শততম জয়ের সঙ্গে সিরিজটাও বাংলাদেশের

যে উৎসবের প্রতীক্ষায় ছিল বাংলাদেশ, সেটা সিরিজের শেষ ম্যাচে এসে দেখা দিল। অলিখিত ‘ফাইনাল’ হয়ে ওঠা ম্যাচে এসে চেনা গেল আগের দুই লড়াইয়ে ‘বিবর্ণ’ টাইগারদের। সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে হারের পর অনেক কথাই হচ্ছিল। সমালোচনার বন্যা বয়ে দিচ্ছিলেন অনেকে। কিন্তু আসল লড়াইয়ে এসে টাইগাররা ঠিকই দেখিয়ে দিল- বাংলাদেশ এখন আফগানদের চেয়ে ঠিক এতটাই এগিয়ে। শনিবার একপেশে হয়ে উঠা লড়াইয়ে ১৪১ রানে সফরকারীদের হারাল বাংলাদেশ।

তবে শেষ দিকে এসে এক মাশরাফি ভক্তের কান্ডে সেই উৎসবে কালো দাগ লেগে গেল। ২৯ ওভারে বল করছিলেন তাসকিন আহমেদ। তখন ভিআইপি গ্যালারি থেকে আচমকা এক দর্শক মাঠে মাঠে নেমে পড়ে। এক দৌড়ে চলে যায় মাশরাফির কাছে। তাকে জড়িয়ে ধরে। পরে অবশ্য নিরাপত্তা কর্মীরা সেই দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দেন। কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ে অনেক বড় বড় কথা শোনা গেলেও আদতে দুর্বলতাটুকু ভাল করেই চোখে পড়ল। এই ঘটনা কতোদুর গড়ায় কে জানে!

যাই হোক শনিবার রাতে শততম ওয়ানডে ম্যাচ জয়ের সঙ্গে সিরিজটাও নিজেদের করে নেয় লাল-সবুজরা। ২-১ ব্যবধানে সিরিজ মাশরাফিদের। এনিয়ে টানা ষষ্ঠ ওয়ানডে সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। ৩১৫তম ম্যাচে এসে ওয়ানডেতে শততম জয় ধরা দিল টাইগারদের।

মিরপুরের শেরে-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মেঘ-রোদের লুকোচুরির মধ্যে টস ভাগ্য ছিল মাশরাফি বিন মুর্তর্জার পক্ষে। শুরুতে ব্যাটিং নিতে দেরি করেননি টইগার অধিনায়ক। স্বাগতিকরা ৫০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে তুলে ২৭৯ রান। জবাব দিতে নেমে ৩৩.৫ ওভারে ১৩৮ রানে গুটিয়ে যায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তান।

আফগান ব্যাটিং লাইনআপে প্রথম আঘাতটা হেনেছিলেন মাশরাফি। মাশরাফির ইন কাটারে কিছুই যেন করার ছিল না মোহাম্মদ শাহজাদের। জায়গায় দাঁড়িয়ে খেলতে গিয়ে বোকা বনলেন। ৭ বলে শূন্য রানে বোল্ড!

এরপর অবশ্য কিছুটা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন নওরোজ মঙ্গল এবং রহমত শাহ। কিন্তু দু’জন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার আগেই মাশরাফি আক্রমণে আনেন সাড়ে আট বছর পর জাতীয় দলে ফেরা স্পিনার মোশররফ হোসেন রুবেলকে। তিনি অবশ্য হতাশ করেননি। নির্বাচকদের মুখ রক্ষা করলেন শুরুতেই নওরোজকে (৩৩) সাজঘরের পথ দেখিয়ে। তারপর একই ওভারে হাসমতউল্লাহ শহিদীর উইকেট তুলে নিলে উল্লাসে ফেটে পড়ে মিরপুরের গ্যালারি।

চটজলদি চতুর্থ উইকেটটিও হারায় আফগানরা। অধিনায়ক আসগার স্টানিকজাইকে রানআউট করেন সাকিব। তখন আফগানদের রান ১৬.৩ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে ৫৫।

স্পিন যাদু শেষে আঘাত হানেন তাসকিন আহমেদ। তার শর্ট বলে হুক করতে গিয়ে সামিউল্লাহ সেনওয়ারির ব্যাটে-বলে ঠিকঠাক সংযোগ হলো না। কোনা ছুঁইয়ে বল আশ্রয় নিলো উইকেটকিপার মুশফিকের হাতে। আফগানিস্তান ৮৩/৫। পরের ওভারে এসে ফের সেই তাসকিন সাজঘরের পথ দেখিয়ে দেন রহতম শাহকে (৩৬)। উইকেট শিকারের সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে পরে ফের মোশাররফ তুলে নেন অভিজ্ঞ মোহাম্মদ নবির উইকেট।

এমন চাপের মুখ থেকে আর ফেরা হয়নি সফরকারীদের। পরের সময়টুকু শুধুই বিরক্তিকর একপেশে ক্রিকেট ম্যাচের স্বাক্ষী হয়েছে হোম অব ক্রিকেট। শেষ দিকে নাজিবুল্লাহ জাদরান ১৯ বলে ৪ ছক্কায় ২৬ রানের ঝড়ো ইনিংস খেললেও সেটি শুধু পরাজয়ের ব্যবধানই কমিয়েছে।

সাড়ে আট বছর পর ফেরাটাকে মোশাররফ বল হাতে স্মরণীয় করে রাখেন ৩ উইকেট নিয়ে। অন্যদিকে দুই বছর পর জাতীয় দলে ফেরা শফিউল শেষ ব্যাটসম্যান দৌলত জাদরানকে আউট করে একমাত্র উইকেটের দেখা পান।

