আ’লীগে অনাস্থা, শক্তিহীন বিএনপিতে সহানুভূতি

এমনটা হবে তা ক’দিন ধরেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড়, পোলিং এজেন্টদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হানার ঘটনায় নির্বাচনের দিনটা যে ভাল কাটবে না তা আগেই আঁচ করেছিলেন রাজনৈতিক নেতারা।

তবে আশঙ্কা যতটুকু ছিল, অনিয়মের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল তারও বহুগুণ। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অভিনব কায়দায় নির্বাচনী কেন্দ্র দখল করে প্রতিপক্ষকে বের করে দেওয়া, ইচ্ছেমতো জাল ভোট ও প্রতিপক্ষের ওপর হামলায় হতবাক হয়েছে নগরবাসী। কোথাও কোথাও প্রতিপক্ষের ওপর গুলির ঘটনাও ঘটেছে।

রাজনৈতিক নেতা, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মীদের মতে, এই ঘটনায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের আস্থায় বড় ধরনের আঘাত এসেছে। ফলে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।

আর সাধারণ মানুষ মনে করেন, অতীতে নানা ঘটনায় সমালোচিত আওয়ামী লীগ সরকার এমন বিতর্কিত ভোটের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিতে পড়বে।

পাশাপাশি দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থাকা ‘দুর্বল’ বিএনপির প্রতি মানুষের সহানুভূতি বাড়বে বলেও মতপ্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।

কার লাভ, কার ক্ষতি : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের মৌলিক ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধা দেওয়ার ঘটনা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।

এ বিষয়ে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর (আর্জেন্ট আপিলস্ প্রোগ্রাম) মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘এই নির্বাচনে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক বা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ক্ষেত্রে কোনো লাভ হয়নি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা ও প্রত্যাশার ভিত্তিমূলে বরং এটা আরও একবার আঘাত হেনেছে।’

হংকংভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থার এই প্রতিনিধি আরও বলেন, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোটাধিকার প্রয়োগের মতো মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন কমিশন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অকার্যকারিতা ও অনীহা প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ বলেন, ‘৫ জানুয়ারি নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন। আর ২৮ এপ্রিলের সিটি করপোরেশন গায়ের জোরের নির্বাচন। এতে আওয়ামী লীগের প্রতি বিরক্তি আরও বাড়বে।

উত্তরের সিপিবি-বাসদ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল ক্বাফী বলেন, ‘যুবলীগ-ছাত্রলীগ ও পুলিশ যেভাবে ভোট কেন্দ্রে পাহারা বসিয়েছিল, তাতে অন্য প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী কেন্দ্রে যাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছিল। পুলিশের যে আচরণ তাতে তাদের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী মনে হয়নি। তাদের দলীয় কর্মীর মতো মনে হয়েছে। তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পড়েছে।’

মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস বলেন, ‘বিভিন্ন কেন্দ্র দখল করে আমার এজেন্টদের মেরে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমাকেও অপমান ও লাঞ্ছিত করা হয়েছে। অনেক গণমাধ্যমকর্মীকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। ক্যামেরা ভাঙচুর করা হয়েছে। জনগণ এমন আচরণে ক্ষুব্ধ।’

ভোট জালিয়াতি, ‘দুর্বল’ বিএনপিতে সহানুভূতি : বাংলাদেশে ভোট কারচুপির ইতিহাস নতুন নয়। বিএনপির আমলে মাগুরা ও ঢাকার মিরপুরের উপ-নির্বাচন বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিতে সমালোচিত হয়ে আসছে। সোমবার এক ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেই ভোট জালিয়াতির প্রসঙ্গ টেনে আনেন।

বিভিন্ন সময় আন্দোলন গড়তে কার্যত ব্যর্থ ‘দুর্বল’ বিএনপির প্রতিও মঙ্গলবারের ভোট চুরির ঘটনায় সহানুভূতি বাড়বে বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ।

