আমার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে রশিদ : লন্ডনি বধূ

‘নিজ জিম্মা’- অর্থাৎ কার জিম্মায় গেলেন সিলেটের আলোচিত লন্ডনি বধূ রুমেনা বেগম। এক সপ্তাহ সরকারি হেফাজতে থাকার পর তিন দিন আগে নিজের জিম্মায় চলে গেছেন তিনি। এরপর থেকে কোথায় আছেন, কেমন আছেন কেউ জানেন না। পুলিশও বিষয়টিকে ‘রহস্যঘেরা’ করে তুলেছে।

ওদিকে লন্ডনে মায়ের জন্য কাঁদছে রুমেনার দুই সন্তান রেদোয়ান ও রায়হান। মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন তারা। মায়ের অনুপস্থিতিতে দুই সন্তানের লালন পালন নিয়ে আজাদ মিয়া দিশাহারা। দেশে থাকা স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছেন না তিনি। শুধু লন্ডন থেকে নয়, দেশে থাকা রুমেনার মা জমিলা বেগম, ভাই রফিকুল ইসলামও জানেন না রুমেনা কোথায়। লন্ডন প্রবাসী বধূ রুমেনা বেগম। বয়স ত্রিশ’র কাছাকাছি।

বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দক্ষিণ দৌলতপুর গ্রামের মৃত শুকুর আলীর মেয়ে। বর্তমানে লন্ডন শহরের বাসিন্দা রুমেনা বেগম। এই রুমেনাকে নিয়ে সিলেট ও বিশ্বনাথে গত কয়েক দিন ধরে তোলপাড় চলছে। ভাইয়ের মামলার পর পুলিশও রুমেনার খোঁজে অস্থির ছিল। অবশেষে রুমেনা নিজেই আদালতে হাজির হয়। নিরাপত্তা হেফাজতে কাটায় এক সপ্তাহ। এরপর আদালতে ২২ ধারা জবানবন্দি দিয়ে নিজের জিম্মায় বেরিয়ে গিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে রুমেনা বেগম।

স্বামী, সন্তান কিংবা মা-ভাইদের কারও সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। সিলেটের এই লন্ডনী বধু রুমেনার কাহিনী অনেকক্ষেত্রে সিনেমার কল্প কাহিনীকেও হার মানাবে। রুমেনা পিতার শুকুর আলী ছিলেন লন্ডন প্রবাসী। সেই সুবাদে শুকুরের দ্বিতীয় স্ত্রীর ঔরসজাত সন্তান তিনি। বড় বোনের পরকীয়া ঘটনায় এক সময়ে বিপর্যস্ত ছিল দেশের বাড়ি বিশ্বনাথে থাকা রুমেনা পরিবার। আর ওই সময় আপন মামাতো ভাই বিশ্বনাথের রহিমপুর খালপাড় গ্রামের সিদ্দিক আলীর ছেলে আজাদের সঙ্গে বিয়ে হয় রুমেনা বেগমের। ঘটা করেই কমিউনিটি সেন্টারে দুই পরিবারের মধ্যে এই বিয়ে সম্পন্ন হয়। আজাদের সঙ্গে বিয়ের পর ভালই চলে রুমেনার সংসার।

এরপর রুমেনা লন্ডন গিয়ে স্বামী আজাদকেও নিয়ে যান ওখানে। ওখানে যাওয়ার পরও তাদের সংসারে দুটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এর মধ্যে আজাদ ও রুমেনার বড় ছেলে রেদোয়ানের বয়স প্রায় ১১ বছর। আর ছোটো ছেলে রায়হানের বয়স প্রায় সাড়ে ৩ বছর। তবে, আজাদের পরিবারে কেবল দুই ছেলে ও স্ত্রী রুমেনাই ছিল না। ছিল রুমেনার বড় ভাই, ছোটো বোন সহ আরও কয়েকজন সদস্য। সবাইকে আজাদই দেখভাল করতে হয়। রুমেনার বড় ভাই কোনো কাজকর্ম করে না।

লন্ডনে সে বখাটে হিসেবে দিন কাটায়। ওদিকে, আজাদ যা আয়-রুজি করে তাই লুটেপুটে খায় রুমেনার ভাই-বোনেরা। এ নিয়ে আজাদ কিছুটা ত্যক্ত-বিরক্ত ছিলেন। এসব নিয়ে প্রায় ৮ মাস আগে এ নিয়ে লন্ডনে থাকা রুমেনা ভাইদের সঙ্গে বিরোধ বাধে আজাদের। হয় হাতাহাতিও। এসব হাতাহাতির ঘটনায় রুমেনা পুলিশ ডেকে এনে আজাদকে ধরিয়ে দেয়। প্রায় তিন দিন জেলও খাটেন আজাদ। পরে বেরিয়ে আসার পর ফের বিষয়টি মিটমাট করেন রুমেনা নিজেই। এরপর থেকে আজাদ ও রুমেনার সংসার ভালোই চলে। ওদিকে, সম্প্রতি সময়ে দেশে আসার বায়না ধরে রুমেনা।

বলে, মাকে দেখেই দুই সপ্তাহ দেশে থেকে ফের লন্ডনে চলে আসবে। তার এই সহজ-সরল উক্তি বিশ্বাস করেন আজাদ। তিনি রুমেনার হাতে ৭ হাজার পাউন্ড তুলে দেন। আর ওই টাকাগুলো তার ভাই মতিন মিয়ার কাছে দেয়ার জন্য বলেন। আর দেশে আসার সময় রুমেনা লন্ডন থেকে ২০ ভরি স্বর্ণালংকার সঙ্গে আনেন। সিলেটের বিমানবন্দর থানায় দায়ের রুমেনার ভাই রফিকুল ইসলামের মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, রুমেনা বেগম ৬ই জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হিথ্রো থেকে আসা বিমানের ফ্লাইটে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন।

