অন্ধ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে মৃত মেয়েকে ভেলায় ভাসিয়ে দিলেন মা

সাপের কামড়ে শিশুর মৃত্যু৷ পুনর্জন্ম লাভের আশায় কলার ভেলায় শিশুসন্তানকে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া৷ আবার কখনও সাপের কামড় খাওয়া সন্তানকে চিকিৎসকের কাছে না নিয়ে গিয়ে ওঝার ঝাড়ফুঁক৷ বেদের মেয়ে জোৎস্না বা রূপবান, একাধিক বাংলা সিনেমায় দেখানো এই দৃশ্যের কথা মনে পড়তে পারে বারবার৷

এখনও চলে আসছে এক রীতি৷ সচেতনতাকে উপেক্ষা করেই এই কুসংস্কার আগলে বসে রয়েছেন এক শ্রেণির মানুষ৷ যা আবার মনে করাল পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জের মধ্যমপুর গ্রাম৷ সাপে কাটার পর প্রতিবেশীদের ‘পরামর্শেই’ নিজের সন্তানকে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দিলেন এক মা! বুধবার সন্ধ্যার এই ঘটনায় তাজ্জব স্থানীয় প্রশাসনও৷ কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই কলার ভেলায় পুনর্জন্ম লাভের আশায় পাড়ি দিয়েছে ছোট্ট শিশুটির নিথর দেহ৷

স্থানীয় সূত্রে খবর, বুধবার সন্ধ্যায় ঘরের মধ্যে বিছানায় ঘুমোচ্ছিল সাড়ে চার বছরের বর্ষা বেরা৷ বিছানার মধ্যেই বিষধর সাপ কামড়ায় তাকে৷ বিষক্রিয়ায় ঘুম ভেঙে যায় ছোট্টা বর্ষার৷ কান্নাকাটি জুড়ে দেয় সে৷ মা রিঙ্কু বেরা সন্তানের পায়ে ক্ষত দেখেই বুঝতে পারেন সাপে কামড়েছে মেয়েকে৷ স্বামী বিজিত বেরা বাড়ি না থাকায় রিঙ্কুদেবীও কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন৷ পরামর্শ চান প্রতিবেশীদের৷ তারাই ওই গৃহবধূকে স্থানীয় ওঝা ঝরি মাইতির কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন৷ প্রায় দু’ঘণ্টা চলে এই মধ্যযুগীয় ঝাড়ফুঁক৷ ওঝার আশ্বাস পান রিঙ্কুদেবী৷

ওঝা জানায়, বিষ বেরিয়ে গিয়েছে৷ আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠবে শিশুটি৷ ওঝার কথামতোই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন রিঙ্কুদেবী৷ কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই বিষক্রিয়া প্রবল হওয়ায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে শিশুটি৷ এর পরই হুঁশ ফেরে রিঙ্কুদেবীর৷ রাত এগারোটা নাগাদ তড়িঘড়ি মেয়েকে নিয়ে যান হিঙ্গলগঞ্জের সান্ডেলের বিল হাসপাতালে৷

কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে৷ পরিস্থিতি হাতের বাইরে বুঝেই বসিরহাট জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন সান্ডেল বিল হাসপাতালের চিকিৎসক৷ সেই মতো বর্ষাকে নিয়েও আসা হয় বসিরহাট হাসপাতালে৷ কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ৷ চিকিৎসক জানিয়ে দেন আর বেঁচে নেই শিশুটি৷ এর পরও অবশ্য আশা ছাড়েনি ওই পরিবার৷ বসিরহাট হাসপাতালে চিকিৎসক জবাব দেওয়ার পরও ওই মৃত শিশুকে নিয়ে যাওয়া হয় হিঙ্গলগঞ্জের লেবুখালিতে৷ সেখানে আরও বড় এক ওঝার দ্বারস্থ হয় পরিবার৷ সেখানেই রাতভর চলে ঝাড়ফুঁক৷ শেষে কাজ না হওয়ায় বাধ্য হয়েই মৃত শিশুটিকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন পরিবারের লোকেরা৷

রিঙ্কুদেবীর স্বামী বিজিত বেরা কলকাতায় কুমোরটুলিতে কাজ করেন৷ তিনি বাড়িতে ফিরতে না পারায় বৃহস্পতিবার সকালে মেয়ের সৎকার নিয়ে সমস্যায় পড়ে পরিবার৷ গ্রামবাসীদেরই কেউ কেউ পরামর্শ দেন নদীতে কলার ভেলায় মেয়ের মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য৷ ভাল ওঝার হাতে পড়লে হয়তো মেয়ে ফের প্রাণ ফিরে পেতে পারে এই আশাও দেখতে থাকেন রিঙ্কুদেবী৷ এই অন্ধ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে রাজি হয়ে যান তিনি৷ এরপর গৌরেশ্বর নদীতে কলার ভেলায় পরিপাটি বিছানা করে, মশারি টাঙিয়ে, ধূপ জ্বালিয়ে শিশুটিকে তাতে শুইয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয়৷ এই বিষয়ে হিঙ্গলগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য সুশান্ত ঘোষ বলেন, “আমরা এই ঘটনার কিছুই জানি না৷ প্রথম অবস্থায় যদি শিশুটিকে ঝাড়ফুঁক না করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হত তাহলে হয়তো বেচে যেত শিশুটি৷ কুসংস্কারের বশে এই ধরনের ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক৷”



মন্তব্য চালু নেই