ইরা’র ভালবাসা | রাঈখ হাতাশি
[১]
যন্ত্রনায় মুখটা বিকৃত হয়্ আসছে হিমার। শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিনে এসে ওর অতীত মনে করার চেষ্টা করছে। কত স্বপ্ন দেখেছে এই সামান্য আয়ুর জীবন নিয়ে কিন্তু এই ঘাতক ব্যাধি, মরন ব্যাধি ওর সমস্থ স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। এখন সে আর কোন স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু মৃতু্যর প্রহর গুনছে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ চিকিৎসা বিদ্যা ওর বাচার আশা দিতে পারে নি। এই মরন ব্যাধিতে প্রতিদিন কতশত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, কেউ তাদের বাঁচাতে পারছে না। হিমাকেও কেউ বাচাতে পারবে না। শরীরের রক্ত বিষাক্ত হয়ে গেছে, নতুন কোষ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাথার যন্ত্রনাও একটু একটু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্মৃতিশক্তিটাও যেন ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সহজেই কিছু মনে করতে পারছে না, পরিচিত জনদের চিনতে কষ্ট হয়্। ওর সাত বছরের মেয়ে ইমাকেও চিনতে কষ্ট হয়। ইমা যখন আম্মু-আম্মু ডাকে অঝোর ধারায় কাঁদে তখন হিমা শুধু ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বোবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে, কে দেখবে তার এই অবুঝ মেয়েটিকে। ইমা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সারান মায়ের পাশে বসে থাকে। গভীর রাতে যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন দেখতে পায় ইমা জেগে আছে নতুবা মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। ইদানিং ইমা খাওয়া-দাওয়ায়ও বড্ড অনিয়ম করছে। পৃথিবীর বিখ্যাত ডাক্তাররা যখন ফিরিয়ে দিয়েছে তখন কেউ আর হিমার বাচার আশা করতে পারে না। আত্মীয় স্বজনরা দেখতে আসে আর করুনার চোখে তাকায়। খুব কষ্ট হয় হিমার। এই জীবন কি সে চেয়েছিল? অন্তত ছোট্র ইমা আর জেরিনের জন্য বেচে থাকার প্রচন্ড ইচ্ছে করছে। খুব কষ্ট হয় জেরিনের জন্য- আহ্ বেচারী। সারাদিন অফিস করে আর নির্ঘুম রাত কাটায় হিমার পাশে। ভালবাসার শ্রেষ্ঠ এই মানুষটিকে কত কষ্টই না দিচ্ছে। জেরিনের সংগে সেই সুখকর দিনগুলো মনে করার চেষ্টা করে হিমা।
হিমা তখন সবে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছে আর জেরিন পড়ছে মেডিকেল-দ্বিতীয় বর্ষে। হিমা বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা গুলোতে লিখছে নিয়মিত। কিছুদিন বাদেই একটি বই বের হল । জাতীয় বই মেলাতে বেশ বিক্রি হল বইটি্ । ইমেইলে এসে জমা হল অসংখ্য ধন্যবাদ সূচক চিঠি। কিন্তু জেরিনের মত করে কেউ লিখে নি, কিংবা লিখতে পারেনি। সেদিনের পর হতেই দুজনের বন্ধুত্বের শুরু। কখনো ক্যাম্পাসে, কখনো পার্কে কিংবা কখনো শহরের কোন অভিজাত রেষ্টুরেন্টে চলতে লাগল দুজনের গোপন অভিসার। হিমা সব সময়ই স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞ ছিল জেরিনের মত একজন আদর্শ বন্ধু পেয়ে।
ডাক্তারী পাশ করল জেরিন্, কিছুদিন দেশে চাকুরী করে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বিদেশ চলে যায়। অনার্স শেষ করে হিমাও চলে যায় জেরিনের কাছে। বিদেশের মাটিতেই বিয়ে হয় ওদের, জন্ম হয় ফুটফুটে ইমার। একদিন দেশে ফেরে, সংগে আদরের ইমা। না জানিয়ে বিয়ে করার কারনে দুজনের মা-বাবাই ছিল ভীষন রাগান্বিত কিন্তু ছোট্র ইমাকে পেয়ে তারা সব রাগ- অভিমান ভূলে যান। হিমা আর জেরিনের সমস্থ স্বপ্ন ছিল একমাত্র ইমাকে ঘিরে। বেচারী জেরিন দিনদিন যেন শোকে পাথর হয়ে যাচ্ছে। কত অসংখ্য মানুষের পূর্ণজীবন দান করেছে সে কিন্তু আজ প্রিয়তমা হিমার কাছে সে অসহায়, তার ডাক্তারী বিদ্যা হিমাকে বাঁচাতে পারবে না।
হিমার বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে মাত্র। জেরিন দু’বছরের বড়্। জীবন তো সবে মাত্র শুরু করেছে আর শুরু না হতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। -আমাকে কিছু একটা করতেই হবে । নিরবে বসে ভাবে জেরিন। যে ইমা আব্বু-আম্মু ডাকে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখত সে-ও এখন নিরবে কাঁদতে শিখেছে, বোবা হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। চাপা কষ্টে বুকটা ভেঙ্গে যায় জেরিনের।
আজ অফিসে যায়নি জেরিন। সকাল হতেই বসে আছে হিমার পাশে। অতি কষ্টে ভেঙ্গে ভেঙ্গে লম্বা সময় নিয়ে অস্পষ্ট ভাবে কিছু কথা বলতে পারে হিমা। জেরিন জানে এভাবে হিমাকে আর বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না।
– জেরিন, ইমাকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল্ তুমি ওকে দেখে রেখ। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল হিমা।
– না হিমা, তোমাকে নিয়ে আমি নতুন করে ভাবছি, এভাবে তোমাকে আমি মরতে দেব না। আমি অবশ্যই একটা ব্যবস্থা করব। আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল জেরিন।
আশার আলো ঝিলিক দিয়ে ওঠে হিমার চোখে। এই আশায় ভর করে যদি আর কটা দিন ইমা আর জেরিনের সংস্পর্শে থাকা যায়। কিন্তু জেরিন তো তাকে কখনো মিথ্যে আশ্বাস দেয় নি।
-তবে কি জেরিন কিছু খুজে পেয়েছে। মনে মনে ভাবে আর জেরিনের চোখে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে হিমা ।
হ্যাঁ, জেরিন কিছু একটা খুজে পেয়েছে। হিমা ল্য করছে বেশ ক’দিন যাবৎ সে অফিসে যাচ্ছে না, বাসার ক্ষুদে ল্যাবরেটরির মধ্যে বসে সারাদিন গবেষনায় ব্যস্ত থাকে। একদিন হাস্যোজ্জ্বল মুখে হিমার পাশে এসে দাড়ায় জেরিন। হিমার শাররীক অবস্থার যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। হাত রাখে হিমার কপালে, পরম তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে হিমা।
– কিছু পেলে জেরিন? প্রশ্ন করে হিমা।
