আসছে বৃহত্তর বিএনপি ওরফে জামায়াতে ইসলামি!
সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে জোটে থাকা ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দলগুলোর নাম বিলুপ্ত করে এক হয়ে পথচলা শুরু করতে চায় বিএনপি। সাংগঠনিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় এ ব্যাপারে শরিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকদের অনেকেই আগ্রহী। মিত্র দলগুলোর মতাদর্শ এক হওয়ায় বিএনপি সবাইকে নিয়ে একীভূত হয়ে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের অক্টোবর অথবা নবেম্বরে জাতীয় কাউন্সিলে ২০ দলীয় জোট বিলুপ্ত করে একীভূত বিএনপির ঘোষণা আসতে পারে।
এর মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে নতুন করে চমক দিতে চায় সাবেক বিরোধী দল। এদিকে একাধিক শরিক দল জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি নামে একীভূত হতে নারাজ। এমন বাস্তবতায় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে শেষ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামসহ জোটের ইসলামী দলগুলো একীভূত হওয়ার তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারে। বিএনপিসহ শরিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস মিলেছে।
২০ দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দ বলছেন, ছোট ছোট দলগুলোর কার্যক্রম বিলুপ্ত করে একীভূত হতে এখনও বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়া হয়নি। তবে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে দূতিয়ালির জন্য কয়েকজন শীর্ষ নেতাকেও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে দেশের বাইরে যাবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এর আগেই একীভূত বিএনপির ব্যাপারে বৈঠক হতে পারে। এ ব্যাপারে পৃথক পৃথকভাবে শরিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন।
সূত্রগুলো বলছে, একীভূত হতে ইতোমধ্যে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) থেকে বিএনপির কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোন সাড়া মেলেনি। এলডিপি নেতারা বলছেন, আনুষ্ঠানিক সাড়া না আসলেও বিভিন্নভাবে আলোচনা এগিয়ে যাচ্ছে। জানতে চাইলে দলটির যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম প্রতিবেদককে বলেন, বিএনপির সঙ্গে একীভূত হতে আমাদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠানো হলেও কিছু চাওয়া পাওয়ার বিষয় তো রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, একীভূত হলে আমাদের দলের শীর্ষ নেতাদের অবস্থান কি হবে তা ঠিক করা। এছাড়া এলডিপিতে অন্তত এক ডজন সাবেক মন্ত্রী এমপি আছেন। আগামী নির্বাচনে এসব নেতাদের মনোনয়ন দেবে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। একীভূত হওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করতে সহসাই দলের প্রতিনিধি সভা অনুষ্ঠিত হবে।
তিনি বলেন, ইসলামী ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো বিএনপি নামে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে বাদ যাবে। বিএনপির লক্ষ্য সব দলকে এক করে নতুন করে এগিয়ে যাওয়া। আগামী অক্টোবর অথবা নবেম্বরে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে সম্ভবত এক হওয়ার ঘোষণা আসতে পারে। এর আগেই সবকিছু চূড়ান্ত হবে।
দল বিলুপ্ত করে এক হয়ে পথচলা শুরু করতে বিকল্পধারা বাংলাদেশ পক্ষ থেকে বিএনপিকে তিনদফা শর্ত দেয়া হবে। প্রথম শর্তের মধ্যে রয়েছে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দেয়া। অন্যান্য শর্তসমূহের মধ্যে রয়েছে; দলের শীর্ষ নেতাদের সম্মানজনক পদে বসানো, নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন ও অহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচী। শর্ত মানলে বিএনপির সঙ্গে একীভূত হবে দলটি।
বিকল্পধারা নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, বিএনপিতে এক হওয়ায় প্রশ্নে দলের বেশিরভাগ নেতাই একমত। আবার কেউ কেউ এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। দলের নেতারা মনে করেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিকল্পধারার রাজনৈতিক সফলতা বলতে কিছু নেই। বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করার পর থেকে কোন নির্বাচনেই দলের কেউ বিজয়ী হতে পারেননি। সঙ্গত কারণেই এককভাবে বিকল্পধারার রাজনীতিতে টিকে থাকা কঠিন হবে।
এছাড়া এরশাদের জাতীয় পার্টি, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও মাহামুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন দল নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে জোট গঠনের চেষ্টাতেও সফল হননি বি চৌধুরী। এই প্রেক্ষাপটে সম্মানজনক অবস্থানে থেকে বিএনপিতে যোগ দিলে রাজনৈতিকভাবে তেমন একটা লোকসানের মুখে পড়বে না তারা। দলের মহাসচিব মেজর অব. এম এ মান্নান বিএনপিতে যোগ দেয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
ঐক্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিকল্পধারার সহ-সভাপতি কার্তিক ঠাকুর এই প্রতিবেদককে বলেন, একীভূত হওয়ার বিষয়টি এগিয়ে নিতে দুই দলের মধ্যে এখনও মুখপাত্র ঠিক হয়নি। তবে অগ্রগতি আছে। ইতোমধ্যে বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরেছেন। এ ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে একটি বৈঠক হতে পারে। বৈঠকে বিকল্পধারা বিলুপ্তি না বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করবে এ বিষয়টি প্রধান্য পাবে বলে জানান তিনি।
তিনি জানান, দু’পক্ষের মধ্যে সকল অনিশ্চয়তা কেটেছে। সব ঠিক থাকলে আগামী সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে বিকল্পধারা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হতে পারে। তিনি জানান, বিকল্পধারা ও এলডিপি বিএনপিতে একীভূত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। বিকল্পধারার এই শীর্ষ নেতা আরও বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে বিএনপিকে কিছু শর্ত দেয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে- জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দেয়া। এই দলটি ছাড়া বিএনপির সঙ্গে পথ চলতে কোন আপত্তি নেই।
ডাঃ বি চৌধুরী ও কর্নেল অলি আহমেদ দুজনেই বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে তারা পৃথক দল গঠন করেছেন। অপমান করে বিএনপি থেকে দুই দলের এই দুই নেতাকে বাদ দেয়া হয়েছিল। তবুও বিএনপি জোটের সঙ্গে যুগপত আন্দোলনে আছে বিকল্পধারা। অলির দল বিএনপি জোটের অন্যতম শরিক। যদিও মেয়র নির্বাচনে বিকল্পধারার পক্ষ থেকে মাহি বি চৌধুরীকে মনোনয়ন দিতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন বি চৌধুরী। তাতে কাজ হয়নি। সম্পর্কের অবনতিও হয়নি। বিকল্পধারার ইফতার পার্টিতে আসেন বিএনপি চেয়ারপার্সন।
সরকারবিরোধী বক্তব্য ও মন্ত্রী সাংসদদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বি চৌধুরী ও অলি কঠোর সমালোচনা করায় দলছুট নেতাদের প্রতি আস্থা বেড়েছে বিএনপির। তাছাড়া সাংগঠনিক অবস্থা পুনর্গঠনেরও উদ্যোগ নিয়েছেন খালেদা জিয়া। এরই ধারাবাহিকতায় দলছুট নেতাদের ফিরিয়ে আনতে গোপনে দূতিয়ালি চালিয়েছে যাচ্ছেন বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ২০০১ সালের ১ অক্টোবর সরকার গঠন করলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি বানানো হয়। কিছুদিন না যেতেই দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয় তাঁর। যার রেশ ধরে এক বছরেরও কম সময়ে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বিদায় নেন অধ্যাপক ডাঃ একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুদিন নীরব থাকেন বি চৌধুরী। প্রায় এক বছর অপেক্ষায় থাকার পর সমমনাদের নিয়ে গঠন করেন নতুন রাজনৈতিক দল বিকল্পধারা বাংলাদেশ।
একইভাবে বিএনপি সরকারের শেষদিকে এসে দুর্নীতি-দুঃশাসনের অভিযোগ এনে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য কর্নেল (অব) অলি আহমদ। বিএনপির ডাকসাইটে ও প্রভাবশালী কিছু মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যকে নিয়ে তিনি গঠন করেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। পরবর্তী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বি. চৌধুরী এবং কর্নেল (অব) অলি আহমেদ একসঙ্গে পথ চলার সিদ্ধান্ত নেন।
সেই সিদ্ধান্তের আলোকে ২০০৬ সালের ২৬ অক্টোবর বিকল্পধারা বাংলাদেশ একীভূত হয় এলডিপিতে। বি. চৌধুরী চেয়ারম্যান এবং কর্নেল (অব) অলি আহমেদ কো-চেয়ারম্যান হন দলটির। যদিও তাদের এ মধুচন্দ্রিমা সুখের হয়নি। কিছুদিন না যেতেই আলাদা হয়ে যান দুই নেতা। বি. চৌধুরী তার প্রতিষ্ঠিত দল বিকল্পধারা বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন করে পথ চলা শুরু করেন। অন্যদিকে কর্নেল (অব) অলি আহমদ পথ চলতে শুরু করেন এলডিপি নিয়েই।
সাংগঠনিক অবস্থা বেহাল হওয়ায় বিএনপির সঙ্গে একীভূত হতে চাচ্ছে আরেক শরিক জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর)। এ ব্যাপারে শনিবার রাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেছেন বারবার দলছুট নেতা জাফর। জানতে চাইলে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য আহসান হাবিব লিংকন প্রতিবেদককে বলেন, বিএনপিতে একীভূত হওয়ার বিষয়ে আলোচনা শোনা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের দলের আপত্তি নেই। তবে বিএনপির আগ্রহের বিষয়টি এখনও স্পষ্ট হয়নি। ২০ দলের নেত্রী দেশের বাইরে যাওয়ার আগেই এ ব্যাপারে একটি বৈঠক হতে পারে বলে জানান তিনি।-জনকণ্ঠ
মন্তব্য চালু নেই