আওয়ামী লীগের আস্থা প্রশাসনেই

রাজনীতি সত্যি সত্যিই রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে! এ কারণেই সম্ভবত আওয়ামী লীগ বিরোধীদের রাজনৈতিক কর্মসূচির মোকাবেলা রাজনৈতিকভাবে করার মনোভাব দেখাচ্ছে না। সরাসরি প্রশাসনকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। অন্তত গত কয়েক দিন পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির কর্মকর্তাদের বক্তব্যে সেই ধারণাটাই প্রবল হচ্ছে। অবশ্য নাশকতাকারীদের মধ্যে ভীতি প্রদর্শনের জন্য এমন আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেয়া হচ্ছে বলেও অনেকে মনে করেন। কিন্তু কারো কারো বক্তব্যের মোড়কে যখন রাজনীতি ঝলমল করছে তখন তাদের অবস্থান সত্যিই ভাবাচ্ছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সরকারবিরোধী আন্দোলন মোকাবেলায় প্রশাসনেই আস্থা রাখছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। সহিংসতা দমনে ইতোমধ্যে প্রশাসনিক পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করে রেখেছে সরকার। তারই অংশ হিসেবে বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুরনো মামলাগুলো সক্রিয় করা হয়েছে। র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদেরও মাঠে নামানোর পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের।

বিএনপির আন্দোলন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার সামর্থ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কারণ মেয়াদোত্তীর্ণ ৭৩টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ৩২টি জেলার সম্মেলন হয়েছে গত ছয় বছরে। সম্মেলন হওয়ার পর দুই বছরের বেশি সময় পার হলেও নতুন কমিটি ঘোষণা হয়নি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের। এছাড়া সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও নতুন কমিটি হয়নি। এর মধ্যে ছাত্রলীগ, যুব মহিলা লীগ উল্লেখযোগ্য। আর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক অবস্থা তো বলাবাহুল্য। ফলে প্রশাসনে আস্থা রাখতে বাধ্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ।

সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি জেলা নেতাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে। পাশাপাশি সারাদেশে বিজিবি মোতায়েন করে বিশেষ অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতিও সরকারের আছে। এক সপ্তাহের (মিশন সেভেন ডে’জ) মধ্যে যে কোনো মূল্যে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যা যা করণীয় তার সব কিছুই করবে সরকার। নাশকতা না থামালে পর্যায়ক্রমের কঠোরতার মাত্রা বাড়বে। ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে সেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এদিকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিভিন্ন মামলায় এবং মামলা ছাড়া প্রায় ৩৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী এমন দাবিই করেছেন।

সূত্র জানায়, অবরোধে নাশকতা চলছে এমন জেলাগুলোতে বিজিবির সংখ্যা আরো বাড়ানো পরিকল্পনা রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। প্রতি রাতেই তল্লাশি করার নির্দেশনার পাশাপাশি পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযান চলবে।

গত কয়েকদিনের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানদের বক্তব্যকে ঘিরে নতুন করে উত্তেজনা ও উদ্বেগের জন্ম হয়েছে।

গত শুক্রবার রংপুরে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বিএনপি জোটের চলমান আন্দোলন ও নির্বাচন প্রসঙ্গে বক্তব্য দেন বিজিবি প্রধান, পুলিশ ও র‌্যাবের প্রধানরা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পদে থেকে এ ধরনের বক্তব্য দেয়া কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য বলেও আখ্যা দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা।

এদিকে রোববারও চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এম হাফিজ আক্তার বলেছেন, আন্দোলনের নামে মানুষের জানমাল ক্ষতি করলে পুলিশের ওপর অর্পিত ক্ষমতা বলে পুলিশ অব্যশই গুলি চালাতে পারে।

বিএনপি জোটের পক্ষ থেকে এসব বক্তব্যকে সমালোচনা করে বলা হচ্ছে ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পদে এমন সব চরম দলবাজ লোকদের বসানো হয়েছে যে, তারা এখন আইন কানুন এবং তাদের আওতা, পরিধি ও কর্তব্যের সীমারেখা মেনে চলারও ধার ধারছে না। ’

বিরোধী দমনে প্রশাসনকে ব্যবহারের প্রমাণ মেলে বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদের বক্তব্যে। তিনি হরতাল ও অবরোধে নাশকতাকারীদের প্রতিরোধে, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় এবং আত্মরক্ষার প্রয়োজনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) প্রয়োজনে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করবে- এমন ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি বোমা বহনকারীকে ‘ক্যাজুয়ালটি’ (হতাহত) করারও বৈধতা দিয়েছেন তিনি।

অপরদিকে হরতাল-অবরোধকে অন্যায় যুদ্ধ আখ্যায়িত করে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেছেন, ‘বিএনপি-জামায়াত অন্যায় যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ যুদ্ধে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। যুদ্ধের ময়দানে জীবন নিয়ে আসা যাবে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার সম্ভবনা কম। কারণ অন্যায় যুদ্ধ ঘোষণাকারীদের আমরা পরাজিত করে বিজয়ী হবো।’

রংপুরের ওই পুলিশের মহাপরিচালক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘যারা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ভুল করেছে, তার খেসারত জনগণ দিবে না। বিএনপি-জামায়াতকেই এর খেসারত দিতে হবে। এদেশে আমরা আর কোনো অশুভ শক্তির উত্থান হতে দেব না। এবার আর কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।’

সরকারের মন্ত্রী, এমপিদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যও একই রকম বা এর চেয়েও আক্রমণাত্মক। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রী কামরুল ইসলাম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার কথা না বলে প্রশাসনকে আরো কঠোর হওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন।

বিএনপির চলমান আন্দোলন মোকাবেলায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিকভাবে কতোখানি প্রস্তুত এ ব্যাপারে সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি জোটের কোনো আন্দোলন নেই। তারা যা করছে তা হলো সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড। এগুলো প্রতিহত করার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত আছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জনগণ সম্পৃক্ত আছে। কারণ বিএনপির আন্দোলনের নামে সংহিতায় দেশের মানুষ সাড়া দেয় নাই। খালেদা জিয়া অবরোধের নাটকের মধ্যে আছে। দেশের কোথাও অবরোধ নেই। খালেদা জিয়া এখন আর রাজনৈতিক নেতা নেই। তিনি এখন বিচ্ছন্নবাদী নেতা হয়ে গেছেন।’



মন্তব্য চালু নেই