– হ্যাঁ হিমা পেয়েছি। তোমাকে আর মরতে হবে না। তুমি আবার সুস্থ হবে। আবার সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখবে আমাদের ছোট্র ইমা।
হিমার শরীরের রক্তচাপ, তাপমাত্রা, নাড়ীর স্পন্দন সমস্থ কিছু পরীা করল জেরিন। তারপর ধীরে-ধীরে একটি ইংজেকশান পুশ করল হিমার শরীরে।
[২]
নতুন পরিবেশে প্রবেশ করল ইরা। মানিয়ে নিতে কিছু সময় লাগবে ওর। ওর মতো আরো অসংখ্য ইরা এসেছে এই নতুন পরিবেশে; একসাথেই তো ওরা এসেছিল কিন্তু ইরা এখন কাউকে দেখছে না। কোথায় গেল ওরা? ইরা হঠাৎ অনুভব করল সে রক্তের প্রচন্ড স্রোতে ভেসে চলছে- নাহ্ এভাবে নিস্রি্কয় হয়ে থাকলে চলবে না। তাকে যে দায়িত্বটা দেয়া হয়েছে সেটা দ্রুত শেষ করতে হবে, তবেই তার মুক্তি নতুবা বিপদের আশংকা আছে, শত্রুরাই তাকে শেষ করে দিতে পারে। স্রোতের বিপরীত দিকে ছুটে চলছে ইরা, যে করেই হোক তার শত্রুকে খুজে বের করতে হবে। শত্রুকে লুকিয়ে থাকা অথবা শক্তিশালী হবার সুযোগ দেয়া যাবে না। ইরা ছুটে চলেছে শিরা-উপশিরা আর ধমনীর মধ্যে দিয়ে। কিডনী, যকৃত, ফুসফুস সর্বত্র তল্লাসী চালাল, শত্রুকে খুজল শরীরের প্রতিটি কোষের ভাঁজে-ভাঁজে। অবশেষে মস্তিস্কের ভিতর প্রবেশ করল। পরিচিত একটা ঘ্রান অনুভব করে সে। ছোট একটা কলোনীর মধ্যে প্রবেশ করে, সবাই মনে হচ্ছে কর্মব্যস্ত। ধীরে-ধীরে এগিয়ে যায় ইরা, শত্রুকে খুজছে সে ।
– ওই তো নিউরনের আড়ালে লুকিয়ে আছে। আপন মনে বলল ইরা।
শত্রুর সামনে এগিয়ে যায় সে। ইরাকে দেখে ভয়ে আড়ষ্ট হয় শত্রু। ইরাও অবাক হয় সামনের শত্রুটি যেন তারই প্রতিরূপ। নিজেকে ভালভাবে একবার দেখে নেয় আবার তাকায় শত্রুর দিকে।
– কে তুমি? প্রশ্ন করে ইরা।
– আমি? আমি ইরা। ভয়ে-ভয়ে উত্তর দেয় শত্রুটি।
অবাক হয় ইরা- নাহ্ ,আমি ইরা। সত্যি করে বল কে তুমি? ইরা আবার প্রশ্ন করে।
– আমি ইরা। দৃঢ় কন্ঠে বলে শত্রু।
– তুমি ইরা? তুমি ইরা হলে তাহলে আমি কে? অবিশ্বাসের সূরে ইরা প্রশ্ন করে।
– তুমিও ইরা। তবে নকল ইরা আর আমি আসল ইরা।
– আমি নকল ইরা? কি বলছ তুমি? অবাক হয় ইরা।
– তুমি নকল আর আমি আসল ইরা। এখন বল কি চাও তুমি, কেন এসেছ এখানে? সাহস ভরে বলে আসল ইরা।
– আমি এসেছি তোমাকে ধ্বংস করতে । তোমার মৃতু্যর পরোয়ানা নিয়ে এসেছি। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল নকল ইরা।
– কেন? আমিতো তোমার কোন তি করিনি।
– অতসব বুঝি না্, আমি তোমাকে হত্যা করব।
– নাহ্ , করুন সূরে বলে আসল ইরা্। আমি তো তোমার কোন তি করি নি। কেন আমাকে হত্যা করবে? আমাকে ভাল ভাবে দেখ, নিজেকে দেখ, আমাতে-তোমাতে তো প্রভেদ নেই। আমি তো তোমার কোন শত্রু নই, বন্ধু। তুমি তো আমারই অপভ্রংশ, আমারই প্রতিরূপ। আমা হতে কোনিংয়ের মাধ্যমে তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে কিন্তু আমি দূর্বল আর তুমি শক্তিশালী। আমরা বন্ধু হয়ে থাকব আজীবন। বন্ধু, এই পৃথিবী তো আমার আর তোমার তবে কেন তুমি আমাকে হত্যা করতে চাও বল?
দোটানায় পড়ে যায় নকল ইরা। নিউরনের আড়াল হতে বেরিয়ে আসে আসল ইরা। আবার বলতে লাগল আসল ইরা- তুমি জান না বন্ধু, এই পৃথিবী একদিন তো আমাদেরই ছিল। এখানে ছিল না কোন মানুষ, ছিল না কোনপ্রাণী। এখানে ছিল শুধু ইরা নামের অনুজীব আর আমাদের বিভিন্ন প্রজাতী এবং বংশধরেরা । জল-স্থল আর শূন্যে ছিল আমাদেরই আধিপত্য। কিন্তু বিবর্তনের ধাপে-ধাপে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন প্রানী এবং মানুষ আর আমরা বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাই। আমরা কি পারি না আবার নিজেদের রাজত্ব ফিরিয়ে আনতে? আমরা তো মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ বুদ্ধিমান জীব। নিজেদের একমাত্র বুদ্ধিমান দাবীকৃত মানুষরা আমাদের কাছে একদম অসহায়। তবে কেন আমরা দূর্বল মানুষদের কাছে নিজেদের ধ্বংস করে দেব? আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়, কিভাবে বংশ বৃদ্ধি করতে হয়, জীবন ধারনের মৌলিক উপাদান কি কি। সব, সব শিখিয়ে দেব তোমাকে। আমার মৃতু্যর পর ওরা তোমাকেও বাঁচতে দেবে না। মেরে ফেলবে তোমাকেও। ওরা বড় নিষ্ঠুর, আমি মানুষ জাতিকে চিনি বন্ধু । তুমি আমার চোখে তাকাও, দেখ আমাকে, আমরা তো একই প্রজাতি।
ইরা শত্রু দ্বারা প্রভাবিত হতে চায় না। আত্মরার জন্য শত্রু তাকে এসব বলছে। শত্রুর সামান্য কথায় সে তার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে না। এসব ভাবে আর তাকায় শত্রুর দিকে, যেন করুন আকুতি ঝরে পড়ছে শত্রুর কন্ঠে- বন্ধু, তুমি একটু ভেবে দেখ। আমাতে আর তোমাতে তো প্রভেদ নেই।
কেন আমরা নিজেদের মানুষের মত বোকা আর নিম্নবুদ্ধির হীন জীব হিসাবে প্রমান করব? তারা নিজেরাই তো একে অপরকে হত্যা করে ধ্বংস ডেকে আনছে। বুদ্ধিমান জীব কখনো নিজেদের ধ্বংস করে না। তবে কেন আমরা এক অপরকে হত্যা করব?
– নাহ্ , ওকে আর সুযোগ দেয়া যাবে না। প্রি গতিতে ইরা শত্রুর দিকে এগিয়ে যায়। শত্রুটি করুন চোখে তাকায় ইরার দিকে, তাকায় খুব অবাক চোখে যেন নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছে না মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ বুদ্ধিমান জীব পরস্পরকে হত্যার মাধ্যমে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছে। ইরার শত্রু ইরাকে বাধা দেয় না।
শত্রুর মৃতদেহটা রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে দেয় ইরা। বিজয়ের হাসি হাসে সে। তার কাজ শেষ। এখন তার মুক্তি। এখন তাকে যেতে হবে।
চমকে ওঠে ইরা- কিন্তু সে কোথায় যাবে? কি খাবে, কিভাবে জীবন ধারন করবে? ছটফট করে ওঠে সে। এতসব তো আগে ভাবে নি। যথেষ্ট জীবনী শক্তি নিয়ে সে এই পরিবেশে এসেছিল, কিন্তু এখন শরীরের শক্তি ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। সে জানে না কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়? জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় উপাদান কি কি? এই পরিবেশটা ধীরে ধীরে ওর জন্য প্রতিকুল হয়ে যাচ্ছে। রক্তের গতিবেগ বাড়ছে, তাপমাত্রাটাও অসহ্য লাগছে। কেউ যেন রক্তের মধ্যে নতুন কোন উপাদান ছেড়ে দিয়েছে। ওর শরীরটা প্রচন্ড জ্বালাপোড়া করছে। হঠাৎ সে দেখতে পায় তার সেই বন্ধুদের যারা তার সাথে এখানে একই সময়ে এসেছিল। তাদের কারো মৃতদেহ, করো অবচেতন দেহ ভেসে চলছে রক্তের স্রোতে। ইরা অনুভব করছে তার জীবনী শক্তি ফুরিয়ে আসছে, শরীরটা নিশ্চল হয়ে যাচ্ছে। দ্রুতবেগে সে ছোটে শিরা-উপশিরা আর ধমনীর মধ্য দিয়ে। তন্নতন্ন করে সে তার শত্রুকে খোঁজে, যে তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জীবন ধারনের কৌশল শিখিয়ে দেবে বলে, বংশ বিস্তারের কৌশল শিখিয়ে দেবে বলে। অনেক কষ্টে তাকে খুজে পায় কিন্তু তার শত্রু এখন মৃত। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে অন্যত্র তাকায় ইরা। নিজের প্রতি ঘৃনার সৃষ্টি হয়। রক্তে সৃষ্ট নতুন উপাদানের প্রতিক্রিয়ায় ইরার শরীর পুড়ে যাচ্ছে। কর্মমতা ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে। ফিরে যায় সেই কলোনীতে যেখানে আসল ইরা এই কোনিং ইরাকে বন্ধু বলে ডেকেছিল, বলেছিল ‘বন্ধু আমাতে তোমাতে কোন প্রভেদ নেই, তুমি আমায় হত্যা করো না, আমরা বন্ধু হয়ে থাকব আজীবন’। নিউরনের ফাঁকে-ফাঁকে আশ্রয় খোজে। নাহ্ , তার জন্য কোথাও একটু আবাসস্থল নেই, বিধ্বস্থ কলোনীর সবাই মৃত আর বিষাক্ত পরিবেশ। ধমনীর মধ্য দিয়ে রক্তের স্রোতের বিপরীতে চলার চেষ্টা করে কিন্তু সেই শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই এখন। এই প্রচন্ড স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার সাধ্য তার নেই। নিজের প্রতি প্রচন্ড ঘৃনা আর ক্ষোভে, কেন সে শত্রুকে বুঝতে চেষ্টা করে নি? রক্তের স্রোতের অনুকুলে নিজেকে ছেড়ে দেয় ইরা। প্রচন্ড স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে তার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে সামান্য অতীত। ইরার অতীত বলতে এই নতুন পরিবেশ আর শত্রুর সাথে সাাতের সময়টুকু। বারবার মনে পড়ে শত্রুর করুন আকুতি।
ইরা প্রকৃত সত্য অনুভব করে যে, প্রকৃত পক্ষে মানুষই মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ বুদ্ধিমান ও আদর্শ প্রাণী এবং তারা টিকে থাকবে অনন্তকাল। তারমত অনুজীব ইরা’রা মানুষদের কিছুই করতে পারবে না। তার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে কথিত আসল ইরার করুন আকুতি। শত্রুর প্রতি একপ্রকার অপার্থিব ভালবাসার সৃষ্টি হয় ইরার। ইরা নামের ভাইরাসটির নিশ্চল দেহটি ভেসে চলছে রক্তের স্রোতে।
[৩]
একদিন হাসি ফুটে ইমার মুখে। শুস্ক ঠোটে হাসার চেষ্টা করে হিমাও। বিজয়ীর চোখে হিমার দিকে তাকায় জেরিন। জেরিনের কাঁধে ভর করে হাটছে হিমা। অন্য একটি হাত ধরে আছে ইমা। কিছুতেই সে মায়ের হাতটি ছাড়তে রাজী নয়। স্পষ্টতই কথা বলতে পারছে হিমা। সবাইকে চিনতে পারছে সহজেই, সব কিছুই এখন স্বাভাবিক। শুধু বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে শরীরে একধরনের জড়তা এসে গেছে, পা দু’টো শরীরের ভর সঠিক ভাবে নিতে পারছে না, হাটতে কিছুটা কষ্ট হয়। কিছুদিন পর সেটাও ঠিক হয়ে যায়। হিমা এখন সমপূর্ণ সুস্থ। আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে সে, প্রাণ ফিরে পেয়েছে ইমা এবং জেরিনও।
ডাঃ জেরিনের বাড়ি ভরে গেছে দেশ-বিদেশের অসংখ্য সাংবাদিকদের ভিড়ে। জনাকীর্ন এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে এখানে। হিমা এবং ইমাকে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে জেরিন। মুহূর্তেই ঝলসে ওঠে অসংখ্য ক্যামেরার ফাশ আর শরীরের ওপর আপতিত হয় ভিডিও ক্যামেরার তীব্র আলো। স্মিত হেসে ধীর পদেেপ মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাড়ায় ডাঃ জেরিন। মুহুমুহু করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে এতদিন শোকে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা বাড়িটি।
লেখক : এ্যাক্টিং এইচআইভি/এইডস স্পেশ্যালিস্ট, আখাউড়া—লাকসাম ডাবল লাইন রেলওয়ে প্রজেক্ট।
মন্তব্য চালু নেই