আচরণবিধির তোয়াক্কাই করছেন না প্রার্থীরা
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধির তোয়াক্কাই করছেন না মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। বিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সরকার সমর্থিত প্রার্থীরাই এগিয়ে রয়েছেন বেশি। এ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের একাধিক অভিযোগ নির্বাচন কমিশনের জমা পড়লেও, অভিযোগ উঠেছে বিষয়টি আমলেই নিচ্ছে না কমিশন।
গত কয়েক দিনে দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও পাড়া-মহল্লা ঘুরে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ভয়াবহ চিত্র চোখে পড়েছে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বিধি-নিষেধের কড়াকড়ি না থাকলেও তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন কমিশন আচরণবিধি মেনে চলার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করে। কিন্তু কমিশন কাগজে কলমে কড়াকড়ি আরোপ করলেও বাস্তবে তার বাস্তবায়ন নেই। বিশেষ করে প্রতীক বরাদ্দ হওয়ার পর থেকে প্রভাবশালী প্রার্থীরা একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘন করে গেলেও তাদের ব্যাপারে শৈথিল্যই দেখাচ্ছে কমিশন। এর ফলে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নগরীর পাড়া-মহল্লায় মিছিলে প্রার্থীদের নামের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে দলীয় শ্লোগান।
বিধি মোতাবেক দুপুর দুইটা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বমোট ৭ ঘণ্টা প্রচারণায় মাইক ব্যবহারের সুর্নিদিষ্ট নীতিমালা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। প্রার্থীরা সকাল থেকে রাত অবধি একাধিক মাইকে ভোট প্রার্থনা করছেন। তাছাড়া একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর জন্য একটি নির্বাচনী ক্যাম্প করার অনুমতি থাকলেও কোনো কোনো ওয়ার্ডে একাধিক নির্বাচনী ক্যাম্প চোখে পড়ছে। তাছাড়া নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো রাজনৈদিক দল বা দলের প্রধান কিংবা কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির ছবি ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও সরকারদলীয় প্রার্থীরা এসবের তোয়াক্কাই করছেন না। এছাড়াও পরিবেশের ক্ষতিকারক যে কোনো কাজে পলিব্যাগ নিষিদ্ধ হলেও বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষা পেতে নির্বাচনী পোস্টার পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে সাঁটানো হয়েছে রাজধানীর অলিতে-গলিতে। এমনকি দেয়ালেও লাগানো হচ্ছে এই পোস্টার।
নির্বাচনী আচরণবিধিতে বড় ধরনের জনসভা নিষিদ্ধ হলেও পথসভার নামে জনসভা করে বেড়াচ্ছেন প্রার্থীরা। জনসভায় ব্যবহার করা হচ্ছে রঙিন পোস্টার ও রাজনৈতিক দলের স্লোগান। এমনকি বিভিন্ন দলের পরিচিত ও মার্কা মারা রাজনৈতিক নেতারাও এসব জনসভায় বক্তৃতা করছেন।
সরকারি দল সমর্থিত কাউন্সিলর পার্থী মো. আবু তাহের খানের ব্যাডমিন্টন র্যাকেট মার্কায় ভোট চেয়ে রঙিন ব্যানারে বৈশাখী কনসার্টের আয়োজন করেছে মোহাম্মদপুর থানাধীন ৪৭ নং ওয়ার্ড যুবলীগ (সাবেক ৩৪)। ওই ব্যানারে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রাসেল, যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হারুনর রশিদসহ একাধিক রাজনৈতিক নেতার ছবি রয়েছে। অথচ এ ধরনের আয়োজন নির্বাচনী আচরণবিধিতে একেবারেই নিষিদ্ধ।
বুধবার দুপুরে জাতীয় পার্টি সমর্থিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রপ্রার্থী বাহাউদ্দিন আহম্মেদ বাবুল তার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার সময় ৪ রঙের ব্যানার ব্যবহার করেন। ব্যানারের ডান পাশে কোট-টাই পরিহিত বাবুলের রঙিন ছবি দেখা যায়। বামপাশে কালো রঙে ছাপা হয়েছে তার প্রতীক ‘চাকা’র ছবি। ব্যানারে উপরের অংশে নীল রঙে লেখা হয়েছে ‘যানজটমুক্ত তিলোত্তমা ঢাকা’। অথচ আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী তাদের প্রচারণায় রঙিন ব্যানার বা পোস্টার ব্যবহার করতে পারবে না।
আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় নামার শুরুতেই আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল। বিএনপি সমর্থিত এ প্রার্থী নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করতে গিয়ে আচারণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর গুলশান এলাকায় অস্থায়ী কার্যালয়ে বসে আধুনিক ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। তাবিথের ইশতেহার অনুষ্ঠানে যে রঙিন ব্যানার ব্যবহার করা হয়েছে তা আইনসিদ্ধ নয়। অবশ্য তাবিথ বলেছেন, এটা তিনি খেয়াল করেননি।
নির্বাচনে ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে কোনো প্রকার নির্বাচনী প্রচারণা বা ভোট প্রার্থনা করা নিষিদ্ধ হলেও কোনো প্রার্থীই তা মানছেন না। সবাই এলাকার মসজিদ ও মন্দিরসহ উপাসনালয়গুলোতে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করছেন।
নির্বাচনে আঠা দিয়ে দেয়ালে পোস্টার লাগানো নিষিদ্ধ হলেও বুধবার রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পাশের দেয়ালগুলোতে দেখা গেছে সরকার সমর্থিত প্রার্থী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকনের ইলিশ মাছ মার্কার পোস্টার দেয়ালে লাগানো হয়েছে আঠা দিয়ে। তা ছাড়া পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ইলিশ মাছকে বৈশাখী প্রচারণার অংশ দেখিয়ে রঙিন পোস্টার ও ব্যানার বানিয়ে সাঈদ খোনের ছবি দিয়ে বিভিন্ন অলি-গলিতে সাঁটানো হয়েছে।
ডিএসসিসির ৭ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আব্দুল বাসিত খান বাচ্চুর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর ছবি সম্বলিত রঙিন ব্যানার টানানো রয়েছে।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্মকর্তাদের সামনেই আচরণবিধি লঙ্ঘনের এসব ঘটনা ঘটলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। অথচ আইনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাও রয়েছে কমিশনের হাতে। কিন্তু এ পর্যন্ত কমিশন বিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় শোকজকেই সর্বোচ্চ শাস্তি হিসাবে দেখছে। আর ইসির এই শৈথিল্য বা শোকজ ব্যবস্থার কারণে আচরণবিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন প্রার্থীরা।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকতা মিহির সরওয়ার মোরশেদ বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য আমাদের পাশাপাশি প্রার্থীদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। এজন্য সবাইকে আমরা আচরণবিধি মেনে চলার আহ্বান করা হয়েছে। প্রার্থীদের আইন মানতে বাধ্য করতে ইসি তার সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এরইমধ্যে বেশ কয়েক জনকে জরিমানা ও শোকজ করা হয়েছে।’
দুই সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত দুই শতাধিক লোককে শোকজ করা হলেও তারা কোনোমতে দায়সারাভাবে জবাব দিয়েই পার পেয়ে যাচ্ছেন। আবার কাউকে জরিমানাও করা হয়েছে। জরিমানার পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ টাকা। কিন্তু এর পরেও তারা সচেতন হননি। নির্বাচনে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের প্রচারণায় অংশগ্রহণে বিধিনিষেধ থাকলেও তা মানছেন না মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীরা। তবে এরমধ্যে এরকম বিধি লঙ্ঘনের দায়ে এ পর্যন্ত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে কমিশনে। আচরণবিধি লঙ্ঘন ঠেকাতে এরইমধ্যে দুই সিটি করপোরেশনে ৬ জন করে ১২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে নির্বাচনী মাঠে তাদের কার্যক্রম চোখে পড়েনি।বাংলামেইল
মন্তব্য চালু নেই