বেসরকারি চাকরিজীবী আশিকুর রহমান বলেন, ‘বিএনপির টানা অবরোধ ও হরতালে মানুষ অনেকটাই বিরক্ত ছিল। মানুষ আশা করেছিল নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের এমন আচরণে বিএনপির প্রতি মানুষর সহানুভূতি বাড়বে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সময় আন্দোলন গড়তে একদমই ব্যর্থতার পরিচয় দেয় বিএনপি। তাদের কর্মীদের কোনো প্রোগ্রামেই পাওয়া যেত না। কিন্তু, নির্বাচনে তাদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছিল। মানুষও আশা করছিল গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করুক। এই নির্বাচনের ফলে আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের অনাস্থা বাড়ল।’

বেসরকারি চাকরিজীবী ইমরান যোবায়েদ শরীফেরও একই মত। তিনি বলেন, ‘বেলা ১২টার দিকে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার পরপরই ভোটার উপস্থিতি কমে যায়। যারা কেন্দ্রে গিয়েছিলেন তাদের বেশীরভাগই বাসায় ফিরে যান। এতে পরিষ্কার বুঝা যায় যে ভোটে বিএনপির অংশগ্রহণে মানুষ খুশি হয়েছিল। কিন্তু তাদের এজেন্টকে ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া, মারধর ও সহিংস ঘটনার কারণে আওয়ামী লীগেরই বদনাম হল। বিএনপির প্রতি মানুষের সহানুভূতি বাড়ল।’

প্রথমবার ভোটার হয়েছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী শারমিন আক্তার। ভোট জালিয়াতির ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, ‘সরকারের এমন ঘটনায় মানুষের আস্থা আরও কমল।’

৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর আন্দোলন গড়তে অনেকটাই ব্যর্থ হয় বিএনপি। ব্যাপক ধরকাপড়ের কারণে রাজপথে বড় মিছিল পর্যন্ত করতে পারেনি দলটি। তা ছাড়া নানা মামলায় এর বেশীরভাগ নেতাই কারাগারে। কেউবা হুলিয়া মাথায় নিয়ে ফেরার। ফলে দিন দিন শক্তিহীন হয়ে পড়ছে বিএনপি।

উপরন্তু অবরোধ আর হরতালে গাড়ি পোড়ানো ও মানুষ হত্যার অভিযোগে বেশ সমালোচিত হয় দলটি। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ সব জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনায় খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করা হবে।’

তবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে আবার সংগঠিত হতে থাকে বিএনপি নেতাকর্মীরা। বাড়তে থাকে সাধারণ মানুষের সমর্থন। লুকিয়ে থাকা নেতাকর্মীরাও চলে আসেন প্রকাশ্যে। নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ তাই স্বাগত জানায় ঢাকাবাসী। নির্বাচনের দিন সকালে ভোট কেন্দ্রগুলোতে ভোটারের উপস্থিতিও ছিল উল্লেখ করার মতো। ভোট বর্জনের পর সেই জোয়ারে ভাটা পড়ে।

অশনিসংকেত: তিন সিটি নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় ‘ছন্দপতন’ বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক নেতা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। গণতান্ত্রিক যাত্রা ব্যাহত হলে তা মানুষের জন্য অশনিসংকেত বলেও মনে করেন তারা।

সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘১৯৯০ সালে জনগণের জন্য আমরা যে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করেছিলাম আজ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটের সে অধিকার রক্ষা করতে পারিনি। এতে অবশ্যই গণতন্ত্রের যাত্রা ব্যাহত হবে।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক প্রফেসর আব্দুর রব বলেন, ‘আজ আমরা যা দেখলাম তা গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনে অনেক জায়গায় বেশ গণ্ডগোল হয়েছে। বিএনপি এক পর্যায়ে নির্বাচন বয়কট করেছে। অন্য এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এই যে ঘটনা ঘটল তা গণতন্ত্রের জন্য শুভ লক্ষণ নয়।’ দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই