আলোচনা-সমালোচনায় খালেদার একমাস
গুলশানের ৮৬ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাড়িটি কার্যত বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবনে পরিণত হয়েছে। জানুয়ারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপারসন তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থান করছেন।
৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোটের বিপরীতে অবস্থান নেয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট। বাসভবন থেকে রাজনৈতিক কার্যালয়ে এসে অবস্থান নেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে পুলিশ বেগম খালেদা জিয়াকে নিরাপত্তার নামে ‘অবরুদ্ধ’ করে রাখে।
৫ জানুয়ারি সমাবেশের জন্য খালেদা জিয়া বের হতে চাইলে পুলিশ তার কার্যালয়ের ফটক বন্ধ করে বাইরে যেতে বাধা দেয়। কার্যালয়ের ভেতর বিএনপি দলীয় কয়েকজন সাবেক মহিলা এমপি এ নিয়ে উত্তেজিত হলে পুলিশ পিপার স্প্রে ছুঁড়ে মারে। এ দিন কার্যালয়ের ফটকে গাড়িতে দাঁড়িয়ে টানা অবরোধের ডাক দিয়ে ওপরে চলে যান খালেদা জিয়া। ৩ জানুয়ারি রাতেই ১৬টি ইট-বালুর ট্রাক দিয়ে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে ব্যারিকেড দেয়া হয়।
১১ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় মাটি, ইট ও বালুভর্তি ৭টি ট্রাক রাখা হলেও রাতেই তা সরিয়ে নেয়া হয়। কার্যালয়টির উত্তর পাশে পুলিশের দু’টি বড় কাভার্ড ভ্যান ও দক্ষিণ দিকে একটি জলকামান আড়াআড়িভাবে রেখে ওই সড়কে যানচলাচল বন্ধ রাখা হয়। কড়াকড়ি করা হয় সাধারণের চলাচলেও।
১৬ দিন পর ১৯ জানুয়ারি মধ্যরাতে এসব ব্যারিকেড সরিয়ে নেয়া হয়। প্রত্যাহার করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। ওই দিন বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া আন্দোলনের অংশ হিসেবে কার্যালয়ে অবস্থানের কথা জানান। এরপর আর তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
কার্যালয়ে থেকেই খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আন্দোলন মনিটরিং করছেন। সমসাময়িক রাজনৈতিক বই, পত্রিকার সম্পাদকীয় পড়ে এবং টেলিভিশনের নানা অনুষ্ঠান দেখে সময় পার করছেন তিনি। অধিকাংশ সময় বিএনপি চেয়ারপারসন একা থেকেছেন। কার্যালয়ে অবস্থানের পর থেকে তিনি ঠাণ্ডা ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছেন। তার সঙ্গে থাকা নেত্রীদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
‘ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী’ পরিচয়ে বিএনপি জোট স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেও বিশ্ব ইজতেমার দু’টি পর্বেই তাদের অবরোধ আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে।
এই অবস্থায় ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর সংবাদ পান খালেদা জিয়া। ২৭ জানুয়ারি কোকোর মরদেহ কার্যালয়েই গ্রহণ করেন খালেদা জিয়া। কোকোর কফিন বিদায় দিতে শোকে ভারাক্রান্ত খালেদাকে কাঁদতে দেখা যায়। যদিও তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারীরা বলেছেন, ‘শোকাহত হলেও তার মনোবল দৃঢ় আছে।’
অনেকের ধারণা ছিল কোকোর মৃত্যুর কারণে বিএনপি জোটের চলমান আন্দোলন স্থগিত হতে পারে। কিন্তু তা হয়নি। আন্দোলন চলাকালে দেশ জুড়ে মানুষ পুড়ছে আর মরছে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পরিবারের বিরোধ এবং তার প্রভাব রাজনীতিতে প্রবল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার জন্য জিয়াউর রহমানকে দায়ী করা হয়। ২০০৩ সালে ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামালার মাধ্যমে যে হত্যাকাণ্ড ঘটনানো হয়েছে তার জন্য তারেক রহমানকে দায়ী করা হয়।
আবার ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনাকে নিয়েও বিএনপি সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এতো সব পেরিয়ে কোকোর মৃত্যুর খবর শুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কনকনে শীতের রাতে প্রটোকলের বাইরে ছুঁটে এসেছিলেন শোকার্ত মানুষের কাতারে। শোকাহত মা খালেদা জিয়াকে শান্তনা জানাতে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে। কিন্তু খালেদা জিয়ার কার্যালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অশোভন আচরণ করা হয়। তাকে কার্যালয়ে ঢুকতে দেয়া হয়নি।
এদিকে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বনানী সামরিক কবরস্থানে কোকোকে দাফন করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত অনুমতি মেলেনি। প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে ফেরত যাওয়ার পর যাত্রাবাড়ীতে বাসে বোমা হামালায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়।
গত ৩০ জানুয়ারি রাত ২টা ৪২ মিনিটে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ডেসকোর কর্মীরা গুলশান থানার নির্দেশে এ কাজ করার কথা বললেও থানা থেকে তা অস্বীকার করা হয়। সরকারও এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। একপর্যায়ে ইন্টারনেট ও কেবল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে পরের দিন রাত সোয়া ১০টায় আবার বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়।
কার্যালয়ে অবস্থানরত বিএনপি নেত্রীকে দুই ভাইয়ের বাসা থেকে খাবার পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া দলের নেতানেত্রীদের বাসা থেকেও বিভিন্ন সময় আসছে খাবার। সকাল-বিকেল দুই ভাইয়ের স্ত্রী নাসরিন সাঈদ ও কানিজ ফাতিমা পালাক্রমে গুলশানের কার্যালয়ে আসছেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল কাইয়ুম, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান, বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস, নিরাপত্তা সমন্বয়কারী কর্নেল (অব.) আবদুল মজিদ, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদিকা শিরিন সুলতানাও আছেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে।
এছাড়া দুই নাতনি জাফিয়া, জাহিয়া ও পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান মালয়েশিয়া ফেরার আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার কার্যালয়েই ছিলেন।
কোকোর মৃত্যুর পর বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানান সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সাবেক এমপি ফজলুল আজিমসহ বিএনপি সমর্থিত বিভিন্ন পেশাজীবী নেতারা। তারা খালেদার সঙ্গে সাক্ষাৎও করেন।
কোকোর মৃত্যুর পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতারা ২৯ জানুয়ারি প্রথম সাক্ষাৎ করে সমবেদনা জানান। তবে এখনো পর্যন্ত মির্জা আব্বাসের দেখা মেলেনি।
এদিকে শোক আর আন্দোলনের মধ্যে খালেদা জিয়াকে সংলাপে বসার চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এছাড়াও শ্রমিক, শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকদের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার কাছে অবরোধ হরতাল প্রত্যাহার করতে স্মারকলিপিও দেয়া হয়।
বিএনপি দাবি করছে, তারা বিজয়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। যদিও চলমান সহিংসতায় দলটির দায় রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন দলটির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের সদস্য লে. জে. (অব.) মাহাবুবুর রহমান। গত এক মাসের আন্দোলন চলাকালে ৫০ জনের অধিক প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে।
মন্তব্য চালু নেই