এর আগে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা অবশ্য ভাল হয়নি বাংলাদেশের। দলের সংগ্রহে যখন ২৩ রান তখনই সাজঘরের পথ ধরেন সৌম্য সরকার। আফগানদের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেতেও ফ্লপ! এবার করলেন ১১। আগের দুই ইনিংস ০ ও ২০।

তবে সেই ধাক্কাটা তরুণ সাব্বির রহমানকে নিয়ে দারুণ সামাল দিলেন তামিম ইকবাল। যদিও ভাগ্যটা এদিন সঙ্গে ছিল এই ওপেনারের। মোহাম্মদ নবীর প্রথম ওভারে কোনো রান তুলতে পারেননি। তার পরের ওভারের প্রথম বলে পুল করতে গিয়ে ফিরেই যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার তুলে দেয়া সহজতম ক্যাচটি ফেলে দেন মিডঅনে দাঁড়ানো অধিনায়ক আসগর স্তানিকজাই। তখন তামিমের ব্যাটে রান মাত্র ১।

তারপর আর পিছু ফিরে তাকানোর সময় কোথায়? তিনি যে দেশসেরা ব্যাটসম্যান সেটা আরো একবার জানিয়ে দিলেন। হোম অব ক্রিকেটের দর্শকদের আনন্দে ভাসালেন চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে। টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টুয়েন্টি- তিন ফরম্যাটে দেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক আফগানদের বোলারদের নিয়ে খেললেন। সেই মারকুটে ওপেনার আরো বড় ব্যাট হাতে রাজত্ব করলেন। সাব্বিরকে নিয়ে ২৪.৪ ওভারে ১৪০ রানের দুর্দান্ত জুটি গড়েন বাংলাদেশের এই ওপেনার।

দৌলত জাদরানের করা ইনিংসের ৩৭তম ওভারের প্রথম বলে সিঙ্গেল নিয়ে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন তামিম। ১১০ বলে ক্যারিয়ারের সপ্তম সেঞ্চুরি পূর্ণ করতে ১০টি চার হাঁকান তামিম। শেষ পর্যন্ত ১১৮ বলে ১১৮ রানে এসে থামেন তামিম। যাতে ছিল ১১ চার আর দুই ছক্কা। সাকিবকে টপকে ওয়ানডেতে এখন সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি তারই। সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে আফগানদের বিপক্ষে করেছিলেন ৮০ রান। দ্বিতীয় ম্যাচে তার ব্যাটে ২০ রান।

তার আগেই অবশ্য সাজঘরের পথ ধরেন সাব্বির রহমান। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো প্রিয় পজিশন তিন নম্বরে নেমে নিজেকে উজার করে দেন তিনি। কারিয়ারের তৃতীয় অর্ধশতককে অবশ্য বেশি বড় করতে পারেননি এই স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান। তবে যা করেছেন সেটিই ক্যারিয়ার-সেরা। সাব্বির ৭৯ বলে খেলেন ৬৫ রানের ইনিংস। ওয়ানডেতে তার আগের সেরা ইনিংসটি ছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, করেছিলেন ৫৭ রান।

এক পর্যায়ে ৩৮.৪ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশের রান ছিল ২১২। মনে হচ্ছিল তিনশ ছাড়ানো ইনিংস বুঝি দেখছে মিরপুর। কিন্তু শেষটা ভাল হলো না। শেষ দিকে যা একটু লড়লেন মাহমুদউল্লাহ (২২ বলে ৩২)। সাড়ে আট বছর পর নেমে ব্যাট হাতে হতাশ করলেন মোশাররফ হোসেন রুবেল। স্লগ ওভারে ১৪ বলে মাত্র ৪ রান তুলতেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হলো তাকে।

ব্যর্থ মুশফিকও। কিপিংয়ের মতো ব্যাটেও সুসময় যেন হারিয়ে ফেলেছেন এই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। শনিবার ১৩ বলে ১২ রান করে ধরলেন সাজঘরের পথ। তবে সব মিলিয়ে দলের স্কোরটা অবশ্য বেশ ভালই দেখাচ্ছিল। ৫০ ওভারে ৮ উইকেটে হারিয়ে ২৭৯ তো চ্যালেঞ্জিং স্কোরই।

আফগানদের হয়ে মোহাম্মদ নবি ৪১ রানে নেন ২ উইকেট। আরেক স্পিনার রশিদ খান ৩৯ রানে শিকার করেন সমান উইকেট।

সব মিলিয়ে ব্যাট হাতে সিরিজটা বেশ স্মরণীয় হয়েই থাকল তামিমের। তবে আসল পরীক্ষা আসছে সপ্তাহে। তখন লড়তে হবে শক্তিশালী ইংল্যান্ডের সঙ্গে। সেই লড়াইয়ের আগে অনুশীলনটা দারুণ হল।

এনিয়ে টানা ৬টি ওয়ানডে সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। যেখানে জায়ান্ট দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, ভারতকে একবার করে ও জিম্বাবুয়েকে দু’বার সিরিজ হারানোর সুখস্মৃতির সঙ্গে যোগ হলো আফগান বধের গল্প। এবার সামনে শক্তিশালী ইংল্যান্ড। সত্যিকারের পরীক্ষা বুঝি এবারই শুরু। ৭ অক্টোবর এই মিরপুরেই প্রথম ওয়ানডেতে ইংলিশদের সঙ্গে লড়বে মাশরাফির বাংলাদেশ। তার আগে এই সিরিজ নিশ্চিত করেই অনেক কিছু শিখিয়ে দিল টাইগারদের।



মন্তব্য চালু নেই