আবহাওয়া পূর্বাভাসের আবিষ্কারক

আজ থেকে দেড়শ বছর আগেকার কথা। হঠাৎ করেই কোনো কথা নেই বার্তা নেই আত্মহত্যা করে বসলেন বিখ্যাত নাবিক ও ‘মেট অফিস’র প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডমিরাল রবার্ট ফিৎজরয়। তার এই আচমকা মৃত্যুতে স্থানীয় একটি পত্রিকা সংবাদ পরিবেশ করতে গিয়ে এই দুর্ঘটনাকে ‘ভয়াবহ দুর্যোগ’র সঙ্গে তুলনা করে। কিন্তু অ্যাডমিরাল রবার্ট কেন আত্মহত্যা করলেন আর তার মৃত্যুকে কেনই বা একটি সংবাদ পত্র ভয়াবহ দুর্যোগের সঙ্গে তুলনা করলেন?

বর্তমানে অবশ্য রবার্টকে স্মরণ করা হয় চার্লস ডারউইনের বিগল জাহাজের কাপ্তান হিসেবে। ১৮৩০ সালের দিকে যখন ডারউইন তার গবেষণার জন্য পরিভ্রমনে বের হন তখন তার জাহাজে নাবিকের কাজ করতেন রবার্ট। কিন্তু ইতিহাস রবার্টকে একজন সফল কাপ্তানের চাইতেও অন্য কোনো পরিচয়ে পরিচিত করতে আগ্রহী। তাইতো আবহাওয়ার পূর্বাভাস দানের জনক হিসেবে ইতিহাসে তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ববাসী।

যেহেতু নৌজাহাজে কাজ করতেন রবার্ট তাই আবহাওয়ার খবর কম বিস্তর তাকে রাখতেই হতো। সেই খবরাখবর রাখার অংশ হিসেবেই তিনি নিজস্ব কায়দায় আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতেন এবং একটা সময় ‘মেট অফিস’ নামে পৃথিবীর প্রথম আবহাওয়া দপ্তরটিও তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। জাহাজ যেন দুর্ঘটনার কবলে না নিপতিত হয় তাই কজন মিলে এই অফিসটি শুরু করেন তারা। জাহাজের নাবিকরা যেন যাত্রা শুরু করার আগে আবহাওয়ার খবর জানতে পারেন এবং সঠিক চার্টার ধরে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন সেজন্য এই অফিস থেকে পূর্বাভাস সম্বলিত একটি কাগজ নিয়মিত বের হতো।

একটা সময় দাড়ায় যখন রবার্টের দেয়া পূর্বাভাস ছাড়া কোনো জাহাজ বন্দর ছেড়ে যেত না। শুধু তাই নয়, কোনো মাছ ধরার ট্রলারও মাঝ সাগরে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ছাড়া যেত না। আর অ্যাডমিরাল রবার্ট অদ্ভুত সব কায়দায় এই আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতেন। আজকের দিনের হিসেবে ব্যাপরটি পুরোপুরি হাস্যকর মনে হলেও তৎকালীন সময়ে ওই জ্ঞানেই কাজ চালাতে হয়েছে। এবং ওই জ্ঞানের অংশ হিসেবেই আজকের আবহাওয়া পূর্বাভাসের প্রভূত উন্নতি সাধন। কৃষকের মাঠে ষাড়ের আচরণ, কিংবা কাচের বয়ামের মধ্যে রাখা ব্যাংয়ের আচরণ ইত্যাদি বিচার বিশ্লেষণ করেই তবে আবহাওয়ার রায় দিতেন রবার্ট। আর এসব নিয়ে তিনি দিব্যি বানিয়েছিলেন তার প্রথম ল্যাবরেটরি।

CAST

বেশিদিন আগের কথা নয়, উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে মাত্র বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হন যে ঠিক কি কারণে ঝড় হয়। অথবা, সমুদ্রের বাতাস যে ঘড়ির উল্টো নীতি অনুযায়ী প্রবাহিত হয় তাও আবিষ্কার করতে অনেকটা সময় লেগেছে মানুষের। ঠিক ওই রকম এক সময়ে আবহাওয়ার চার্ট আবিস্কার বিষয়টি বেশ হাস্যকরই ছিল। সাধারণ মানুষের হাস্যরসের বাইরে খোদ যুক্তরাজ্যের সংসদে পর্যন্ত এই বিষয়টি তুমুল হাসাহাসি হয়। ১৮৫৪ সালে এক স্থানীয় এমপি সংসদে বক্তব্য দানকালে সবার উদ্দেশ্যে জানান যে, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ব্যাপক উন্নতির ফলে খুব জলদিই লন্ডন শহরের চব্বিশ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া যাবে। স্থানীয় সাংসদের এই কথায় গোটা হাউস অব কমন্স সেদিন অট্টহাসিতে বারকয়েক কেপে উঠেছিল নিঃসন্দেহে।

১৮৫৫ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে খারাপ আবহাওয়ার কারণে আনুমানিক সাত হাজার ৪০২টি জাহাজ ডুবে যায় এবং এই ঘটনায় প্রায় সাত হাজার ২০১ জন মানুষ মারা যায়। মানুষ মৃত্যুর এই ঘটনা অনেক বেশি আন্দোলিত করে রবার্টকে। তাই তিনি চাইতেন যে, তার দেয়া পূর্বাভাসে যেন মানুষের জীবন বাঁচে। কিন্তু তার এই পূর্বাভাসকে শুরুতেই তেমন কেউ আমলে নেয়নি। শেষমেষ ১৮৫৯ সালে বিপুল পরিমান স্বর্ণবাহী একটি রাজকীয় জাহাজ ডুবে গেলে সরকারিভাবে ঝড়ের সতর্কবার্তা জারি করার দায়িত্ব দেয়া হয় রবার্টকে। সরকারি সহায়তা পাবার পর ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফকে তিনি কাজে লাগান তরিৎ গতিতে ঝড়ের সংবাদ দেশের এপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পৌছানোর জন্য। এভাবেই একটা সময় আরও দ্রুতগতিতে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতেন রবার্ট।



মন্তব্য চালু নেই