ফলাফল জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে

‘আতঙ্ক ও উৎসবের’ সিটি নির্বাচন

আতঙ্ক, আশঙ্কা ও উৎসবের আমেজের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বড় প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশন নির্বাচন (ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম)। অরাজনৈতিক নির্বাচন হিসেবে আইনগতভাবে বলা হলেও নির্বাচনী প্রচারণায় দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের অংশগ্রহণ নির্বাচনের গুরুত্বটা জাতীয়ভাবেই দেখা হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

একই সঙ্গে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান ক্ষমতাসীন দল, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও সফলতা ও স্বচ্ছতা প্রমাণের অগ্নিপরীক্ষা বলে মনে করেন তারা। নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় রাজনীতির ওপর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাব ফেলতে পারে বলেও মনে করছেন তারা।

মঙ্গলবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। আইনগত বাধা থাকায় অরাজনৈতিক এই নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের সরাসরি মনোনয়ন না দিলেও সমর্থন দিয়েছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান বা প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার কেউই সরাসরি সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা করতে না পারলেও পরোক্ষভাবে থেমে নেয় কেউই।

দলীয় সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে ভোট না চাইলে প্রধানমন্ত্রী গণভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া হরতাল-অবরোধের নামে দেশের মানুষের সর্বনাশ করেছেন, নির্বিচারে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করলেন, উনি আবার মানুষের কাছে কোন মুখে ভোট চান? তার মতো জালেম-খুনীর ডাকে জনগণ সাড়া দিবে না। যাদের ন্যূনতম মনুষ্যত্ব রয়েছে তারা কখনই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোটকে ভোট দিবে না। বরং হত্যার শিকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ প্রতিশোধ নিলে কার বিরুদ্ধে নেবে, সেটিও বিএনপি নেত্রীর ভেবে দেখা উচিত।’ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যকে নির্বাচনী আচরণ বিধির লঙ্ঘন না হলেও ভোটের পরিবেশে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন অনেকেই।

অন্যদিকে সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও দুইবারের বিরোধীদলীয় নেত্রী বিএনপির চেয়ারপারসন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় নামেন ১৮ এপ্রিল। অবশ্য বর্তমানে মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার কোনো পদে না থাকায় আচরণ বিধি লঙ্ঘনের দায়টা পড়ছে না তার ওপর।

এদিকে দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় নেমে দ্বিতীয় দিন থেকেই ‘বাধার’ সম্মুখীন হন খালেদা জিয়া। ১৯ এপ্রিল ‘সরকারদলীয়’ নেতাকর্মীরা কালো পতাকা দেখিয়ে খালেদা জিয়ার প্রচারণায় বাধার সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ করা হয়। ২০ এপ্রিল উত্তর সিটি করপোরেশনে দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পক্ষে প্রচারণায় নামলে রাজধানীর কারওয়ানবাজার এলাকায় ‘সরকারদলীয়’ নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয় খালেদা জিয়ার গাড়িবহর।

ওই হামলায় খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিএসএফ (চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্স) সদস্যসহ বেশ কয়েকজন দলীয় নেতাকর্মী আহত হন। ২১ এপ্রিল দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসের পক্ষে প্রচারণায় খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে তৃতীয়বারের মতো হামলা করা হয় এবং সর্বশেষ ২২ এপ্রিল খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের ওপর ও সিএসএফ সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায়। প্রতিটি ঘটনায় বিএনপি সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।

অন্যদিকে সরকারের শীর্ষ পর্যায় প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ পক্ষ থেকে এ ধরনের ঘটনাকে জনরোষের অংশ হিসেবে বলা হয়েছে।

সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে কথা বলা হলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণার পর থেকে উভয় দলের নেতাকর্মী ও প্রার্থীদের মধ্যে উৎসব দেখা গেছে। কিন্তু সাধারণ ভোটার ও নগরবাসীর মধ্যে সেই উৎসব কতটুকু ছিল সেটা নিয়েই প্রশ্ন। তারপর সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটা ঘটনা সাধারণ ভোটার ও নগরবাসীর মধ্যে উৎসবের বদলে উৎকণ্ঠা-আতঙ্কটায় বাড়িয়ে দিয়েছে বলে আমি মনে করি। আমার মতো সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই প্রশ্ন আসতে পারে বিশৃঙ্খলা রোধ করতে নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কতটুকু সামর্থ্য হবে।’

সুজন সম্পাদক বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা দেখে এমন কোনো নিশ্চয়তা পাচ্ছি না, যে তারা নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকবেন। কিছু কিছু ঘটনায় নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমনটি যদি নির্বাচনের দিনও হয় তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোনো অবকাশ নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘অরাজনৈতিক নির্বাচন হলেও তিন সিটি নির্বাচনের ওপর দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থা নির্ভর করছে। একই সঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে ক্ষমতাসীন দল, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সফলতাও নির্ভর করছে। তারা কতটুকু অবাধ, ‍নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে পারবে সেটায় তাদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা।’

বদিউল আলম বলেন, ‘যদি সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন সরকার অনুষ্ঠিত করতে পারে তাহলে সরকার ও নির্বাচন কমিশন উভয়ের জন্য এটা সফলতা বলে বিবেচিত হবে। অন্যথায় দেশে যে অস্থিতিশীল রাজনীতি চলছে তা আরও অস্থিতিশীল হতে পারে। ভাল একটা নির্বাচন উভয় জোটের মধ্যে একটি সমঝোতা ও সহিষ্ণুতা সৃষ্টি করতে পারে। আবার নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার বদলে সঙ্কট চরম আকার ধারণ করতে পারে।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা বা সম্ভাবনা কোনোটায় ভবিষ্যৎ বাণী করা সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশ সব সম্ভবের একটি দেশ। সকালে রাজনীতির চিত্র এক রকম তো বিকেলে আরেক রকম। তবে এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো আশার বাণী নেই। তারপরও আশা করব নির্বাচনটা সুষ্ঠু ও সফলভাবে শেষ হোক। কারণ এই নির্বাচনটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা অরাজনৈতিক নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত হলেও জাতীয় রাজনীতিতে বেশী গুরুত্ববহন করছে। কারণ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও চলতি বছর জানুয়ারি থেকে দেশের যে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি চলছে তা আপাতত নীরব হলেও সমাধান হয়নি। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।’

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘আশঙ্কার বিষয়টি হল নির্বাচন কমিশন এখনো পর্যন্ত প্রতিপক্ষ বা সরকারি বিরোধীদের মন রক্ষা করতে পারেনি। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও প্রার্থী বা প্রার্থীর ব্যক্তি ইমেজ দেখে তাদের দায়িত্ব পালন করছে বলেও দৃশ্যমান। তাই এই দু’টি সংস্থাকে সবচেয়ে বড় ভূমিকার রাখতে হবে। আর নির্বাচনী উৎসবের চাইতে উৎকণ্ঠাটাই এখনো পর্যন্ত বেশী।’ দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই