আমি তাঁদেরকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে খুব কাছ হতে দেখেছি এবং তাঁদের সব কথাকে অন্তরে গেঁথে নেয়ার চেষ্টা করেছি।

চক চক করলেই সোনা হয় না
এক মাসের মতো অতিবাহিত হওয়ার পরে আমার মনে হতে লাগলো, কোথাও কিছু একটা উল্টাপাল্টা হচ্ছে। এসব ‘ইসলামী’ ছাত্র-ছাত্রীদের, বিশেষ করে ছাত্রদের কেউ কেউ বাড়াবাড়ি করছে। শুরুতে মনে হয়েছিলো যে, ইসলাম সম্পর্কে আমার পড়াশোনার যেহেতু ঘাটতি আছে তাই আমার উচিত, না বলে শোনা। কিন্তু দিনের পর দিন আমার কাণ্ডজ্ঞান তাঁদের বাহ্যিক ‘ইসলামী’ আচরণগুলো সম্পর্কে আমাকে প্রতিবাদী করে তোলে। ক্লাসের মধ্যে আমাদেরকে নানাভাবে এটি বুঝিয়ে দেয়া হলো যে, মুসলিম ছাত্রীরা ক্লাসে বেশি সক্রিয় হবে না, বেশি কথা বলবে না।

কারণ, ধর্মপ্রাণ মুসলিম মেয়েদের উচিত যথাসম্ভব চুপ থাকা। তাই শিক্ষকদের বেশি বেশি প্রশ্ন করাটা তাঁদের জন্য অসঙ্গত। বলা হলো, নারীদের কণ্ঠ হলো ‘আওরাহ’ বা পর্দার অন্তর্গত। তাই, নারী কণ্ঠস্বর যৌনতার উদ্রেক ঘটাতে পারে বিধায় নিশ্চুপ থাকাটাই নিরাপদ। আমার কোনো বান্ধবী কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করার জন্য সামনের বেঞ্চে বসলে পেছন থেকে ছেলেরা নানাভাবে তাঁকে উত্যক্ত করতো। আমাদের কেউ ভুলক্রমে উচ্চস্বরে কথা বললে তাঁরা তাঁকে একজন আদর্শ মুসলিম নারী সম্বন্ধে হেদায়েত দান করার চেষ্টা করতো। সত্য জানার অদম্য স্পৃহা নিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে আমি অনুসন্ধান করে জানলাম যে, এসব এবজার্ড শিক্ষা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাঁরা মাদ্রাসাসমূহের শিক্ষকদের কাছ থেকেই পেয়েছে।

বিশেষ করে নারীদের এভাবে মগজ ধোলাই করা হয়েছে যেন তাঁরা মনে করে, যৌন অপরাধসহ সব পাপের মূল হচ্ছে নারী। অতএব, মানবজাতির মুক্তির জন্য তাঁদেরকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। কিছু বান্ধবী আমার কাছে এ সম্পর্কে তাঁদের বাজে অভিজ্ঞতার কথা বলেছে। তাঁরা বলেছে, তাঁদের পড়াশোনা করা সেসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাই সবকিছুতে মাতব্বরি করতো। এর ফলে ছাত্রীদেরকে সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে হতো। ছাত্রীদের পোশাকের কোনো সামান্যতম ত্রুটিও সহ্য করা হতো না। কোনো ছাত্রীর পর্দায় মামুলি গাফলতি- ছাত্রী হিসেবে তাঁর সুনাম ও মর্যাদাকে ধূলিস্যাত করে দিতো।

এ ধরনের একটা নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালো, ধূসর ও সাদা রংয়ের বাইরে কোনো কোনো রংয়ের পোশাক না পরার জন্য ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। অন্যান্য রংয়ের পোশাককে যৌন উদ্দীপক হিসেবে বিবেচনা করে সেগুলো নিষেধ করা হতো। একই কারণে প্যান্ট পরার ব্যাপারে রীতিমতো ট্যাবু কাজ করতো। লাল রংয়ের প্যান্ট পরার ব্যাপারে বিশেষ করে নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণ ছিলো এই যে, এটি ছাত্রদেরকে যৌন সুড়সুড়ি দিতো!

ইসলাম এমন নয়
এসব লোকের মন-মানসিকতা এমন কেনো? আমি এই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম যে, হতে পারে আমি ভুল বুঝছি! এ ধরনের চিন্তাভাবনা তো ইসলাম সমর্থন করে না। এটি নিশ্চিত যে, ইসলাম ভদ্রতা ও শালীনতার ওপর সাতিশয় গুরুত্ব আরোপ করে, নারী ও পুরুষের অপ্রয়োজনীয় মেলামেশাকে নিষেধ করে। এরই সাথে সামঞ্জস্য রেখে পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যই শালীন পোশাকের ধরন নির্দিষ্ট করেছে। এতদসত্ত্বেও ইসলাম সম্পর্কীয় সবকিছুতে যৌনতাকে প্রাসঙ্গিক হিসেবে হাজির করা এবং নারী ও পুরুষের সম্পর্ক মাত্রকেই যৌন সম্পর্ক হিসেবে বিবেচনা করার প্রবণতা হচ্ছে সুস্পষ্ট অজ্ঞতা।

পোশাকের ইসলামী বিধান মানা সত্ত্বেও পোশাকের স্টাইল ও রং নির্ধারণের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় রক্ষণশীলতা বা কড়াকড়ি আরোপের এই দৃষ্টিভঙ্গী অযৌক্তিক চরমপন্থা ও বিপদের কারণ। এই অবস্থার সবচেয়ে করুণ দিকটা হচ্ছে এই যে, এসব ছাত্র তথা পুরুষগণ এক ধরনের মানসিক রোগে ভুগছেন যাকে ডিলিউশান বলা হয়। ফলে তাঁরা প্রতিনিয়ত আত্ম-প্রতারণায় লিপ্ত! তাঁরা মনে করে, পুরুষ হিসেবে তাঁদের যৌন-তাড়নাটি সর্বদাই মূখ্য এবং নারী দর্শন মাত্রই তাঁদের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ হবে! আমি যদি পুরুষ হতাম তাহলে নিজেকে দুষ্প্রতিরোধ্য যৌনপ্রবণ প্রাণী হিসেবে উপস্থাপন করার এই রীতিকে নিজের জন্য ভীষণ অসম্মানজনক মনে করতাম। অথচ এরা নিজেদের বাহ্যত পশুবৎ মনে করার কারণে স্বীয় শারীরিক ও মানসিক শুচিতার জন্য সম্ভাব্য সকল পন্থায় নারী উপস্থিতি হতে নিজেদের মুক্ত রাখার চেষ্টা করে। অথচ যে কোনো সত্যিকারের মুমিন বান্দা উচ্চতর মর্যাদারই হওয়ার কথা।

মাস কয়েক পরে আমি মিশরে চলে আসার পরে তুলনামূলকভাবে কম হলেও একই ধরনের কনফিউশানে ভুগেছি। এখানে আমি এমন কিছু মহিলার সাক্ষাৎ পেলাম, যাঁরা পর্দার আড়াল হতে পুরুষদের সাথে কথা বলার সময়ে আক্ষরিকভাবে মুখে ছোট পাথর পুরে রাখতো! আমি তাঁদের কাছ হতে এহেন আচরণের কারণ জানতে চাইলে তাঁরা বললো, মহিলাদের স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনার উদ্রেক ঘটাতে পারে বিধায় তা যথাসম্ভব না শোনানোই উত্তম।

তাঁরা এ প্রসংগে কোরআনের একটা আয়াতকে তুলে ধরেন যাতে উম্মল মুমিনীন (রা.) কে পরপুরুষের সাথে এমন কোমল কন্ঠে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে; যাতে যারা অকলুষ মনের অধিকারী নয় তারা যাতে আরো দূর্বল না হয়ে পড়ে। এদের মধ্যকার কেউ কেউ অনেক ঢিলেঢালা বহিরাবরণের নীচের কয়েক পরতের কাপড় পরিধান করে যাতে কোনোক্রমেই তাঁদের দেহ-সৌষ্ঠব বুঝা না যায়। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, এই ধরনের পোশাকের উদ্দেশ্য শরীর ঢাকার চেয়েও নিজ দেহকে অধিকতর বড় তথা মেদবহুল হিসেবে উপস্থাপন করাও অন্যতম লক্ষ্য। সাথে থাকে নিকটাত্মীয় (মাহরা) ছাড়া কোথাও নারীদের ভ্রমণ থেকে বিরত রাখার জন্য ধর্ষণ ও যৌন হয়রানী সম্পর্কিত বিভিন্ন গল্পের সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে ভীতি জাগানো পৌনঃপুনিক বর্ণনা।

ইসলাম সম্পর্কে আমার ক্রমবর্ধমান আগ্রহ ও চর্চা সত্ত্বেও এদের এই সব যুক্তি ও কার্যক্রমকে মেনে নেয়ার জন্য আমার বারম্বারের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম যে, অধিকাংশ লোকেরাই প্রকৃতপক্ষে চিন্তাশীল নন। যার কারণে তাঁরা সহসাই এক্সট্রিমিজমের শিকারে পরিণত হয়ে থাকেন। ক্ষুদ্র এক একটা সমাজে বসবাসকারী অধিকাংশ লোকেরাই বিদ্যমান মূলধারার এ ধরনের গণ্ডিবদ্ধ মানসিকতার বিপরীতে দাঁড়ানোর মতো যথেষ্ট নৈতিক শক্তির অধিকারী না হওয়ায় তাঁরা গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়। ইসলাম সম্পর্কে আমি কোনো মুফতি-বিশেষজ্ঞ নই।

তৎসত্ত্বেও ইসলামের মূল স্পিরিট সম্পর্কে আমার বুঝ-জ্ঞান (understanding) এবং মহান আল্লাহর ওপর আমার ঈমানের শক্তির ওপর নির্ভর করে আমি এ কথা বলতে পারি যে, ইসলাম আমাদেরকে প্রজ্ঞা, সরলতা, কোমলতা এবং কাণ্ডজ্ঞান প্রয়োগের শিক্ষা দেয়। তাই অধিকতর ধর্মপ্রাণ হওয়ার চিন্তায় বাড়াবাড়ি বা তাচ্ছিল্যভাবের কারণে অতি-সরলীকরণ – উভয়টিই অবাঞ্ছিত। ইসলামকে সমগ্র মানবজাতির জন্য গ্রহণ-উপযোগী তথা বাস্তবসম্মত হিসেবে প্রমাণ করার জন্য মধ্যপন্থাই হচ্ছে একমাত্র পন্থা। কিছু লোক এ ধরনের ভুল চিন্তা করে যে, কঠোরতা আরোপ বা চর্চাই হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়! এই ভুল মন-মানসিকতাই হচ্ছে মহিলাদের সম্পর্কে অতিরক্ষণশীল, অতিসতর্ক ও বিভেদমূলক নীতির প্রসারের কারণ।

এসব ভুল বুঝাবুঝির কারণে চরমপন্থার অনেক দরজা খুলে যায়। যার পরিণতি হচ্ছে মাত্রাহীন অপপ্রচার ও প্রতিক্রিয়া। এর সূত্র ধরে ইসলামবিরোধীরা নানা রকমের অভিযোগ উত্থাপনের সুযোগ পায়। যদিও এটি সত্য যে, ইসলাম নারীদের নিষ্ক্রিয়, অবদমিত এবং পরমুখাপেক্ষী হিসেবে মনে (treat) করে না, তথাপি কিছু মুসলিম পুরুষ ও কতিপয় মুসলিম কমিউনিটির কার্য-কলাপের ফলে নারীদের ব্যাপারে বিরোধীদের অভিযোগের কিছু দুঃখজনক বাস্তবতা রয়েছে।

ইসলামের মৌলচেতনার অন্তর্ভুক্ত কিছু বিষয়- যেমন, মানবিক কাণ্ডজ্ঞান, নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গী ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগালে ইসলাম সম্পর্কে অনেক বদ্ধমূল বিভ্রান্তির অপনোদন হবে। আর যদি তা না করা হয় তাহলে অনন্তকাল পর্যন্ত আমাদেরকে নানা রকমের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও ওযরখাহী (apology) করে যেতে হবে!



মন্তব্য চালু নেই