আল কায়েদার শেষ জিহাদিরা
২০০১ সালের টুইন টাওয়ার হামলার কথা বিশ্বের মানুষ আজও ভুলে যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেমন বিশ্বে শত্রু মিত্রের সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল, তেমনি টুইন টাওয়ার হামলা ঘটনার পরও বিশ্ব প্রচ্ছন্নভাব দুই মেরুতে ভাগ হয়ে যায়। এক মেরুতে অবস্থান করছে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করছে এবং অন্য মেরুতে আছে যারা নিজেরাই ‘সন্ত্রাসী’। যদিও ওই নির্দিষ্ট গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়গুলো যে সন্ত্রাসী তাও নির্ধারণ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো। এই যুক্তরাষ্ট্রই নাইন ইলেভেনের ঘটনার পর বিশ্ববাসীর সামনে পরিচয় করিয়ে দেয় ‘আল কায়েদা’ নামের একটি সংগঠনকে।
আল কায়েদা সংগঠনটির প্রধান ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। আরববিশ্বসহ বিভিন্ন দেশে আল কায়েদার অঙ্গ সংগঠন খুলতে এবং কার্যক্রম পরিচালনা করতে ওসামা বিন লাদেন ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ২০১১ সালের ১৬ জুন তারিখে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন নেভির সিল বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন লাদেন। এরপরই মূলত আল কায়েদার কমান্ডিং সেক্টরের উপর নেমে আসে মার্কিন আগ্রাসন। ইয়েমেন থেকে শুরু করে পাকিস্তানে পর্যন্ত অনেক আল কায়েদা নেতাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু এতোকিছুর পরেও আল কায়েদা মার্কিন আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। বর্তমানে যারা আল কায়েদার নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে দেয়া হলো।
আয়মন আল জাওয়াহিরি
মিসরের জিহাদি গ্রুপ ‘ইসলামিক জিহাদ’ প্রতিষ্ঠা করেন আয়মন আল জাওয়াহিরি। তবে ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পরেই সংগঠনটির নাম পাল্টিয়ে আল কায়েদার অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে আল কায়েদা এক বিবৃতিতে জানায়, তাদের নতুন নেতা জাওয়াহিরির নেতৃত্বেই এখন থেকে তারা জিহাদ চালিয়ে যাবে। বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠন বিষয়ক গবেষকদের মতে, জাওয়াহিরি হলেন আল কায়েদার ‘মূল মস্তিস্ক’। ওসামা বিন লাদেনের পর জাওয়াহিরিই আল কায়েদার সর্বোচ্চ নেতা। আল কায়েদার নেতা ছাড়াও জাওয়াহিরি আফগানিস্তানের তালেবান গোষ্ঠির একাংশের নিয়ন্ত্রন করেন বলেও জানা যায়। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের দামাদোলা গ্রামে জাওয়াহিরিকে হত্যার জন্য একটি হামলা চালায়। এই হামলায় ১৮জন সাধারণ গ্রামবাসী মারা যায়। কিন্তু জাওয়াহিরিকে খুঁজে পায়নি মার্কিন বাহিনী।
নাসের আবদুল করিম আল ভুহাইশি
আল কায়েদার প্রয়াত নেতা ওসামা বিন লাদেনের ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে পরিচিত ছিলেন নাসের আবদুল। ২০০৯ সালে সৌদিআরব এবং ইয়েমেনের মধ্যকার কিছু স্বশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে আল কায়েদার সম্পর্ক স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা সিএনএন’র মতে, বর্তমানে নাসের আল কায়েদার সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন। আফগানিস্তান-পাকিস্তান অঞ্চলে আল কায়েদার অবস্থান শক্তিশালী করতে দীর্ঘদিন ধরেই তিনি কাজ করছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়। ২০১২ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় ‘দ্য লিবিয়ান’ নামে খ্যাত আবু ইয়াহায়া আল লিবি নিহত হওয়ার পর তার স্থানে স্থলাভিষিক্ত হন নাসের আবদুল করিম আল ভুহাইশি। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার মুখে তিনি কোনোমতে পালিয়ে ইরানে চলে যান। পরবর্তীতে সেখান থেকে তিনি ইয়েমেনে চলে যান এবং আল কায়েদার নেটওয়ার্ক তৈরিতে মনোনিবেশ করেন।
খালিদ আল হাবিব
খালিদ আল হাবিবের সত্যিকারের জাতীয়তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ২০০৫ সালে মার্কিন প্রশাসন খালিদকে মিসরীয় অথবা মরক্কোর অধিবাসী বলে ঘোষণা দেয়। ২০০৬ সালের দিকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা এক রিপোর্টে জানায়, মার্কিন বিমান হামলায় মারা গেছেন খালিদ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ এই ঘোষণা থেকে সরে আসে। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে তাকে আল কায়েদার ‘মিলিটারি কমাণ্ডার’ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
সাঈফ আল আবদেল
সাঈফ আল আবদেল আগে ছিলেন একজন মিসরের সেনাবাহিনী একজন কর্ণেল। তখন তার নাম ছিল মুহাম্মদ ইব্রাহিম মাক্কাওয়াই। কিন্তু আল কায়েদায় যোগ দেয়ার পর নাম পরিবর্তন করে আত্মগোপনে চলে যান তিনি। ১৯৮০ সালের দিকে তিনি আফগানিস্তানে যান এবং সেখানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে মুজাহিদিনদের হয়ে লড়াই করেন। একটা সময় পর্যন্ত তিনি ওসামা বিন লাদেনের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ছিলেন এবং ২০০১ সালে সংগঠনটির মিলিটারি কমান্ডার মুহাম্মদ আতেফ মারা যাওয়ার পর সেই স্থানে স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। ১৯৯৮ সালে পূর্ব আফ্রিকায় মার্কিন দূতাবাসে হামলার জন্য তাকে দায়ি করা হয়। ধারণা করা হয় ২০০১ সালের শেষার্ধে সুলেইমান আবু ঘাইথ এবং সাদ বিন লাদেনকে (ওসামা বিন লাদেনের পুত্র) নিয়ে শরীফ আল আবদেল পালিয়ে ইরান চলে যান। সেখানে ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলেশনারি গার্ডদের হাতে তারা গ্রেপ্তার হন। যদিও ইরান কখনোই তাদের অবস্থানের কথা স্বীকার করেনি। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী আবদেল এখন পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলে অবস্থান করছেন।
মুস্তফা হামিদ
শরীফ আল আবদেলের শ্বশুর ছিলেন মুস্তফা হামিদ। জালালাবাদের নিকটস্থ আল কায়েদার ক্যাম্পের ট্যাকটিক্যাল অফিসার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। ইরানের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক থাকায় স্বশস্ত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে ইরানের যোগাযোগ ঘটানো তার পক্ষে সহজ ছিল। আফগানিস্তান থেকে তালেবানরা ক্ষমতাচ্যুত হলে মুস্তফা তার পরিবার পরিজন নিয়ে ইরানে চলে যান। ২০০৩ সালের মাঝামাঝি ইরানের কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেপ্তার করে এবং ২০১১ সালে তাকে মুক্ত করে দেয়া হয়।
মতিউর রহমান
আল কায়েদার পরিকল্পনা সমন্বয়কারী হিসেবে মতিউর রহমান সর্বাধিক পরিচিত। তরল বোমা তৈরির মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনি এবং ২০০৬ সালে আটলান্টিকের বিমানে এই বোমা ফাটানোর পেছনেও তিনি ছিলেন। এছাড়াও ২০০২ সালে ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের সংবাদিক দানিয়েল পার্লকে অপহরণের জন্যও তাকে দায়ি করা হয়।
আবু খলিল আল মাদানি
২০০৮ সালে আল কায়েদার এক ভিডিও বার্তায় জানা যায় তিনি সংগঠনটির শুরা সদস্যদের একজন। তিনি জন্মগতভাবে একজন সৌদি। এরবেশি তার সম্পর্কে জানা যায়না।
আদম গাদাহান
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার নাগরিক আদম গাদাহান মূলত আল কায়েদার হয়ে প্রোপাগাণ্ডা ছড়ান। ১৯৯৮ সালে তিনি দেশত্যাগ করে পাকিস্তানে যান এবং সেখানে এক আফগান শরণার্থী মেয়েকে বিয়ে করেন। অনুবাদ পারদর্শীতার কারণে আল কায়েদা তাকে গ্রহন করে এবং ফিল্ড কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেয়। ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত তার বিরুদ্ধে সমন জারি করে এবং ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো আয়মন আল জাওয়াহিরি তাকে ভিডিওবার্তার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে পরিচয় করিয়ে দেন।
আবু মোসাব আবদেল ওয়াদুদ
আবদেল ওয়াদুদ ‘আল কায়েদা ইন দ্য ইসলামিক মেঘরাব’ সংগঠনটির অন্যতম নেতা। সাবেক সায়ান্স বিভাগের এই ছাত্র বোমা তৈরিতে পারদর্শী হিসেবে খ্যাত। ২০০৪ সালে আলজেরিয়ার ইসলামিস্ট মিলিট্যান্ট সংস্থার নেতা হন তিনি। এছাড়াও একই বছরের মাঝামাঝি নাবিল শাহরাউ মারা যাওয়ার পর আল কায়েদার আর্মি অপারেশন প্রধান হিসেবে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তার আসল নাম আবদেল মালেক দউরুকদেল।
মন্তব্য চালু নেই