অমিতাভের জন্মদিনে সুপারহিরোর গল্প
‘দ্য স্টার ইভেন্ট ইউ হ্যাভ বিন ওয়েটিং ফর’— মনে হতে পারে কোনো সিনেমা বা তারকাখচিত অনুষ্ঠানের স্লোগান। না, এটি আসলে কমিকস বুকের বিজ্ঞাপন। আর কমিকসটির হিরো হলেন অমিতাভ। আসুন বলিউডের এ জীবন্ত কিংবদন্তির ৭৩তম জন্মদিনে জেনে নিই আলোচিত কমিকসটির কথা।
১৯৮০ এর দশকে ক্যারিয়ারের শীর্ষে অবস্থান করছিলেন অমিতাভ বচ্চন। সে সময় তার নামে সুপারহিরো কমিকস সিরিজটি প্রকাশ করে ইন্ডিয়া বুক হাউস (আইবিএইচ)। সিরিজের নাম ‘এ্যাডভেঞ্চার অব অমিতাভ বচ্চন’। অমিতাভের চরিত্রটির নাম সুপ্রিমো। আর আইবিএইচ প্রকাশ করত জনপ্রিয় স্টার কমিকসের ব্যানারে, যার অন্যান্য প্রকাশনার মধ্যে ছিল লরেল এ্যান্ড হার্ডি, সুপারম্যান ও জেমস বন্ড ০০৭।
একটি ঘটনা থেকে আইবিএইচের প্রকাশক পমি বকশী কমিকসটির আইডিয়া পান। একদিন তিনি নিজের ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। দেখেন পাশের একটি ছাদে কয়েকটি বাচ্চা খেলছে। তারা পরস্পরের মধ্যে সুপারহিরো নিয়ে কথা বলছিল। একজন বলল, সে সুপারম্যান— উড়তে পারে। আরেকজন জানায়, সে ব্যাটম্যান— দালান বেয়ে উঠতে পারে। তৃতীয় বালকটি বলল, সে হল অমিতাভ বচ্চন। এক হাতেই দশজনকে মারতে পারে।
এ ঘটনার কিছুদিন পর। তখন ১৯৮৩ সাল। বকশী গোয়ায় ‘পুকার’ সিনেমার সেটে অমিতাভের সঙ্গে দেখা করে তার নামে কমিকস প্রকাশের অনুমতি চান। তিনিও রাজি। অমিতাভকে ওই সিনেমার সহশিল্পী রণধীর কাপুর ডাকতেন ‘সুপ্রিমো’। এ ডাক শুনে তো বকশী তো মুগ্ধ! সুপারহিরোর নামও পাওয়া গেল।
এরপর বকশী দ্বারস্থ হলেন নামি লেখক ও পরিচালক গুলজারের, যিনি আবার তার বন্ধু। গুলজার সিরিজটির চিত্রনাট্য পরামর্শক হলেন। কিন্তু সমস্যা হল যিনি ইলাস্ট্রেশন করবেন সেই প্রতাপ মল্লিককে নিয়ে। তিনি তখন ‘অমর চিত্রকথা’ কমিকস এঁকে বেশ বিখ্যাত। জনপ্রিয় সিনেমা নিয়ে তার কোনো আগ্রহই ছিল না। এমনকি অমিতাভের কোনো সিনেমাও দেখেননি। বকশীর চাপাচাপিতে তিনি অমিতাভের কিছু সিনেমা দেখলেন। এর পর সুপ্রিমোর জন্য ৮-১০টি কসটিউম ডিজাইন করলেন। সেখান থেকে পিঙ্ক কালারের আটোসাটো আউটফিট মনে ধরল অমিতাভের। আর গলার থাকল লকেটওয়ালা চেইন, পিস্তলসহ কোমর বন্ধনী ও হাটু পর্যন্ত জুতো। ডিসি বা মার্ভেলের কমিকসের মতো তবে এ সুপারহিরোর শক্তিমত্তার বিশেষায়িত কোনো দিক ছিল না। ছিল শক্তি ও বুদ্ধিমত্তার সুষম সম্বন্বয়।
সুপ্রিমো মূলত এ্যাডভেঞ্চারধর্মী গতানুগতিক কমিকসের মতোই ছিল। ‘দ্য লস্ট আইডল’ নামের টাইটেলে তাকে দেখা যায় ১৬৬০ সালে লুট হওয়া একটি মূর্তি উদ্ধার করতে। যেটি আবার ছিল সাগরে ডুবে যাওয়া জাহাজে।
ওই সময় ফ্যান্টম কমিকস ভারতে বেশ জনপ্রিয় ছিল। অন্যান্য কমিকসের মতো সুপ্রিমোও তার প্রভাব থেকে বের হতে পারেনি। যেমন তাকে দেখা যায় চোখ ঢেকে দেওয়া বড় সানগ্লাস পড়তে, অনেকটা মুখোশধারী মানুষের মতো। যে কি-না ছায়ায় ছায়ায় হাঁটত। তার ছিল নিজস্ব দ্বীপ। যেখানে মিলেমিশে থাকত নানান ধরনের জীব।
এই কমিকসে বচ্চনের সিনেমার বিভিন্ন চরিত্রও উঠে এসেছে। যেমন ‘অগ্নিপথ’র বিজয় ও ‘অমর আকবর এন্টনি’র এন্টনি। দুটোই হিন্দি সিনেমায় আইকনিক চরিত্র। সিনেমায় চরিত্রগুলোতে অমিতাভ অভিনয় করলেও কমিকসে ছিল সুপ্রিমোকে সাহায্যকারী দুই ভাই। আরও দেখা যায় ‘কুলি’ সিনেমার ঈগল আল্লাহরাখাকে। তবে এখানে তার নাম শাহিন। তার কাজ হল সুপ্রিমোর জন্য নতুন নতুন এ্যাসাইনমেন্টের খবর নিয়ে আসা।
প্রথমদিকের কমিকসগুলো গুলজার লিখলেও পরে যোগ দেন অভিনেত্রী সুধা চোপড়া। গুলজারের প্লট ধরে তিনি বিভিন্ন পর্ব লিখেন। এ ছাড়া কিছু আইডিয়া এসেছেন পাঠকের তরফে। প্রথমদিকে প্রতিটি স্ক্রিপ্ট অমিতাভকে পাঠানো হতো। কিন্তু তিনি কখনো টেক্সট বা ছবিতে নাক গলাতেন না। তার আবদার ছিল একটা— কমিকসটি হাসপাতাল, এতিমখানা ও কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে হবে।
একটি পর্বে সুপ্রিমোকে দেখা যায় একদল শিশুকে উদ্ধার করতে। তারা সবাই ছিনতাই হওয়া প্লেনে বন্দী ছিল। পৃথিবীকে রক্ষা করা হয় ভিনগ্রহীদের হাত থেকে। এ সিরিজের সুপ্রিমো কিংবদন্তির শহর আটলান্টিকের রহস্য ভেদ করে। অর্থ্যাৎ, অমিতাভকে সুপারহিরো বানানো ছাড়া সুপ্রিমো নিজস্ব কোনো ধরণ বা মিশন নিয়ে আবির্ভূত হয়নি।
সিরিজটি দুই বছর ধরে প্রকাশ হয়। এর পর বকশী বিয়ে করে ভারত ছাড়লে বন্ধ হয়ে যায়। এ সিরিজ অবলম্বনে পরবর্তীতে ভারতে আরও কিছু কমিকস চালু হয়। এর মধ্যে তামিলনাডুতে প্রকাশিত ‘রজনীকান্ত’ ও কেরালায় ‘মম্মথি’ উল্লেখযোগ্য। ক্রিকেট সুনীল গাভাস্কারকেও দেখা যায় ক্রিকেট ছেড়ে ক্রাইম ফাইটার হিসেবে লড়তে। কিন্তু তিন সংখ্যার পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ একটাই, লিটল মাস্টার কি পারেন বিগ বি’র সমান হতে! এর অনেক বছর পর ভারতবাসী বড়পর্দায় প্রথম সুপারহিরোকে পায়। যার নাম ‘কৃষ’।
এক নজরে অমিতাভ : ১৯৪২ সালের ১১ অক্টোবর উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে অমিতাভ বচ্চনের জন্ম। তার বাবা হরিবংশ রাই বচ্চন একজন নামকরা হিন্দি কবি ছিলেন। মায়ের নাম তেজি বচ্চন। অমিতাভ এলাহাবাদের জ্ঞান প্রোবোধিনি, বয়েজ হাই স্কুল ও নৈনিতালের শেরউড কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত কিরোরিমল কলেজ থেকে স্নাতক হন। অভিনেতা হওয়ার উদ্দেশ্যে ২০ বছর বয়সে কলকাতার ব্ল্যাকার এ্যান্ড কোং নামে জাহাজ কোম্পানির ফ্রেট ব্রোকারের কাজে ইস্তফা দেন।
অমিতাভ বচ্চন ১৯৬৯ সালে ছবির জগতে আত্মপ্রকাশ করেন ‘সাত হিন্দুস্তানি’ নামক একটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। যেখানে সাতটি প্রধান চরিত্রের একটিতে অভিনয় করেছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘আনন্দ’, ‘পরওয়ানা’, ‘বম্বে টু গোয়া’, ‘জাঞ্জির’, ‘অভিমান’, ‘নেমক-হারাম’, ‘কুঁওয়ারা বাপ’, ‘দোস্ত’, ‘অগ্নিপথ’, ‘মজবুর’, ‘চুপকে চুপকে’, ‘দিওয়ার’, ‘শোলে’, ‘কাভি কাভি’, ‘অমর আকবর এন্টনি’, ‘মরদ’, ‘গঙ্গা যমুনা স্বরস্বতী’, ‘ত্রিশূল’, ‘মুকদ্দার কা সিকান্দর’, ‘মিস্টার নটবরলাল’, ‘কালা পাত্থার’, ‘দোস্তানা’, ‘সিলসিলা’, ‘রাম বলরাম’, ‘শান’, ‘লাওয়ারিশ’, ‘চিনি কম’, ‘কাভি আল বিদা না কেহনা’, ‘বাবুল’, ‘সরকার রাজ’, ‘দ্যা লাস্ট লেয়ার’, ‘দিল্লি সিক্স’, ‘কাভি খুশি কাভি গাম’, ‘ব্ল্যক’, ‘পা’, ‘চিনি কম’, ‘ভূতনাথ রিটার্নস’ ও ‘পিকু’। মুক্তির অপেক্ষায় আছে ‘ওয়াজির’। এ ছাড়া বেশ কিছু সফল টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক তিনি।
জাতীয় পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার এ্যাওয়ার্ডসহ চলচ্চিত্র বিষয়ক ভারতের বড় বড় সব পুরস্কার তার দখলে আছে। এক ফিল্মফেয়ারেই পেয়েছেন ৩৯ মনোনয়ন। জিতেছেন ১২ বার। পেয়েছেন ভারত সরকারের দেওয়া সম্মাননা পদ্ম শ্রী, পদ্ম ভূষণ ও পদ্ম বিভূষণ।
স্ক্রল অবলম্বনে।
মন্তব্য চালু নেই