আত্মগোপনে থেকেই আন্দোলন চাঙ্গার চেষ্টায় বিএনপি
গুলশানে নিজ কার্যালয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অবরোধের ৪২তম দিন পার করলেন রবিবার। তিনবার ক্ষমতায় থাকা দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশের তালা ঝুলানো রয়েছে ৪২ দিন।
দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বেশ কিছু সিনিয়র নেতা রয়েছেন কারাগারে। আরও কিছু সিনিয়র নেতা আছেন আত্মগোপনে।
এমতাবস্থায় খালেদা জিয়ার নির্দেশনায় টানা অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি পালন করছে দলটি। তবে টানা অবরোধ ও বার বার হরতাল অনেকটাই ভোঁতা হয়ে গেছে। জনগণও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এ সব কর্মসূচিতে। রাজধানী ঢাকার জীবনযাপন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। সরকারি ও সাপ্তাহিক ছুটির বাইরে রাজধানীর অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলছে স্বাভাবিক গতিতে। ব্যবসা মন্দা হলেও ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসাসহ সকল প্রকার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানও খোলা রাখা হচ্ছে। মোদ্দাকথা হরতালে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া ছাড়া প্রায় সব কার্য্ক্রমই স্বাভাবিকভাবে চলছে। রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখতে পেরে সরকারও কিছুটা স্বস্তির মধ্যে রয়েছে। সে কারণে সংলাপ ও সমঝোতা না করার পক্ষে নিজেদের অবস্থানে এখনো অনড় ক্ষমতাসীন দলটি। বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা বা সংলাপের আহ্বান থাকলেও আগ্রহ প্রকাশ করেনি আওয়ামী লীগ। বরং আরও ‘দমনপীড়ন’ চালিয়ে আন্দোলন ‘নস্যাৎ’ করার পরিকল্পনায় রয়েছে দলটি। তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা বিএনপির গায়ে ‘জঙ্গিবাদে’র তকমা এঁটে দেওয়ার চেষ্টাও করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
এ পরিস্থিতিতে বিএনপি কীভাবে আন্দোলন এগিয়ে নেবে সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আন্দোলনের কৌশল বদলেছে দলটি। এরই অংশ হিসেবে আত্মগোপনে থেকে দলের শীর্ষ নেতারা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে এ সব তথ্য পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল জানান, দলের সিনিয়র নেতারা কৌশলগত কারণেই আত্মগোপনে আছেন। তবে নেতারা আত্মগোপনে থেকেই কর্মীদের কীভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে সেই নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন।
৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নেতৃ্ত্বাধীন সরকারের বছরপূর্তিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। কিন্তু পুলিশের অনুমতি না পাওয়ায় ওই কর্মসূচি পালন করতে পারেনি দলটি।
তবে আওয়ামী লীগ বলছে, ‘জনসমর্থন’ হারিয়ে বিএনপি এখন ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে।
গাজীপুরে এক অনুষ্ঠানে রবিবার আওয়ামী লীগ নেতা রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেছেন, ‘বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখন চারু মজুমদারের মতো আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির নেতা হয়েছেন।’
৩ জানুয়ারি রাত থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন তার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ‘অবরুদ্ধ’ আছেন। বিএনপির অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকার খালেদা জিয়াকে ‘অবরুদ্ধ’ করে রেখেছেন।
খালেদা জিয়াকে ‘অবরুদ্ধ’ করার প্রতিবাদে এবং সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনের দাবিতে ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। অবরোধের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিতে এখন শুক্র ও শনিবার ছাড়া বাকি দিনগুলোতে হরতালও পালন করছে দলটি।
কর্মসূচি চলাকালে রাজপথে শীর্ষ নেতারা না থাকলেও প্রকাশ্যে ছিলেন। কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেফতার হওয়ার পরে অনেক সিনিয়র নেতা আত্মগোপনে চলে যান।
৬ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে মির্জা ফখরুল ইসলামকে আটক করে পুলিশ।
এরপর আত্মগোপনে থেকে দলের যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কর্মসূচি ঘোষণা করছিলেন। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি আটক হন তিনি।
রিজভী গ্রেফতার হওয়ার পর বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ আত্মগোপনে থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কর্মসূচি ঘোষণা করতে থাকেন।
এদিকে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের দাবি, টানা অবরোধ-হরতালে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। দেশের অন্যান্য জেলার সঙ্গে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা।
ঢাকার বাইরে বিএনপি ও জোটের শরিক দলের কর্মীরাই আন্দোলন চালিয়ে নিচ্ছেন বলে দাবি বিএনপির। কর্মসূচি বাস্তবায়নে আত্মগোপনে থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন দলের সিনিয়র নেতারা। এমন অবস্থায় খালেদা জিয়ার ঘোষণা ছাড়া আন্দোলন থামবে না বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান বলেন, ‘ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) নির্দেশনায় নিজ জেলায় অবস্থান করে সকল আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছি। সদর আসনসহ আটটি নির্বাচনী এলাকার আন্দোলনের খবর নিচ্ছি।’
বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া যোগাযোগ ‘বিচ্ছিন্ন’ হওয়ার আগেই চলমান আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ করেন। সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে স্তরে স্তরে সে কৌশলও ভাগ করে দিয়েছেন তিনি। মূলত বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতার নির্দেশেই চলমান আন্দোলনের পালে হাওয়া লেগেছে বলে মনে করছেন জোটটি।
সূত্রটি জানায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর বিএনপি জোট। খালেদা জিয়াকে যদি জেলেও নেওয়া হয় তাতেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি আছে। ফলে আন্দোলনের গতি না কমিয়ে আরও বেগবান করার কৌশলে এগোচ্ছে দলটি।
আত্মগোপনে থাকা বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ গত সোমবার বিকেলে গণমাধ্যমকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘গণবিরোধী অবৈধ সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’
তার স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে গত সপ্তাহে ৭২ ঘণ্টার হরতাল বাড়িয়ে ১০৮ ঘণ্টা করা হয়। চলতি সপ্তাহেও তিনিই দলের পক্ষে ৭২ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে নাটোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. আমিলুন হক বলেন, ‘যখনই কোনো নতুন কর্মসূচি, অর্থাৎ হরতাল ঘোষণা করা হয় তখনই আমরা গণমাধ্যমের কল্যাণে তা জানতে পারছি। এ ছাড়া আন্দোলন ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নেত্রীর (খালেদা জিয়া) পূর্বের নির্দেশনার আঙ্গিকেই কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি। দলের অনেক সিনিয়র নেতা আত্মগোপনে থাকলেও তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী বাস্তবতার নিরীখে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি।’
বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীতে আন্দোলন জোরদার করতে ধাপে ধাপে কর্মসূচি নেওয়া হবে। আর এ জন্য দলের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তৃণমূলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঢাকা মহানগর বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদলসহ দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে আরও সক্রিয় হওয়ার নির্দেশনা আছে।
নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ৩ জানুয়ারি রাতে রিজভীকে ডিবি পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় পুলিশ। প্রধান ফটকে ঝুলানো হয় তালা। রবিবার রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ ছিল।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেফতার হওয়ার পর একে একে যুগ্ম-মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান, নিবার্হী কমিটির সদস্য বেলাল আহমেদ, উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু, বিশেষ সম্পাদক নাদিম মোস্তফা, দফতর সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোছাদ্দেক আলী ফালু গ্রেফতার হয়েছেন।
এর আগে আটক হন স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আছেন আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সারা দেশে শত শত নেতাকর্মীকে আটক করেছে। এদের মধ্যে অনেকেরই খোঁজ মিলছে না বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাদের নেতাকর্মীদের গুম ও হত্যা করা হচ্ছে। দ্য রিপোর্ট
মন্তব্য চালু নেই