ওই দিন বোনকে রিসিভ করার জন্য মা জমিলা বেগমকে নিয়ে ওসমানী বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন রফিকুল। সঙ্গে ছিলেন রুমেনার বর আজাদের বড় ভাই মতিন মিয়া। বিমান আসার পর তারা বিমানবন্দরের বাইরে পার্কিং এলাকায় রুমেনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। রফিকুল ইসলাম মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন, রুমেনা ওসমানী বিমানবন্দরের বাইরে আসার পর বিশ্বনাথেরই চানশীরকাপন গ্রামের সালিক মোল্লার ছেলে রশিদ ওরপে লেংরা রশিদ ও আব্দুল মুমিন জোরপূর্বক প্রাইভেট মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। ওই দিন পিছু ধাওয়া করেও পরিবারের সদস্যরা রুমেনাকে পাননি।

এ ঘটনায় পরদিন সিলেটের বিমানবন্দর থানায় অপহরন মামলা দায়ের করেন রফিকুল ইসলাম। এদিকে, মামলা দায়েরের পর পুলিশ প্রযুক্তিনির্ভর তদন্ত চালিয়ে ১৪ই জুন রশিদের খালাত ভাই ছাতকের নোয়াপাড়া গ্রামের রজব আলীর ছেলে নুরুল আমীনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ রুমেনাকে উদ্ধারে অভিযান শুরু করে। ওদিকে, পুলিশি অভিযানের মুখে ১৫ই জুন রুমেনা সিলেটের আদালতে হাজির হয়।

এ সময় আদালত রুমেনাকে সিলেট নগরীর বাগবাড়িস্থ নিরাপত্তা হেফাজতে পাঠিয়ে দেয়। মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, রুমেনা আদালতে হাজির হওয়ার দিন জবানবন্দি দিয়েছে। আর ওই জবানবন্দিতে সে আত্মীয়দের কাছে রয়েছে বলে জানায়। কিন্তু একটি মেয়ে হয়তো স্বামী সন্তান ও মা-ভাইদের কাছে থাকবে। তাদের কাছে না থেকে তিনি কোথায় থাকেন সে নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। এদিকে, নিরাপত্তা হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে মা জমিলা খাতুন রুমেনার সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় শুধু রুমেনা তার মাকে বলেছে, তার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে রশিদ।

জমিলা বেগম জানিয়েছেন, তার মেয়েকে মানসিকভাবে আঘাত করা হয়েছে। এ কারণে সে কী করছে সেটি অনুধাবন করতে পারছে না। কোনো মেয়ে স্বামী রেখে থাকতে পারলেও সন্তান রেখে থাকতে পারে না। লন্ডনে দুই সন্তানকে নিয়ে থাকা আজাদ মিয়া ধারণা করছেন, লন্ডনে থাকার সময় ফেইসবুকে দেশে থাকা কিছু বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতো রুমেনা। ওদের কারও সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে মনে করেন না তিনি। এর কারণ রুমেনার সঙ্গে তার সংসার সুখের ছিল। দুটি সন্তানকে নিয়ে তারা বেশ ভালোই রয়েছেন। এবং দেশে আসার সময়ও আজাদ থাকে বিমান পর্যন্ত উঠিয়ে দেন।

এদিকে, ঘটনার প্রায় ২০ দিন হতে চললো সিলেটের এয়ারপোর্ট থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেননি অপহরণ মামলার প্রধান আসামি রশিদ ওরফে লেংড়া রশিদকে। উদ্ধার হয়নি অপহরনের কাছে ব্যবহৃত হওয়া গাড়ি। মামলার বাদি রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, দুই শিশুকে রেখে মা লাপাত্তা সেটি খুব দুঃখজনক। তিনি বলেন, প্রধান আসামি রশিদ রুমেনাকে মানসিক টর্চার করেছে। এ কারনে রুমেনা এখন আবুল তাবুল বকছে বলেও দাবি করেন। এজন্য দ্রুত প্রধান আসামি রশিদকে গ্রেপ্তার করলেই পুরো ঘটনা খোলাসা হবে বলে জানান তিনি।

এদিকে, সম্প্রতি সময়ে লন্ডনে থাকা আজাদের ফেসবুকে রুমেনার আইডি থেকে কিছু ছবি পাঠানো হয়েছে। এসব ছবিতে রশীদ নামের ওই যুবকের সঙ্গে রুমেনা বসে কফি খাচ্ছে, আবার কখনো কাজিরবাজার ব্রিজে বসে আড্ডা দিচ্ছে বলে দেখা যায়। এসব ছবি পেয়ে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন আজাদ।

আজাদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, বিশ্বনাথের চানশীরকাপন গ্রামের রশিদ আহমদ এক বখাটে ছেলে। সে এর আগেও নিজেকে কোটিপতি পরিচয় দিয়ে একাধিক বিয়ে করেছে। এসব বিয়ে করলেও কারও সঙ্গে তার সংসার টিকেনি। অপহরনের পর রশিদ লন্ডনী বধু রুমেনাকে দিয়ে কাবিন করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু আজাদের সঙ্গে ডিভোর্সের কোনো কাগজপত্র দেখাতে না পারার কারনে সেই কাবিন আর হয়নি। -মানবজমিন।



মন্তব্য চালু নেই