‘অকার্যকর’ ২০ দলীয় জোট

সরকারবিরোধী আন্দোলনে ‘অকার্যকর’ হয়ে পড়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। তিন মাসের টানা অবরোধসহ অতীতের কর্মসূচিতে রাজপথের আন্দোলনে জোটের ব্যানারে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেনি বিএনপিসহ শরিক দলগুলো। জোটের বড় দুই শরিক বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে যখন টানাপড়েন ও দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে, তখন আন্দোলন সফল না হওয়ায় ২০ দলের মধ্যে থাকা অন্য দলগুলোতেও এক ধরনের হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।

গত ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে ঘোষিত সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচির ৯২ দিন গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান শেষে আদালতে হাজিরা দিয়ে জামিন নিয়ে ঘরে ফিরেছেন (গত ৫ এপ্রিল) বেগম খালেদা জিয়া। আনুষ্ঠানিকভাবে অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার না করলেও তা এখন অকার্যকর বলে তিনি নিজেই একাধিকবার বলেছেন। এরই মধ্যে গত ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি।

এ নির্বাচনে ঢাকার বেশকিছু ওয়ার্ডের দলীয় নেতাকে কমিশনার প্রার্থী হিসেবে চেয়েও বিএনপির সাড়া না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয় জামায়াত। এ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে টানাপড়েন বাড়তে থাকে। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী ইস্যুতে বিএনপিকে কাছে না পাওয়াসহ নানা কারণে বিএনপির ওপর ক্ষুব্ধ জামায়াত।

অন্যদিকে অতীতে যে কোনো আন্দোলনে রাজপথে জামায়াত-শিবিরের বিশেষ ভূমিকা থাকলেও টানা অবরোধ কর্মসূচিতে সেভাবে দলটির নেতাকর্মীরা সক্রিয় না থাকায় ক্ষুব্ধ বিএনপি। সব মিলিয়ে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ ক্রমেই গাঢ় হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

জোটের একাধিক শরিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতদিন ধরে খালেদা জিয়া একাই সবকিছু (কর্মসূচিসহ অন্যান্য কার্যক্রম) করছেন। যদিও তাকে এই ক্ষমতা জোটগতভাবে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে নিশ্চয়ই ভাল হতো।

সূত্র জানায়, জোটের দ্বিতীয় শরিক জামায়াতের ওপর যেমন বিএনপি ক্ষুব্ধ তেমনি শরিক অন্য দলগুলোর ওপরও অসন্তুষ্ট। বিএনপির কোনো কোনো নেতা মনে করেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে জোটের কোনো শরিকেরই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই।

সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করতে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট গঠিত হয়। এ জোটে সাবেক চারদলভুক্ত জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ছাড়াও কর্নেল অলির এলডিপি, মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাকের খেলাফত মজলিশ, শফিউল আলম প্রধানের জাগপা, শেখ শওকত হোসেন নিলুর এনপিপি, সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিমের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, জেবেল রহমান গানির বাংলাদেশ ন্যাপ, এইচ এম কামরুজ্জামানের বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, হেফাজতভুক্ত দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, এনডিপি, লেবার পার্টি, ন্যাপ ভাসানী, ইসলামিক পার্টি, পিপলস লীগ ও ডেমোক্রেটিক লীগ জোটভুক্ত হয়।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে বেশকিছু নেতাকর্মী বেরিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বাধীন জাপা (জাফর) এবং আরও কিছুদিন পরে সাঈদ আহমদের নেতৃত্বে সাম্যবাদী দল বিএনপি জোটে যোগ দিলে তা ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়।

২০ দলের মধ্যে প্রথম ১২টি দলের (জামায়াতের নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে) নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন রয়েছে। বাকি ৬টি দলের নিবন্ধন নেই। এর মধ্যে শেখ শওকত হোসেন নিলুকে ২০ দল থেকে বের করে দিলে দলটির তৎকালীন মহাসচিব ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদের অংশটি (ফরহাদ চেয়ারম্যান) জোটে থেকে যায়। মাঠে এ দলটির অবস্থান নেই বললেই চলে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ন্যাপ ভাসানীর শেখ আনোয়ারুল ইসলাম ২০ দল থেকে বের হয়ে গেলে কল্যাণ পার্টির তৎকালীন গাইবান্ধা জেলা সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট আযহারুল ইসলামকে ওই দলের কথিত চেয়ারম্যান করে ২০ দলে রাখা হয়। এ ছাড়া এনডিপির মহাসচিব আলমগীর মজুমদার এবং ইসলামিক পার্টির মহাসচিব আব্দুর রশিদও আলাদা পার্টি (নিজ নামে) করে ২০ দল ছাড়লে খন্দকার গোলাম মর্তুজার নেতৃত্বে এনডিপির একটি অংশ ও এ্যাডভোকেট আব্দুল মোবিনের নেতৃত্বে ইসলামিক পার্টির একটি অংশ জোটে রয়ে যায়। সম্প্রতি আব্দুল মোবিন মারা গেলে ২০ দলভুক্ত ইসলামিক পার্টি এখন নেতৃত্বশূন্য। এ ছাড়া ২০ দলভুক্ত এ সব দলের রাজনৈতিক মাঠে তেমন কোনো ভূমিকা নেই। নামসর্বস্ব দল হিসেবেই মূলত পরিচিত। একই অবস্থা ডা. মুস্তাফিজুর রহমান ইরানের লেবার পার্টিরও।

ডেমোক্রেটিক লিগের (ডিএল) সভাপতি ভাষাসৈনিক অলি আহাদ মারা যাওয়ার পর ৯০-এর ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন আহমেদ মনিই দলটির একমাত্র নেতা (সাধারণ সম্পাদক)। সাঈদ আহমদের সাম্যবাদী দল ও এ্যাডভোকেট গরিবে নেওয়াজের পিপলস লীগ নামসর্বস্ব দল হিসেবেই পরিচিত। সাঈদ আহমদ এক সময় সাম্যবাদী দলের নারায়ণগঞ্জ জেলা সাধারণ সম্পাদক থাকলেও জাতীয় রাজনীতি করেননি কখনো।

অন্যদিকে জোটের শরিক বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি দলগত অবস্থানের চেয়ে দলটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কাছে স্নেহভাজন হলেও টানা তিন মাসের অবরোধসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনে তার কোনো দেখা নেই। দীর্ঘদিন ধরে তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। মহাসচিব শামীম আল মামুন মারা যাওয়ার পর দলটিতে ব্যারিস্টার পার্থ’র অবর্তমানে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই।

অন্যদিকে কর্নেল অলি আহমদের এলডিপি চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ও জেবেল রহমান গাণির নিজ এলাকা রংপুরকেন্দ্রিক অবস্থান থাকলেও ঢাকা বা দেশের অন্য এলাকায় তেমন কোনো অবস্থান নেই। বিগত দিনের আন্দোলনে ঢাকার রাজপথে দুটি দলের নেতাকর্মীকে দেখা যায়নি। শুধু বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ ছিলেন দল দুটির নেতারা। একই অবস্থা সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টির। সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমকে বিভিন্ন টকশোতে দেখা গেলেও রাজপথের কর্মসূচিতে দেখা যায়নি।

২০ দলের শরিক জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান বলেন, দীর্ঘদিন টানা আন্দোলনের পর হঠাৎ নীরবতায় মনে হতে পারে আমরা স্থবির হয়ে পড়লাম কিনা, কিংবা নিজেদের মধ্যে কোনো সমস্যা হল কিনা। জোটের মধ্যে অভিমান, ক্ষোভ বা ভিন্নমত থাকতে পারে। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে বাধ্য করছে বা করবে। বর্তমানে হয়তো সবাই একটু ঝিমিয়ে পড়েছেন বা নিষ্ক্রিয়তা দেখা দিয়েছে। কিন্তু জোট অকার্যকর তা বলা যাবে না।

তবে এ ব্যাপারে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরপ্রতীক শুধু বলেছেন, ‘যা বলার জোটের বৈঠকেই বলব।’

৫ জানুয়ারির পর কিছু দিন কাজী জাফর আহমদ (জাপা-জাফর) বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বেশকিছু বৈঠকে মিলিত হলেও পরবর্তীতে অসুস্থ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নিষ্ক্রিয় অবস্থান দেখা যায়। বিগত অবরোধসহ কোনো কর্মসূচিতে জাপার অবস্থান চোখে পড়েনি।

এদিকে হেফাজতভুক্ত দল ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিশ ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনার পর থেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এর মধ্যে মুহাম্মদ ইসহাকের খেলাফত মজলিশকে কিছুটা সক্রিয় থাকতে দেখা গেলেও অন্য দুটি দল দীর্ঘদিন ধরেই নিষ্ক্রিয়। অবরোধসহ জোটের বিভিন্ন কর্মসূচিতে ইসলামী ঐক্যজোট ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতাকর্মীদের ভূমিকা চোখে পড়েনি।

এ ব্যাপারে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ নেজামীকে বুধবার বার বার ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি। খেলাফত মজলিশের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, সরকার বিরোধী দলের ওপর দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ আমাদের কর্মীদের রাস্তায় দাঁড়াতে দেয় না। তারা দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

তিনি বলেন, জোটের মধ্যে কিছু সমস্যা যে নেই তা বলব না। কিন্তু তাই বলে যে জোট অকার্যকর তা বলা যাবে না। হ্যাঁ, অনেক দিন ধরে জোটের বৈঠক হয় না, এটা হওয়া দরকার।

তিন মাসের টানা অবরোধে জোটের আরেক শরিক জাগপা মাঝেমধ্যে ঝটিকা মিছিল করে গণমাধ্যমকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠালেও দলটির সভাপতি এ সময় আত্মগোপনে ছিলেন।

এ ব্যাপারে শফিউল আলম প্রধান বলেন, অন্য দল কী করেছে তা বলব না। জাগপার প্রশ্ন এলে বলব শহীদের (নিহত) তালিকায় আমাদের নেতা রয়েছে। গ্রেফতারের প্রশ্ন এলেও আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে। অনেকেই আজ কারাগারে। যথাসাধ্য শক্তি দিয়ে আমরা মাঠে থেকেছি এবং আছি।

এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, জোটের ভেতরে কিছু সমস্যা থাকতে পারে। তাই বলে ২০ দল অকার্যকর তা ঠিক নয়।

দীর্ঘদিন ধরে জোটের বৈঠক হয় না, এ বৈঠক হওয়া দরকার কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বৈঠক অচিরেই হবে। তবে আমি মনে করি আমাদের আগে প্রয়োজন বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করা। দলকে পুনর্গঠন করা। আমরা তাই-ই করছি।

জোটের সমমনা একটি দলের প্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কর্মসূচি গ্রহণে অধিকাংশ সময়ই আমাদের (শরিক দল) কোনো পরামর্শ নেওয়া হয় না। নানা কারণে জোটের মধ্যে অস্বস্তি থাকলেও আমরা যাব কই। শেখ শওকত হোসেন নিলু ২০ দল ছেড়ে আলাদা প্ল্যাটফর্ম করেছেন। কিন্তু তার কি অস্তিত্ব আছে?

তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত ২০ দলের প্রধান দুই দল। তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিএনপির মধ্যে একটি অংশ আগে থেকেই আছে যারা জামায়াতকে জোটে রাখার বিরোধী। অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলোও জামায়াত ছাড়তে চাপ দিচ্ছে। সব মিলিয়ে জামায়াত ছাড়তে ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) ওপর চাপ রয়েছে।

এদিকে মানবতাবিরোধী ইস্যুতে বিএনপির নীরবতা এবং সর্বশেষ ঢাকা সিটি নির্বাচনে কমিশনার পদে জামায়াতকে ছাড় না দেওয়ায় দলটির একটি অংশ বিএনপি জোটের সঙ্গে না থাকতে চাপ দিচ্ছে বলে জানি। তবে জোটে কিছুটা অস্বস্তি ও দূরত্ব তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত জোট অটুট থাকবে বলে মনে করেন এই নেতা। দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই