আরও একবার কাঁদলেন মেসি
চোখের জলের কী আশ্চর্য ক্ষমতা! প্রায় এক বছর আগে-পরের দুটি ঘটনাকে কী দারুণভাবেই না এক বিন্দুতে মিলিয়ে দিল চোখের জল! এক ফ্রেমে বন্দি লিওনেল মেসির উপরের এই ছবি দুটোই বলে দিচ্ছে সেই মিলের কথা।
লিওনেল মেসি কাঁদতে পারেন। ফুটবল মেসির মতো মহাস্টারকেও কাঁদাতে পারে, এই ঘটনা ফুটবল দুনিয়া প্রথম দেখেছিল ২০১৬ সালের ২৬ জুন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির মেট লাইফ স্টেডিয়ামে শতবর্ষী কোপা আমেরিকার ফাইনালে চিলির কাছে টানা দ্বিতীয় বারের মতো শিরোপা স্বপ্ন ভেস্তে যাওয়ার পর কেঁদেছিলেন আর্জেন্টিনার মেসি। হাউমাউ করে ভেতরের সব কষ্ট ধুয়ে ফেলা কাঁন্না নয়। দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশা, স্বপ্ন গুঁড়িয়ে যাওয়ার হতাশা বুকে চাপা রেখে কষ্টের বোবাকান্না।
তার প্রায় ১০ মাস পর মেসি আবারও কাঁদলেন ফুটবল মাঠে। বুধবার রাতে কাঁদলেন বার্সেলোনার মেসি। ন্যু-ক্যাম্পে দাঁড়িয়ে। জুভেন্তাসের কাছে বার্সার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা স্বপ্ন গুঁড়িয়ে যাওয়ার পর। সেই ন্যু-ক্যাম্পে, যে মাঠে পায়ের শৈল্পিক কারুকাজে লিওনেল মেসি বার্সার বিজয় সাফল্যের নায়ক হয়েছেন অসংখ্য বার। গড়েছেন অসংখ্য কীর্তিগাথা। মায়ের আঁচল যেমন সন্তানকে নিরাপদে ঢেকে রাখে, তেমনি ন্যু-ক্যাম্পও মেসিকে শুধু সাফল্যের মালা দিয়েই ঢেকে রেখেছিল এতোদিন। সেই ন্যু-ক্যাম্পই বুধবার টেনে নামাল মেসির চোখের জল। মেসি টিস্যু দিয়ে চোখের সেই বান ঠেকানোর চেষ্টা করলেন বটে; কিন্তু বুকের ভেতরে যে চাপা কান্নার বান বইছিল, টিস্যুর সাধ্য কী সেই কান্না ঠেকায়!
২০০৪ সালে বার্সেলোনার মূল দলে অভিষেকের পর থেকে ফুটবল দু’হাত ভরিয়ে দিয়েছে মেসিকে। ক্লাব ক্যারিয়ার তার কানায় কানায় পূর্ণ। রেকর্ড পাঁচ বার জিতেছেন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার ফিফা ব্যালন ডি’অর। ৮ বার জিতেছেন লিগ শিরোপা, ৪ বার কোপা ডেল রে, ৭ বার জিতেছেন সুপারকোপা ডি এস্পানা। চার চার বার হেসেছেন বিশ্ব ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় টুর্নামেন্ট উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জয়ের হাসি, সমান ৩ বার করে জিতেছেন উয়েফা সুপার কাপ ও ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ শিরোপা। ব্যক্তিগত পুরস্কারের তালিকাটা আরও অনেক লম্বা। সাফল্যের এই দীর্ঘ তালিকা মেসিকে তুলে দিয়েছে সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের কাতারে। তবে সাফল্য আর প্রাপ্তির সাগরে ভাসানোর পাশাপাশি ফুটবল যে হতাশার হুল ফুটিয়ে কারো চোখের জলও টেনে বের করতে, কঠিন এই সত্যটা এখন সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারছেন মেসিই!
