আমাদের নিয়ে হাসবেন না : এরশাদ

বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে সমালোচনার প্রতিবাদ করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, ‘মন্ত্রিসভার কেউ কেউ আমাদের কটাক্ষ করেন, আমাদের নিয়ে হাসেন। আমি বলবো, আমাদের নিয়ে হাসবেন না। আমাদের নিয়ে হাসলে গণতন্ত্র নিয়ে বিদ্রুপ করা হবে।’
বৃহস্পতিবার দশম জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় (বাজেট) অধিবেশনে বিরোধী দলের পক্ষে সমাপনি বক্তব্যে এরশাদ এসব কথা বলেন।
সরকারি দলকে উদ্দেশ করে সাবেক এ রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আজ যারা ক্ষমতায় আছেন, তারাও বিরোধী দলে ছিলেন। আপনারা কি সেদিন সঠিকভাবে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পেরেছেন? অতীতের খারাপ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবেন না। আসুন অতীতকে আমরা কবর দিই। সবাই মিলে সত্যিকার গণতান্ত্রিক যাত্রায় অগ্রসর হই। এই গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় সরকারি দল বিরোধী দল কেউ কারো শত্রু নয়, এটাই হোক শ্লোগান।’

জামায়াত আওয়ামী লীগের সৃষ্টি
এরশাদ বলেন, ‘গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সংসদের শেষ দিন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়ার রেয়াজ আছে। আমি ১৯৯০ সালে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলাম ইচ্ছাকৃতভাবে। অনেক দিন গত হয়েছে। অনেক দিন পর জাতীয় পার্টি সংসদ অধিবেশনে সমাপনি বক্তব্যের সুযোগ পেয়েছে। আই ওয়ান্ট টু ব্যরি দ্য পাস্ট। আমি অতীতকে কবর দিতে চাই। তবে কতগুলো কথা সব সময় অন্তরে জাগরুক থাকে। এই দুঃখ-ব্যথা কথাগুলো ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারি না। আমাদের বিরুদ্ধে যে অবিচার হয়েছে তা আমি ভুলতে পারি না।’
তিনি বলেন, ‘১৫ দল আর সাত দল মিলে আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করলো। তারা দাবি করলো আপনি ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নির্বাচন দিন, নির্বাচনে আসুন। আগে সংসদ নির্বাচন দিন, পরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দিন। যদি কোনো অভিযোগে থাকে তাহলে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে তার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমি এই শর্তে ক্ষমতা ছেড়ে দিলাম।’
এরশাদ বলেন, ‘আমরা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পেলাম না। মনোনয়নপত্র ট্রাকে করে পাঠিয়েছিলাম। আমরা ৩৫টি আসনে জয়লাভ করলাম। ১৭টি আসনে খুবই কম ব্যবধানে হারলাম। কোথাও একশ ভোট কোথাও দুইশ ভোট সর্বোচ্চ ছিলো পাঁচশ ভোট। যদি আমরা আর মাত্র পাঁচটি সিট বেশি পেতাম তাহলে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি আর ক্ষমতায় আসতে পারতো না। এই বিষবৃক্ষ (জামায়াত) আপনারাই (আওয়ামী লীগ) সৃষ্টি করেছেন।’
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি নির্বাচনে বিশ্বাস করি, নির্বাচন করে এসেছি। অনেক প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাচন করে এসেছি। যদি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পেতাম, তাহলে ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো, বিএনপির সৃষ্টি হতো না। আমরা আর আপনারা মিলে সরকার গঠন করতাম। সুযোগ আমরা হারিয়ে ফেলেছি, আমার দোষে না, আমাদের দোষে।’
এরশাদ বলেন, ‘অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে। ছয়টি সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবার দশম সংসদ, এর আগে আরো পাঁচটি সংসদ। সংসদে কি কোনো বিরোধী দল গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালন করেছে, সত্যিকারের বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে? বার বার সংসদ বর্জন। ফাইল ছিড়ে ফেলা, ক্যামেরা ভেঙে ফেলা, কটূক্তি করা, এগুলো কি গণতন্ত্র ছিল? এই গণতন্ত্র দেখেছি আমরা।’
এরশাদ বলেন, ‘আমি নেতিবাচক রাজনীতি করি না। আমরা নির্বাচনে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল, আমরা ধ্বংসের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না, আমরা গাড়ি ভাঙচুর করি না। আমরা অবরোধ করি না। আমি জেলে ছিলাম, আমি বলেছিলাম, আমার মুক্তির জন্য একটা গাড়িও ভাঙা হোক সে মুক্তি আমি চাই না। জনগণের সম্পদ ধ্বংস করার অধিকার আমার নেই, জনগণের সম্পদ রক্ষা করার অধিকার আমার আছে। আমরা আজ সরকারের ভুল ধরিয়ে সঠিকভাবে কাজ করানোর চেষ্টা করছি। আমরা ছায়া সরকারের হিসেবে কাজ করছি। এটা কি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়, এটা কি গণতান্ত্রিক আচরণ নয়?’
দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি পুরোপুরি হয়নি অভিযোগ করে এরশাদ বলেন, ‘দেশে এখনও নারায়ণগঞ্জের ঘটনা ঘটে, ফেনীর মতো ঘটনা ঘটে, লক্ষ্মীপুরের মতো ঘটনা ঘটে। বহু কোটি মানুষের দেশ। অসংখ্য মানুষ বেকার, এসব ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু মানুষ আশা করে এসব ঘটনার কোনো প্রতিকার হবে, বিচার হবে, শাস্তি হবে, অবসান হবে। কিন্তু তার কোনো প্রতিকার হয় না। আমরা প্রতিকার দেখি না। মানুষের মনে আশঙ্কা, দেশে সুশাসনের অভাব রয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে এরশাদ বলেন, ‘দেশে সুশাসন নেই। সুশাসন থাকলে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, ঘুষ-দুর্নীতি হতে পারে না। আপনি বঙ্গবন্ধু কন্যা। আপনি চলে যাওয়ার পর আর বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী হবে না। তাই আমি বলবো, এসব আপনি কঠোর হস্তে দমন করুন। আপনি দেখিয়ে দিন আপনার বাবার স্বপ্ন পূরণ করছেন।’

অর্থমন্ত্রীকে ইঙ্গিত করে এরশাদ বলেন, ‘বাজেট উচ্চাভিলাসী হোক, আর উচ্চ আকাঙ্খার হোক যদি এই বাজেট আপনি বাস্তবায়ন করতে পারেন তাহলে আপনাকে মাথায় করে রাখবো। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য দরকার সহায়ক পরিবেশ। আমরা দেখেছি কিভাবে দেশে গাড়ি পোড়ানো হয়েছে, গাছ কাটা হয়েছে, মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়েছে, রেলের পাটি তুলে ফেলা হয়েছে। এটা সহায়ক পরিবেশ নয়। হয়তো এই পরিবেশের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে আবার যদি এমন পরিবেশের সৃষ্টি হয় তাহলে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।’

বিচার বিভাগের সমালোচনা করে এরশাদ বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর নির্ভর করে গণতান্ত্রিক সমাজে উৎকর্ষ ও সুষ্ঠু বিকাশ। আমাদের মনে প্রশ্ন হলো, বিচার বিভাগ কি স্বাধীন? এতো দলীয়করণ করা হয়েছে যে সুবিচার পাওয়া কঠিন। একটা কথা মনে হয়, তারেকের বিচার, বিচারক রায় দিয়ে মালয়েশিয়ায় চলে গেছেন। এই যদি হয় বিচারের অবস্থা তাহলে কিভাবে হবে। তাই বিচারক নিয়োগ দেয়ার আগে একটু ভাবতে হবে। এমন বিচারক আমাদের জন্য কলঙ্ক।’

কর্মসংস্থান সৃষ্টি আহ্বান জানিয়ে এরশাদ বলেন, ‘প্রতিবছর ২৮ লাখ ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হয়। আমি ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালক। একটা নতুন ব্যাংক কতটা চাকরি দিতে পারে। ৫টা, ৭টা, ১০টা। কিন্তু আমার কাছে ১০ হাজারের বেশি আবেদন এসেছে। শুধু আমার কাছে না, আমার স্ত্রীর কাছে, আমার কলিগদের কাছে এসেছে। এসব বেকার শিক্ষিত যুবসমাজ সমাজের বোঝা, মা-বাবার বোঝা। একসময় এসব সমাজের বোঝা বিপথে চালিত হবে। মাদকের আশ্রয় গ্রহণ করবে। এদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা আমার আপনার সবার দায়িত্ব।’



মন্তব্য চালু নেই