ট্রাম্পের পূর্বপুরুষেরাও তো অভিবাসী ছিলেন!

সময়টা ১৮২০ সাল, প্রায় ২০০ বছর আগের কথা। ইউরোপের অবস্থা তখন ততটা ভালো নয়। বছরের পর বছর খাদ্যশস্যের কম উৎপাদন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব আর রাজনৈতিক অস্থিরতা—সব মিলিয়ে ইউরোপের সঙিন অবস্থা। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় আর নানা ইউরোপীয় দেশের মতো সে বছরই জার্মানি থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকা চলে যান দেড় লাখ জার্মান। তবে ১৮৪৮ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মান অভিবাসীদের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে।

তখন উত্তর জার্মানির তিন বন্দর ব্রেমেন, ব্রিমেনহাফেন আর হামবুর্গ সমুদ্রবন্দর থেকে ভাগ্যান্বেষণে আমেরিকা যেতে ইচ্ছুক জার্মান আর মধ্য ইউরোপের দেশগুলোর মানুষদের নিয়ে জাহাজগুলো ৪৫ দিনে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে নিউইয়র্ক, বাল্টিমোর, নিউ অর্লিয়েন্স, ফিলাডেলফিয়া বা কার্লেসটন বন্দরে পৌঁছে যেত। জার্মান অভিবাসীরা নতুন মহাদেশে তাঁদের বসতি শুরু করেছিলেন নিউইয়র্ক, পেনসিলভানিয়া আর মেরিল্যান্ড স্টেটসে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকায় জার্মান ত্রিভুজ বলে পরিচিত উইলকিনসন্স, মিসৌরি ও ওহাইও অঞ্চলে। জার্মান অভিবাসীদের কারিগরি অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতার কারণে অচিরেই তাঁরা আমেরিকায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং তাঁদের চাহিদা ক্রমশই বাড়তে থাকে।

সেই সময় আটলান্টিকের অপর পারে দেশান্তরিত স্বদেশিদের অবস্থা অভিহিত হয়ে জার্মানি ও অন্য ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে আমেরিকায় ভাগ্য গড়তে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও বাড়তেই থাকে। অভিবাসীবিরোধী ও কট্টর পন্থা অবলম্বনে মরিয়া আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পূর্বপুরুষদের অভিবাসন ইতিহাসের শুরুটা ১৮৮৫ সালে। তাঁর দাদা ফ্রিডরিশ ট্রাম্প মাত্র ১৬ বছর বয়সেই দক্ষিণ জার্মানির রাইনল্যান্ড ফালৎস রাজ্যের ছোট শহর মানহাইমের অনতিদূরে আঙুরখেত পরিবেষ্টিত গ্রাম কার্লসস্টাড থেকে এক রাতে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যান।

অচিরেই গ্রামে খবর রটে যায় ফ্রিডরিশ আমেরিকামুখী হয়েছেন আর নিউইয়র্কে গিয়ে নাপিতের কাজ জুটিয়েছেন। সদ্য নিউইয়র্কে আসা এই অভিবাসী কিছুদিন পরই চলে যান আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে আর সেখানে দায়িত্ব নেন এক হোটেল পরিচালকের। এরপর আলাস্কা আর কানাডার সীমান্তে ইউকুনের দুর্গম সোনার খনি অঞ্চলে খনিতে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য নিজেই হোটেল খুলে বসেন।

ফ্রিডরিশ তাঁর ব্যবসার লাভের টাকা দিয়ে খুব কম মূল্যে নিউইয়র্কের ম্যানহাটন এলাকায় সম্পত্তি কিনতে থাকেন। আজকে নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের গা ঘেঁষে যে সুউচ্চ ট্রাম্প টাওয়ার, সেটি মূলত তাঁর অভিবাসী দাদার আমলের ক্রয় করা সম্পত্তি। বেশ কয়েক বছর পর ফ্রিডরিশ ট্রাম্প আবার জার্মানির সেই ছোট গ্রাম কার্লসস্টাড ফিরে আসেন আর বিয়ে করেন প্রতিবেশী এলিজাবেথকে। ফ্রিডরিশ বিয়েশাদি করে থাকতে চেয়েছিলেন নিজের গ্রামেই; কিন্তু বাদ সাধে সেই সময়ের ব্যাভারিয়া রাজ্যের অভিবাসী-সংক্রান্ত আইন। ব্যাভারিয়া রাজ্যের সেই সময়কার আইন অনুযায়ী স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে দেশত্যাগ করার কারণে এবং দীর্ঘ সময় রাজ্যের বাইরে থাকায় ফ্রিডরিশ ট্রাম্পের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়।

এরপর ফ্রিডরিশ ট্রাম্প ব্যাভারিয়া রাজ্যের প্রিন্স রিজেন্ট লিওপল্ডকে আবারও নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন। সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয় এবং অবিলম্বে তাঁকে ব্যাভারিয়া রাজ্য ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

১৯০৫ সালের ১ জুলাই ফ্রিডরিশ ট্রাম্প ও তাঁর স্ত্রী এলিজাবেথ হামবুর্গ বন্দর থেকে বাষ্পচালিত পেনসিলভানিয়া নামের জাহাজে করে আমেরিকা ফিরে যান। নিউইয়র্কে ফিরে যাওয়ার তিন মাস পরই জন্ম হয় ফ্রিডরিক খ্রিস্ট ট্রাম্পের, সংক্ষেপে ফ্রেড ট্রাম্প। আর এই ফ্রেড ট্রাম্পের চতুর্থ সন্তান হলেন আজকের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কয়েক বছর পর ১৯১৮ সালে ফ্রিডরিশের মৃত্যু হলে, স্ত্রী এলিজাবেথ তাঁদের সন্তানদের মানুষ করার তাগিদেই ট্রাম্প অ্যান্ড সন্স নামের কোম্পানি খুলে বসেন। এই কোম্পানিই পরবর্তীকালে রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।

জার্মানির রাইনল্যান্ড ফালৎস প্রদেশে অবস্থিত ফালৎসের ইতিহাস ও লোকাচারবিদ্যা কেন্দ্রের পরিচালক ঐতিহাসিক রোলান্ড পাউল সম্প্রতি তাঁর গবেষণায় জানিয়েছেন, ট্রাম্পের দাদা ফ্রিডরিশ ট্রাম্প ছিলেন একজন অবৈধ অভিবাসী। এর কারণ হিসেবে তিনি ব্যাভারিয়া রাজ্যের সেই সময়কার তিনটি আইনের কথা বলেছেন। প্রথমত, অপ্রাপ্ত বয়স ও অভিভাবকহীন যাত্রা। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি ও তৃতীয়ত, বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ না নেওয়া।

উল্লেখ্য, সেই সময় আমেরিকা যাত্রায় ইউরোপিয়ানদের ভিসাপ্রথা না থাকলেও, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমতিপত্র ছাড়া মাত্র ১৬ বছর বয়সে অভিভাবকহীন অবস্থায় একজন অপ্রাপ্ত বয়সের বালকের আমেরিকা গমন বা যেকোনো পুরুষের ১৮ বছর হওয়ার পর ন্যূনতম ২ বছর সামরিক প্রশিক্ষণের যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা ফ্রিডরিশ অমান্য করেছিলেন। সেই আমলে এই সব আইন অমান্য করার
কারণে তাঁর আমেরিকা অভিবাসনকে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যাভারিয়া রাজ্য ফ্রিডরিশ ট্রাম্পের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল। ঐতিহাসিক রোলান্ড পাউল এ-সংক্রান্ত দলিল ও ১৯০৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে লিখিত একটি চিঠি স্পেয়ার শহরে অবস্থিত রাইনল্যান্ড ফালৎস প্রদেশের মহাফেজখানায় খুঁজে পেয়েছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাদার গ্রাম কার্লসস্টাড থেকে সম্প্রতি তাঁর দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় চলচ্চিত্রনির্মাতা সিমনে ভান্ডেল কার্লসস্টাডের বিখ্যাত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিতে নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন। তবে হতাশ করা ঘটনা, রাইনল্যান্ড ফালৎস রাজ্য বা কার্লসস্টাড সম্বন্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্পের তেমন ধারণাই নেই বা তা সুকৌশলে চেপে গিয়ে থাকতে পারেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যখন পৃথিবীব্যাপী জার্মানদের প্রতি ঘৃণাবোধ জন্মেছিল, তখন তাঁদের পরিবার, তাঁদের পূর্বপুরুষেরা সুইডেন থেকে আসা বলে প্রচার করতেন। তবে সিমনের ক্যামেরার সামনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘আই লাভ কার্লসস্টাড’ কথাটি বলেছেন।

৮ নভেম্বর ২০১৬ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ও পরে জার্মানির ও আমেরিকার বিভিন্ন টেলিভিশন ও পত্রিকা ছোট গ্রাম কার্লসস্টাড গিয়ে ফ্রিডরিশ ট্রাম্প ও তাঁর স্ত্রী এলিজাবেথ ট্রাম্পের আদি বাড়ি এবং কবরস্থানে ট্রাম্প পরিবারের নামসংবলিত সমাধিফলকের ছবি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। অধিকাংশ সাক্ষাৎদাতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করেছেন এবং তাঁরা তাঁদের গ্রামের পৌত্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়াকে গৌরবের অংশ বলে স্বীকার করেননি; বরং তাঁরা লজ্জিত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
ইতিহাসের পাঠ বা অতীত ইতিহাসকে হেলাফেলা করার মধ্যে কোনো যৌক্তিকতা নেই, নেই কোনো গৌরববোধ। পরিতাপের বিষয়, যাঁর দাদা মাত্র শত বছরের কিছু বেশি সময় আগে আমেরিকায় অবৈধ অভিবাসন করে নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছিলেন, আজ তাঁর নাতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ধর্ম, বর্ণ, অভিবাসী আর শরণার্থীবিরোধী একের পর এক আইন করতে চাচ্ছেন এবং তাঁদের প্রতি ঘৃণা ছড়াচ্ছেন। তবে ইতিহাস বড় নির্মম, এই সত্যটি জার্মানি থেকে যাওয়া একজন অবৈধ অভিবাসীর পৌত্র ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও জানতে হবে।

লেখক : সরাফ আহমেদ, প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি৷



মন্তব্য চালু নেই