গত ১১ এপ্রিল কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে জুভেন্তাসের মাঠে গিয়ে ৩-০ ব্যবধানে হেরে যায় বার্সেলোনা। স্প্যানিশ জায়ান্টদের সেমিফাইনালের স্বপ্নটা ফিকে হয়ে যায় তখনই। তারপরও একটা সম্ভাবনা দেখছিলেন ফুটবলপ্রেমীরা। কারণ বুধবার ফিরতি লেগটা ছিল বার্সার নিজেদের ঘরের মাঠ ন্যু-ক্যাম্পে। শেষ ষোল রাউন্ডের দ্বিতীয় লেগে এই ন্যু-ক্যাম্পেই প্রত্যাবর্তনেরে এক রূপকথার গল্প লিখেছিলেন মেসি-নেইমার-সুয়ারেজরা। পিএসজির মাঠে গিয়ে ৪-০ গোলে হেরে আসার পর দ্বিতীয় লেগে বার্সার দরকার ছিল অন্তত ৫-০ গোলের ব্যবধানে জয়। মেসিরা সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। ন্যু-ক্যাম্পে ম্যাচটা জিতেছিলেন ৬-১ ব্যবধানে। পিএসজির বিপক্ষে ওই কীর্তির বড় নায়ক ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জুভেন্তাসের বিপক্ষেও আরেকটি প্রত্যাবর্তনের রূপকথা লেখার। কিন্তু পারেননি তারা। পারতে দেয়নি চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়ানো জুভেন্তাসের রক্ষণ দেয়াল।
জুভেন্তাসের বর্ষীয়ন ডিফেন্ডার জর্জো কিয়েলিনি ম্যাচের আগেই বলেছিলেন ন্যু-ক্যাম্পে মেসি-নেইমার-সুয়ারেজ ত্রয়ী গোলের জন্য হাঙ্গরের মতো ক্ষুধার্ত থাকবে। মেসি-নেইমাররা ছিলেনও তা। কিন্তু তাদের সেই তীব্র গোল ক্ষুধার চেয়েও বেশি শক্তিশালী ছিল জুভেন্তাসের প্রতিশোধ প্রতিজ্ঞার দেয়াল! ২০১৫ সালে বার্লিনের ফাইনালে জুভেন্তাকে ৩-১ গোলে হারিয়েই চ্যাম্পিয়ন্স লিগে নিজেদের পঞ্চম শিরোপা জিতেছিল মেসিদের বার্সেলোনা। সেই হারের প্রতিশোধ নিতে জুভরা এতোটাই মরিয়া ছিল যে, কোয়ার্টার ফাইনাল ড্র’র আগেই বলে দিয়েছিল তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে বার্সাকেই চায়!
প্রথম লেগের বড় জয়ে প্রতিশোধের সেই জ্বালা জুড়ানোর পথটা তৈরি করে নিয়েছিল জুভরা। ন্যু-ক্যাম্পে প্রয়োজন ছিল শুধু বার্সাকে ঠেকিয়ে রাখা। ম্যাচের আগে কিয়েলিনি বলেই দিয়েছিলেন, মেসি-নেইমার-সুয়ারেজ ত্রয়ীকে রুখে দিতে সম্ভব সবকিছুই তারা করবেন। রক্ষণে কোনো ফাঁক রাখবেন না। কিয়েলিনিরা সেটাই করে দেখিয়েছেন মাঠে। মেসি-নেইমারা-সুয়ারেজরা আক্রমণের ঢেউ তুললেও জুভেন্তাসের রক্ষণ দেয়াল ভাঙতে পারেনি। নেইমারদের আরেকটি প্রত্যাবর্তনের গল্প লেখার স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ন্যু-ক্যাম্পে ম্যাচটা শেষ হয়েছে গোলশূন্য ড্রয়ে। দুই লেগ মিলিয়ে ৩-০ অগ্রগামিতা নিয়ে সেমিফাইনালে উঠে গেছে জুভেন্তাস। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় মেসি-নেইমারদের বার্সা।
নেদারল্যান্ডসের রেফারি বিয়োম কুইপার্স যখন ম্যাচ শেষের লম্বা বাঁশি বাজালেন, স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার নেইমার তো হাউমাউ করেই কাঁদলেন। কাঁদলেন মেসিও। তবে কষ্টের নিরব কান্না। ফুটবল দুনিয়া দ্বিতীয় বার দেখল মেসির কান্না। দেখল আর বুঝল, ফুটবল যেমন একজন খেলোয়াড়কে ইতিহাসের নায়ক বানিয়ে দিতে পারে, তেমনি সেই সুপারস্টারকে কাঁদাতেও পারে।
মন্তব্য চালু নেই