আওয়ামী লীগকে গিলে খাচ্ছে ভুঁইফোঁড়

‘আওয়ামী লীগে আগাছা সংগঠন বাড়ছে’ বলে একবার মন্তব্য করেছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দলের নাম ভাঙিয়ে এসব সংগঠন ডাল-পালা মেলছে, তাদের কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। বিগত পাঁচ বছরের শাসনামলে এসব ‘ভুঁইফোঁড় সংগঠন’ রাজধানীতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারের সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধের নামের ওপর ভর করে এসব সংগঠন গড়ে উঠছে। খবর ডেইলি স্টারের।

নাম সর্বস্ব এসব সংগঠন সম্পর্কে খুব কমই খবর রাখে সরকার। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের নাম ভাঙিয়ে এসব সংগঠন কাড়িকাড়ি টাকা কামাই করার নজির সৃষ্টি করছে। আইনঅনুসারে, মুক্তিযুদ্ধের নামে কোনো সংগঠন গড়তে চাইলে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু এসব সংগঠনের কোনোটিই অনুমতির দাঁড় দাড়েনি।

সবকিছুই খুব সস্তা
এসব সংগঠন খুব সহজেই তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, বিশেষ বিশেষ দিবসগুলোতে ‘ভুঁইফোঁড় সংগঠন’গুলো সভা কিংবা সেমিনারের আয়োজন করে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ কিছু নেতা যারা সরকারের সাইড লাইনে রয়েছেন তারা উচ্চ পর্যায়ের দৃষ্টি কাড়তে এসব সংগঠনকে অর্থায়ন করে থাকেন। আর এ অর্থায়নের জন্য এসব নেতাকে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি কিংবা বিশেষ অতিথি করা হয়। টাকার বিনিময়ে কিছু লোককে ভাড়া করে নিয়ে আসা হয় শ্রোতা হিসেবে। মিডিয়া কাভারেজও একই কায়দায় করা হয়। যে সমস্ত রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফার মূল সাংবাদিকতায় জড়িত নন তারা এসব অনুষ্ঠান কাভার করে থাকেন।

সূত্র জানায়, এসব অনুষ্ঠানে আওয়ামী সমর্থিত কিছু ব্যবসায়ীও উপস্থিত থাকেন যাতে করে প্রধানমন্ত্রী ও দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি কাড়া যায়। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতা নেয়ার পর থেকেই এরকম ১০০রও বেশি সংগঠন রাজধানী ঢাকার ভেতরে ও বাইরে সভার আয়োজন করেছে।

এদের মধ্যে ২০টি সংগঠনের সঙ্গে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন-মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, মুক্তিযোদ্ধা তরুণ লীগ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, মুক্তিযোদ্ধা লীগ এবং মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ।

যেসব সংগঠন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে সেগুলো হলো বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা, বঙ্গমাতা পরিষদ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পরিষদ এবং জননেত্রী পরিষদ।

আগাছা নাকি আবর্জনা
‘ভুঁইফোঁড়’ এসব সংগঠনের না আছে কোনো সংবিধান, না আছে কোনো কমিটি এবং না আছে স্থায়ী কোনো অফিস। কিন্তু এসব সংগঠনের মালিকরা এ সুযোগ ব্যবহার করে, মন্ত্রী এবং দলের প্রভাবশালী যেসব নেতারা সভায় যাচ্ছেন তাদের সম্পর্কের সুযোগটুকু পুরো মাত্রায় কাজে লাগাচ্ছে।

সূত্র জানায়, এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠনের মূল হোতারা তাদের প্রভাব খাটিয়ে, সরকারি বদলি, সিটি করপোরেশনের টেন্ডার, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় প্রকৌশল, খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য অফিসে সুযোগ গ্রহণ করে।

এসব বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “যখন কোনো দল ক্ষমতায় আসে তখন এসব সংগঠন আগাছা এবং আবর্জনার মতোই বেড়ে উঠে।”

তিনি বলেন, “কিছু লোক সুবিধা আদায়ের জন্য ভাসমান সংগঠন তৈরি করছে। আর কিছু লোক সংঠনের নাম ব্যবহার করে টাকা কামাই করছে। যে সমস্ত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দলে কোনো পোস্ট নেই তারা এসব সংগঠনের মাধ্যমে আলোচনায় আসতে চাইছে।”

তবে মজার বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগের যে সব বড় বড় নেতা এসব সংগঠনের সভায় যোগ দেন তাদের মধ্যে ওবায়দুল কাদেরও রয়েছেন। দু’একটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১১ সালের ১৭ জুন ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটে ‘বঙ্গবন্ধু একাডেমি’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে, একই ভেন্যুতে ৬ অক্টোবর ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী পরিষদ’ আয়োজিত সভায় এবং ৩ মে লক্ষ্মীপুরে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পরিষদ’ আয়োজিত অনুষ্ঠানেও যোগ দেন ওবায়দুল কাদের।

এ ধরনের আগাছা সংগঠনের সভায় কেন যোগ দিয়েছেন এমন এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, “আওয়ামী লীগের যেসব নেতা-কর্মী দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কিন্তু এখনো অবহেলার স্বীকার আমি শুধু তাদের অনুষ্ঠানে যাই।”

তিনি বলেন, “এ বিষয়টাতে আমি খুব বাছ-বিচার করি। যেসব সংগঠন চাঁদাবাজি করে কিংবা সব সময় সুযোগের ধান্দায় থাকে তাদের অনুষ্ঠানে কখনো যাই না।”

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণমন্ত্রী একেএম মোজাম্মেল হক বলেন, “এসব সংগঠনে অধিকাংশই ভুয়া। ভালো কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এগুলো গড়ে উঠেনি।”

এগুলো বন্ধে কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণমন্ত্রী বলেন, “কেউ এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করলে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।”

ভুঁইফোঁড় আরো ২০টি সংগঠন আছে যেগুলো আওয়ামী লীগের নাম ও প্রতীক ব্যবহার করছে। যেমন- নৌকার সমর্থক গোষ্ঠী, নৌকার নতুন প্রজন্ম, আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী সমবায় লীগ এবং মৎসজীবী লীগ।

বঙ্গবন্ধু একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক ও নৌকার সমর্থক গোষ্ঠীর সভাপতি হুমায়ুন কবির মিজি বলেন, “আওয়ামী লীগের কিছু নেতা এবং আওয়ামী সমর্থক ব্যবসায়ী তাদের অনুষ্ঠান আয়োজনের টাকা দিয়ে থাকে।”

সূত্রমতে, ২০০৯ সালের মন্ত্রিসভা গঠনের পর থেকে যেসব শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতারা মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি তারা এসব সংগঠনের সভায় যাওয়া আসা করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন- সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মোহাম্মদ নাসিম, ওবায়দুল কাদের, মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। এসব সভায় যোগ দিয়ে নেতারা সরকারের কাজের কড়া সমালোচনা করেন, যাতে করে মিডিয়ায় বাড়তি কাভারেজ সুবিধা পাওয়া যায়।

সুরঞ্জিত সেন, ওবায়দুল কাদের এবং মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে পরে মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হয়। নাসিম এবং মায়া এখন মন্ত্রিসভায় রয়েছেন।

সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্ত্রিসভায় তার পদ হারানোর পর ২০১২ সাল থেকে আবারো এসমস্ত সংগঠনের সভায় যাওয়া আসা শুরু করেছেন। একই পথে হাঁটছেন সাবেক বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদও। ২০১১ সালে যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পরই ওবায়দুল কাদের এসব সংগঠনের সভায় যাওয়া বন্ধ করে দেন এবং তাদের কাজের সমালোচনা করা শুরু করেন।

দর্শক ও মিডিয়া কভারেজ
প্রেস ক্লাবে সিগারেট বিক্রি করেন আব্দুল মালেক। তিনি বিভিন্ন সমাবেশ ও ভেন্যুতে লোক সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করেন। একজন আয়োজকের ছদ্মবেশে তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, “লোক পাঠাতে পারবো, তবে জনপ্রতি ৮০ টাকা করে পরিশোধ করতে হবে। আর তার জন্য অনুষ্ঠানের একদিন আগে নিশ্চিত করতে হবে।”

অন্যান্য লোক সরবরাহকারীরা জানান, “একদিনের কোনো অনুষ্ঠানে দর্শকরা তিন ঘণ্টার বেশি অবস্থান করে না।”

টাকার বিনিময়ে মিডিয়া কাভারেজের কাছ করে কিছু রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফার। তারা ইমেইলের মাধ্যমে প্রধান ধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোতে সভার ছবি, ভিডিও এবং নিউজ পাঠিয়ে থাকে। প্রধান ধারার সংবাদমাধ্যমগুলোও এসব সংবাদ এড়িয়ে যেতে পারে না। কারণ অনুষ্ঠানে প্রভাবশালী মন্ত্রী, শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতারা উপস্থিত থাকেন। এসব নেতা সেখানে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে থাকেন।

ভুঁইফোঁড় নিয়েও দ্বন্দ্ব
এবছরের ২১ জুন শিল্পকলা একাডেমিতে একটি সভার আয়োজন করে ‘বাংলাদেশ দেশরত্ন পরিষদ’। সভার শুরুতেই মাইক্রোফোন হাতে নেন ধানমন্ডি মহিলা আওয়ামী লীগ এর সভানেত্রী দাবিকারী রাজিয়া মোস্তফা। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তিনি বলেন, “আমি দেশরত্ন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা”। এর সপক্ষে তিনি কিছু দলিলও তোলে ধরেন। একই সময় চিত্তরঞ্জন নামের আরেকজন নিজেকে সংগঠনটির সভাপতি ও সভার আয়োজক হিসেবে দাবি করেন। সূত্র জানায়, এই সংগঠনগুলোতে এ ধরনের দ্বন্দ্ব খুবই সাধারণ ঘটনা। তবে মজার বিষয় হচ্ছে প্রতিটি সংগঠনে পেছনে সহায়তা যোগানদাতার হাত রয়েছে।

সূত্রমতে, সাবেক কৃষক লীগ নেতা এমএ করিম ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হক সবুজ এরকম ৩০ থেকে ৪০ টি সংগঠন পরিচালনা করে থাকেন।

এবিষয়ে এমএ করিম বলেন, “আমি কোনো সংগঠনের মালিক নই। কোনো সংগঠনের কোনো প্রতিষ্ঠাতা আমন্ত্রণ জানালে তাদের অনুষ্ঠানে আমি যাই।”

আব্দুল হক সবুজ বলেন, “২২ সংগঠন নিয়ে আমাদের একটি জোট আছে। আমার একটিই সংগঠন রয়েছে, যার নাম-বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিষদ।”

সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার কেন রেজিস্ট্রেশন করতে হবে?”

সূত্র: ডেইলি স্টার।



মন্তব্য চালু নেই