ইতিহাসের অন্তরালের ক’জন নারী বিপ্লবী

ইতিহাস রচিত হয় ক্ষমতাবানদের হাতে। আর তাই, ক্ষমতাসম্পর্কের নিরিখেই নির্মিত হয় ঐতিহাসিক বাস্তবতা। নিজ নিজ সময় আর সম্পর্কসূত্রকে অতিক্রম করে সমাজে ন্যায় আর সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিজেদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে কুন্ঠাবোধ করেননি যারা; তাদের মধ্যে রয়েছেন নারীরাও। তবে ক্ষমতাশালীদের ইতিহাসের পুরিুষতান্ত্রিক বয়ানে তারা মোটামোটি উপেক্ষিতই বলা চলে। সেসব নারীদের কেউ বিপ্লব করেছেন অস্ত্র হাতে, কেউবা আবার সঙ্গী করেছিলেন লেখনিকে। শারীরিক মৃত্যুর পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিকতার বলয়ে হয়তো ইতিহাস থেকে মুছে গেছে সেইসব নারী-বিপ্লবীর নাম।

0002

কন্সট্যান্স মার্কিভিজ

অ্যাংলো-আইরিশ এ কাউন্টেস একাধারে ছিলেন সিন ফেইন এবং ফিয়ানা ফেইল দলের রাজনীতিবিদ, বিপ্লবী এবং সমাজকর্মী। ১৯১৬ সালে ইস্টার বিপ্লব থেকে শুরু করে আইরিশদের বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ইস্টার বিপ্লবের সময় এক ব্রিটিশ স্নাইপারকে আহত করেন তিনি। ৭০ এর দিকে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী যাকে নির্জন কারাবাস দেয়া হয়েছিল। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলেও তা কার্যকর করা হয়নি। এ নিয়েও নানা অপব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে প্রসিকিউটিং কাউন্সিল। তাদের দাবি, নারী হওয়ার কারণে প্রাণভিক্ষা দেয়া হয়েছে তাকে।

মার্কিভিজই প্রাণক্ষিা চেয়েছেন বলেও দাবি করেন তারা। তবে কোর্ট রিপোর্ট বলে অন্য কথা।তিনি আসলে বলেছিলেন, ‘আমি কামনা করছি আমাকে গুলি করার মত যোগ্যতা তোমাদেও থাকুক।’ মার্কিভিজ হলেন পৃথিবীর প্রথম নারী যিনি মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত আইরিশ শ্রমমন্ত্রী ছিলেন মার্কিভিজ। একইসঙ্গে তিনিই প্রথম নারী যিনি ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ হাউজ অব কমন্সে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। অবশ্য সিন ফেইনের নীতির কারণে সে পদ প্রত্যাহার করে নেন তিনি।

0003

নাদেজদা ক্রুপসকায়া

বেশিরভাগ মানুষই ক্রুপসকায়াকে ভ্লাদিমির লেনিনের স্ত্রী হিসেবেই চিনে থাকেন। কিন্তু ক্রুপসকায়া নিজেই ছিলেন একজন বলশেভিক বিপ্লবী ও রাজনীতিবিদ। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তাঁর। বলশেভিক বিপ্লবের পর নিজেকে শিক্ষা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করেন ক্রুপসকায়া। শ্রমিক এবং কৃষকদের শিক্ষা সুবিধা দেয়ার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। সবার হাতের নাগালে গ্রন্থাগার পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছেন ক্রুপসকায়া। ১৯২৯ সাল থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের উপ-শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন এ বিপ্লবী।

0004

পেত্রা হেরেরা

মেক্সিকো বিপ্লবের সময় নানা গঞ্জনা উপেক্ষা করে পুরুষ সেনাসদস্যদের পাশাপাশি রণক্ষেত্রে যোগ দিয়েছিলেন নারী যোদ্ধারা। এমনই এক সৈনিকের নাম পেত্রা হেরেরা। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে নারী হিসেবে যাননি তিনি। নিজের পরিচয় গোপন করে পুরুষ সেজে যোগ দিয়েছিলেন যুদ্ধে। এর জন্য নিজের নামও পাল্টাতে হয়েছিল তাকে। পেত্রা হেরেরা থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন পেদ্রো হেরেরা। রণক্ষেত্রে শক্তিশালী নেতৃত্বের কারণে ব্যাপক সম্মান কুঁড়িয়েছেন তিনি।

আর সময়ের সাথে সাথে নিজের সত্যিকার পরিচয় প্রকাশে সমর্থ হয়েছিলেন পেত্রা। থেমে থাকেনি তাঁর বিপ্লবী চেতনাও। ১৯১৪ সালের ৩০ শে মে আরও প্রায় ৪শ’ নারী যোদ্ধার সঙ্গে দ্বিতীয় তোরিয়ন যুদ্ধে অংশ নেন এ বিপ্লবী। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোন নারী যোদ্ধাকে কৃতিত্ব দিতে এবং জেনারেলের কাছে তাকে পরিচিত করাতে ইচ্ছুক ছিলেন না দলের নেতা পানচো ভিলা। আর তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে ভিলার বাহিনী ছেড়ে সকল নারী ব্রিগেডদের নিয়ে নিজস্ব একটি বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন পেত্রা।

0005

নোয়ানইরুয়া

নাইজেরিয়ার ইগবো গোত্রে জন্ম নেয়া এ নারী ছোটখাটো যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। পশ্চিম আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক সময়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন নোয়ানইরুয়া। ঘটনার সূত্রপাত, ১৯২৯ সালের ১৮ই নভেম্বর। মার্ক ইমেরিউয়া নামে এক জরিপকারী যখন নোয়ানইরুয়াকে ছাগল, ভেড়াসহ পরিবারের সদস্য সংখ্যার হিসেব দিতে বললেন তখনই ক্ষোভে ফেটে পড়েন এ বিপ্লবী।

সেসময় নারীদের উপর কর আরোপের নিয়ম না থাকলেও নোয়ানইরুয়া বুঝতে পারলেন, তাদের উপর অন্যায়ভাবে কর আরোপের পাঁয়তারা চলছে। আর তখনই শুরু। গোত্রের অন্যান্য নারীদের সঙ্গে নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ডাক দেন নোয়ানইরুয়া। দুই মাস ধরে স্থায়ী থাকা এ বিক্ষোভে যোগ দেন অঞ্চলের প্রায় ২৫ হাজার নারী। একইসঙ্গে কর আরোপ আর ওয়ারেন্ট প্রধানদের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে তাদের কন্ঠ। শেষ পর্যন্ত নোয়ানইরুয়াদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। কর আরোপের পরিকল্পনা প্রত্যাহারসহ অনেক ওয়ারেন্ট প্রধান তখন পদত্যাগে বাধ্য হন।

0006

লক্ষ্মী সেহগাল

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিপ্লবীর নাম লক্ষ্মী সেহগাল। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির এ কর্মকর্তা। ৪০ এর দশকে ঝাঁসি রাণি রেজিমেন্টকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লক্ষ্মী। মূলত ভারতীয় উপনিবেশে ব্রিটিশ রাজত্ব ঠেকাতেই গড়ে তোলা হয়েছিল এ রেজিমেন্ট। ১৮৫৭ সালে ভারতীয় বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী নারী বিপ্লবী লক্ষ্মী বাইয়ের নামে রেজিমেন্টটির নামকরণ করা হয়েছিল যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার হাতে গোণা নারী রেজিমেন্টগুলোর একটি। পরবর্তীতে আজাদ হিন্দ সরকারের নারী বিষয়ক মন্ত্রী হয়েছিলেন লক্ষ্মী সেহগাল।

0007

সোফি স্কল

জার্মান বিপ্লবী সোফি স্কল ছিলেন নাৎসীবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের সংগঠন হোয়াইট রোজের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ক্রমাগত লিফলেট আর গ্রাফিতি ক্যাম্পেইনের মধ্য দিয়ে হিটলারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সংগঠনটি। ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে লিফলেট বিতরণ করতে গিয়ে গ্রেফতারের শিকার হয়েছিলেন সোফিসহ আরও বেশ ক’জন। একই বছরের শেষ নাগাদ অনেকগুলো লিফলেট ‘মিউনিখের শিক্ষার্থীদের মেনিফেস্টো’ এমন শিরোনামে জার্মানির বাইরে চলে যায়। পরে মিত্র বাহিনী বিমান থেকে লাখ লাখ লিফলেট জার্মানিতে ছুঁড়ে ফেলে ।

0008

সেলিয়া স্যানশেজ

কিউবার বিপ্লবী নেতা বলতেই সবাই এক বাক্যে চে গুয়েভারা কিংবা ফিদেল কাস্ত্রোর কথা বললেও সেলিয়া স্যানশেজের নাম শুনেছেন এমন মানুষ বোধহয় কমই আছেন। কিউবার বিপ্লবের প্রাণ ছিলেন এ নারী। এমনকি তিনি এ বিপ্লবের মূল সিদ্ধান্ত গঠনকারী ছিলেন বলেও শোনা যায়। ১৯৫২ সালের ১০ই মার্চ অভ্যুত্থানের পর বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দেন সেলিয়া। ‘২৬ শে জুলাই মুভমেন্টের’ প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি।

বিপ্লবের পুরো ভাগজুড়ে কমব্যাট স্কোয়াডের নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে বাতিস্তা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ৮২ জন যোদ্ধা নিয়ে মেক্ষিকো থেকে কিউবায় আসা রণতরীটি ‘গ্র্যানমা’-কে নিরাপদে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছিলেন সেলিয়া। বিপ্লবের পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাস্ত্রোর সঙ্গেই ছিলেন তিনি।

0009

আসমা মাহফুজ

আধুনিক সময়কার বিপ্লবী নারী আসমা মাহফুজ। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে একটি ভিডিও ব্লগ পোস্টের মধ্য দিয়ে মিশরের তাহরীর স্কয়ারে সরকারের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলনে যোগ দিতে সবাইকে উৎসাহিত করেন তিনি। আর তাতে সাড়া দিয়ে সে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন লাখ লাখ মিশরীয় নাগরিক। তাকে মিশর বিপ্লবের এক পরাক্রমশালী সৈন্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।



মন্তব্য চালু নেই