আন্তর্জাতিক চাপ আমলে নিচ্ছে না সরকার
সিটি নির্বাচনের অনিয়ম, ভোট কারচুপি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগে বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা, রাষ্ট্র উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে। তবে এ ধরনের নিন্দা প্রকাশের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশীদের সতর্কভাবে মন্তব্য করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশীদের এই বার্তাও দেওয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য না করাই ভাল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করার আগে সবকিছু জেনে ও বুঝে মন্তব্য করতে হবে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান সরকার কৃতিত্ব ও সাফল্যের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশীদের মন্তব্য করাটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না।’
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক ও গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিদেশীদের সতর্কভাবে মন্তব্য করার পরামর্শ দিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিদেশীদের উদ্দেশে দেওয়া বার্তায় বলা হয়েছে, সরকার সবার আগে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এর পর মানবাধিকার সংরক্ষণ। দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন নিশ্চিতের ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে মানবাধিকার পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হলেও উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে মানবাধিকার সংরক্ষণের বিষয়টিও শক্তিশালী হবে।
সদ্যসমাপ্ত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে ও পরে বিভিন্ন পর্যায়ের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সিটি নির্বাচনের অনিয়ম, ভোট কারচুপি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগে বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্র উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন ভোটের কারচুপির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিচারের মুখোমুখি ও দ্রুত নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, এরই মধ্যে দেশের বাইরে অবস্থিত বাংলাদেশের সকল মিশন বিদেশীদের সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করে জানিয়েছে।
মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘সিটি নির্বাচন নিয়ে অনিয়ম হলে সেটা সরকারকে জানাতে হবে। এখানে-সেখানে বলে তো লাভ নেই। বিদেশীরা সরকারকে এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। সরকার বিদেশীদের মোকাবেলা করতে সবদিক থেকে প্রস্তুত রয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের সবগুলো মিশনকে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ কোনোপ্রকার আন্তর্জাতিক চাপে নেই। বাংলাদেশ এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে। এক সময় বিদেশী সহায়তার ওপর নির্ভর করত কিন্তু দেশের মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে। বার্ষিক প্রবৃদ্ধি এখন ৬ শতাংশেরও বেশী। সামনের বছর আমরা এই হার ৭ শতাংশে নিয়ে যাব। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যবসাবান্ধব দেশ হওয়ায় বিদেশীরা এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। চিকিৎসাক্ষেত্রে আমরা অনেক সাফল্য অর্জন করেছি, মাতৃ-মৃত্যুহার সন্তোষজনক। শিক্ষায় এগিয়েছি এবং আরও এগোচ্ছি। বিজ্ঞানে সাফল্য অর্জনের জন্য পৃথিবীর সেরা সার্নের সঙ্গে বাংলাদেশ সমাঝোতা করেছে। বাংলাদেশ অনেক দূর যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। এই যাত্রাপথে বিদেশীরা যাই বলুক না কেন, বাংলাদেশের তাতে কিছু যায় আসে না। কেননা জনগণের উন্নয়নে যা প্রয়োজন সরকার তা-ই করবে।’
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ও ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ‘সরকার কোনোপ্রকার আন্তর্জাতিক চাপে নেই। নির্বাচন নিয়ে কূটনীতিকদের মন্তব্য শিষ্টাচারবহির্ভূত। নির্বাচন নিয়ে তাদের (বিদেশীদের) কোনো পর্যবেক্ষণ থাকলে তা নির্বাচন কমিশনকে জানাবে। নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নেবে। তারা তো নির্বাচন কমিশনে কিছুই জানায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকলে তা বাংলাদেশ নিজেই সমাধান করতে পারবে। বিদেশীরা তো সমস্যার সমাধান করে দিতে পারবে না। এর আগে তো সমস্যার সমাধান করতে নিনিয়ান ও অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকা এসেছিলেন। কিন্তু তারা তো সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। বাংলাদেশের মানুষ নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান করেছে।’
এর আগে গত ৪ মে সদ্য শেষ হওয়া সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে বিজয়ী আ জ ম নাছির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই দিন শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকার কোনো বিদেশী চাপে নেই।’
তারও আগে গত মার্চের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত ২৮তম অধিবেশনে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার করেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘পর্যাপ্ত উন্নয়ন ছাড়া সব সময় সবার মানবাধিকার রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারে না।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ওই দিন আরও বলেন, ‘মানবাধিকার পরিষদ শুধু মানবাধিকারের ইস্যুগুলো তুলে ধরবে না, বরং মানবাধিকার নিশ্চিত করতে কার্যকর পথ বাতলে দেওয়ার সংস্থায় পরিণত হবে।’
‘সরকার বলছে, বিদেশীরা সিটি নির্বাচন নিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ নির্বাচন কমিশনে না জানিয়ে যত্রতত্র বলে বেড়াচ্ছে। এতে কোনো ফল আসবে না। আর বিদেশীদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ কূটনৈতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘন।’— এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট ডব্লিউ গিবসন, জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি ডব্লিউ ওয়াটসকিন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরো মায়াদু, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার দূতাবাস ও সুইডেনের রাষ্ট্রদূত জোহান ফ্রিজেলকে পক্ষ থেকে গত ৩ মে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেওয়া হয়। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কারও পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি চায় না বিদেশীরা। আবার বাংলাদেশ ইস্যুতে পশ্চিমা ও ইউরোপের সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে চীন, ভারত ও কয়েকটি ইসলামী রাষ্ট্রের। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আপাতত বাংলাদেশ ইস্যুতে নীরব পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদেশীরা।
সূত্রগুলো আরও বলছে, বিদেশীদের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করে সিটি নির্বাচনের অনিয়মের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীর কাছে কোনোকিছু বলার পর আর অন্য কোথাও বলা হল কিনা, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতা থাকলে এত কথা উঠত না। দ্য রিপোর্ট
মন্তব্য চালু নেই