আমার শরীরের মালিকানা আমার, বেচতে লজ্জা কীসের !
‘সত্যি বলতে, শরীরটা তোমার, তাই কিছু হারাবার ভয় নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন ভারতীয় অভিনেত্রী ঋ। কলকাতার জনপ্রিয় পত্রিকা ‘এই সময়’ অভিনেত্রী ঋ-এর একটি সাক্ষাৎকারমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শতরুপা বসু। সেই সাক্ষাৎকারমূলক প্রতিবেদনটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো : বন্ধুরা আমায় বদমেজাজি বলে। কিন্তু যে কথাটা শুনলে আমার সত্যিই হেব্বি রাগ হয়, সেটা হল ‘বোল্ড’। দিনরাত শুনি, ফেসবুকে, মেসেজে, কেউ আলাপ করতে চায় কারণ আমি নাকি বোল্ড, সাহসী।
এটা শুনলে আমি যে তাদের মনে মনে খিস্তি করি না, তা নয়। কারণ আমার রাগ হয় এই ভেবে যে, তারা আমায় কতটা চেনে? আদৌ কি তারা আমার শরীরের ‘পলিটিক্স’টা নিয়ে ভাবে? কেন আমি উদোম হই কিছু বিশেষ ধরনের সিনেমায়, কিছু বিশেষ ধরনের মানুষের জন্য?
নিজের শরীরের চেতনাবোধ অনেক ছোট বয়সেই এসেছিল। তখন বোধহয় আমি চার কি পাঁচ। মায়ের হাত ধরে যাচ্ছি পাড়ার দরজির কাছে নতুন জামার মাপ দিতে। দোকানটা ছোট আর রাস্তার ওপর। প্রাইভেসি বলে কিছু নেই। সে দিন প্রথম আমার একটা লজ্জাবোধ হলো। দরজি মাপ নিচ্ছে, আর আমি লজ্জা পাচ্ছি। মা’কে বললাম, ‘আমি বাড়ি যাব, লজ্জা লাগছে।’ মা খুব ধমকে বলল, ‘এইটুকু মেয়ে আবার লজ্জা!’
আমার এখানে একটা ‘ডাইকটমি’ মনে হলো। আমার শরীর চাইছে লজ্জা। কিন্তু আমার মা, একজন মেয়ে হয়ে বলছে, লজ্জা কীসের? তাই ভাবলাম, যদি আমি নির্লজ্জ হই, তা হলে কেমন হয়? বাড়ির মদদ ছিল। ‘চ্যাম্পিয়ন’ মা, মাসিরা এবং আমার ‘কুল-ক্যাট’ মামিমা— সবাই চাইত আমি ‘ফ্রি স্পিরিটেড’ হই। হয়তো চাইত আমি অভিনেত্রী হই।
সালটা ১৯৮৩ বা ১৯৮৪। ‘ডিস্কো ডান্সার’ মুক্তি পেয়েছে। মামার বাড়িতে কেটেছে ছোটবেলা। ছোটমামার একটা টেপ-ডেক-এর দোকান ছিল পাড়ার মোড়ে। বিকেল হলেই বাজত ‘ডিস্কো ডান্সার’-এর জিমি জিমি …। পাগলের মতো ছুটে যেতাম পাড়ার মোড়ে, আর নাচতাম।
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠল ‘সারিয়েল’ জগত্, আমার নিজের জগত্, সিনেমা। সব অখ্যাত, কুখ্যাত সিনেমা পছন্দ। সঙ্গে তাদের হিরোইনদেরও। মায়ের কোনো ‘ইনহিবিশন’ ছিল না। হয়তো মা আমাকে ছোটবেলা থেকেই ‘অ্যাডাল্ট’ ভাবত। আমি যে সময় মডেলিং শুরু করি, সেটা ছিল ২০০২ বা ২০০৩। চারধারে তখন অনেক সাহসী মহিলা। তাঁরা হয়তো কেউ ‘ফেমাস’ নন। কিন্তু সে সময় তাঁদের মধ্যে একটা জোশ ছিল। মডেলিংয়ের এই ‘ফ্রি স্পিরিটেড পার্সোনালিটি’ নিয়ে আমি যখন টেলিভিশনে আসি, তখন হয়তো বাংলা টেলিভিশনে ‘ফ্রেশ স্কিন’-এর দরকার ছিল। আই মিন, আই কেম উইথ স্মার্টনেস আনইনহিবিটেড ফ্রিডম ফর আদার্স টু গিভ দেম আ পারসপেকটিভ টু লুক অ্যাট আ উওম্যান উইথ লেস ক্লোদস। মিলান কুন্ডেরা যেমন লিখেছেন, ‘আই গেভ আ কনসেন্ট টু মেক মাই বডি পাবলিক ইন আ মুভিং ইমেজ।’ তাতে ইন্ডাস্ট্রিতে আমার নাম হল ‘খোলামেলা ঋ’।
শরীর দেখাতে গেলে শৃঙ্খলা চাই; সাহস তো পরে আসে। শৃঙ্খলা বা নিজের শরীরের ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস ছিল, আছে এবং থাকবে। আমার শরীরের মালিকানা আমার। দোকান সাজিয়ে বসেছি। বেচতে লজ্জা কীসের। আমার শরীরের বাবু আর দালাল আমি নিজেই। যাঁরা আমার শরীর দেখে লজ্জা পান, উত্তেজিত হয়ে পড়েন, তাঁরা হোন। কিন্তু এই যে প্রতিনিয়ত তাঁদের আদিম সত্তাকে ‘ট্রিগার’ করি, এটাই আমার ‘কানেকশন উইথ মাই অডিয়েন্স’।
কিউয়ের হাত ধরে আমার ‘অলটারনেটিভ’ ছবিতে প্রবেশ। আঁভা গার্দ, ডকু ফিকশন, আন্ডারগ্রাউন্ড ডেঞ্জারাস ফিল্মস। যখন ‘২১ গ্রামস’ দেখি, তখন নাওমি ওয়াটসের সাহসিকতা আমায় চ্যালেঞ্জ জানায়। ‘ইররিভার্সিবল’-এর ধর্ষিতা মনিকা বেলুচ্চির চিৎকার আমায় পরবর্তী বড় পদক্ষেপটা নিতে বলে। আর সেই সুযোগ করে দেয় কিউ। ২০০৬-০৭-এ কিউ বানায় ‘গান্ডু’। ও অভিনেতাদের ভয়গুলোকে দেখতে পায়, চ্যালেঞ্জ জানায়। ‘শেমলেস’ হওয়ার দিকে নিয়ে যায়। ওর গার্লফ্রেন্ড বলেই বলছি।
‘গান্ডু’র এক্সট্রিম সিন করতে গিয়ে আমার বা অনুব্রতর প্রায় জীবন বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমি যে বিশ্বাসী কিছু চলচ্চিত্র নির্মাতাকে দেখতে পাই। তাদের ‘সেক্সুয়ালিটি’ আমি বুঝতে পারি। সে জন্যই ‘কসমিক সেক্স’ বা ‘গান্ডু’র প্রয়োজন ছিল আমার জীবনে। তবে সত্যি বলতে এত কিছু ভাবার নেই। শরীরটা তোমার; কিছু হারাবার ভয় নেই। মেয়ে বলেই বলছি।
আমার মনে হয় না যে, টলিউডে সাহসী ছবি হঠাৎ বেড়ে গিয়েছে। আগেও তো ‘পরমা ‘ বা ‘উৎসব ‘ বা ‘অসুখ ‘-এর মতো ছবি হয়েছে। ঋতুদিও (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত) নানা সাহসী ছবি করেছেন। ১০ বছর আগে যেগুলোকে সাহসী ছবি বলা হতো, সেগুলোর বেশির ভাগ বানাতেন ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তরা। এগুলোকে পুরোপুরি বাণিজ্যিক ছবি বলা হতো না। এখন বাণিজ্যিক আর সমান্তরাল ছবির বিভাজন খানিকটা হলেও ঝাপসা হয়েছে। এটা পুরোটাই সম্ভব হয়েছে সৃজিত মুখোপাধ্যায় বা মৈনাক ভৌমিকের মতো পরিচালকের জন্য। এঁদের ছবির সঙ্গে কলেজের ছেলে-মেয়েরা যেমন আইডেন্টিফাই করতে পারে তেমন পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষ-মহিলারাও পারেন। যদিও এই প্রজন্মেরই গল্প বলেন এই পরিচালকরা। যেমন সৃজিতের পরের ছবি ‘রাজকাহিনী’-তে আমি যৌনকর্মীর ভূমিকায় অভিনয় করছি। সৃজিতের ছবিকে পুরোপুরি বাণিজ্যিক যেমন বলা যায় না, তেমন সমান্তরালও বলা যায় না। মৈনাকের ছবিও তাই। সেখানে তো ‘বোল্ডনেস’ বারবার এসেছে। বিষয়ের ভাবনা আর প্রয়োগ থেকেই এসেছে। আর দেখতে গেলে পুরোপুরি বাণিজ্যিক ছবি কোনো সময়েই ‘সাহসী’ ছিল না। এখনও নয়। শুধু আগে যেটা কঠোরভাবে সমান্তরাল ছিল এখন সেটা অনেকটাই ‘বাণিজ্যিক’ হয়েছে— মৌলিকতাকে বিসর্জন না দিয়ে। সেখানে ‘বোল্ডনেস’ এসেছে বিষয়ের তাগিদেই। আইএস
মন্তব্য চালু নেই