মিঠাপুকুরে আমানত হারিয়ে পথে বসেছে হাজারও মানুষ

ছোট্ট একটি চায়ের দোকানে সকাল-সন্ধ্যা কাজ করেন। অবসর সময়ে ইট ভাঙা শ্রমিক হিসেবে শ্রম দেন। বাস করেন পুকুরপাড়ের খাস জমিতে। ৮ বছর বয়সী মেয়ে শাকিলা ও ১০ বছরের ছেলে শাকিলকে নিয়ে তার সংসার। স্বামী আরেকটি বিয়ে করে থাকেন ঢাকায়। নিজের বসতবাড়ি গড়ার ইচ্ছা ছিল। তাই, শুরু করেন সঞ্চয়। ৪ বছর আগে ১৮১৪ নম্বর হিসাব খুলেন রুরাল ডেভেল প্রোগ্রাম ফাইন্যান্স (আরডিপি) এন্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. নামে প্রতিষ্ঠানের শঠিবাড়ী শাখায়। রোজ ১শ টাকা করে জমা রাখেন সেখানে।

এছাড়াও, মাসিক কিস্তি আরও ৩ হাজার টাকা রাখেন সেখানে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রলোভনে মেয়ে-ছেলে, ভাতিজি, ভাই, ভগ্নিপতি, বোনের নামে এমএসএস প্রকল্পে আরও ৬টি হিসাব খোলেন। সবমিলে প্রায় ৪ লাখ টাকা জমা রয়েছে ফাইন্যান্স (আরডিপি) এন্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের কাছে।

চলতি বছরের গত ১৮ মে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে পালিয়ে যায়। খবরটি শুনে ক’দিন খাওয়া দাওয়া বন্ধ রেখে শুধুই কেঁদেছেন। পথে পথে ঘুরেছেন ওই ইট ভাঙা শ্রমিক। আরডিপি ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান গ্রেফতারের খবর পেয়ে খোয়া যাওয়া টাকা পুনরুদ্ধারে ধর্ণা দিচ্ছেন বিভিন্ন জনের কাছে।

এই সত্য গল্পটি উপজেলার পুকুরপাড়ের খাস জমিতে বসবাসকারী গোলেনুর বেগমের (৩৫)। শুধু গোলেনুর বেগমই নন- পুকুরপাড়ে বসবাসকারী ইটভাঙা শ্রমিক দুলাল (৪০) হিসাব নম্বর-১৭২৫, সোহাগী (৩০) হিসাব নম্বর-১৮৭৯, ছপুর আলী (৫৫) হিসাব নম্বর-৬৬১, করিমন (৫৫) হিসাব নম্বর-১৭২৭, মাকছুদা (৩০) হিসাব নম্বর-১৮০৫, মানিক (৪৫) হিসাব নম্বর-১৯০৭, চামেলী (৩০) হিসাব নম্বর-৬৬২, রায়হান (১৫) হিসাব নম্বর-১৮৩১, শাকিল (১০) হিসাব নম্বর-৩৯৩, নাজমা বেগম (২৫) হিসাব নম্বর-১৭৯৬, বাবলু (৪০), কল্পনা (৪০), মহুয়া বেগম (৫০), মর্জিনা (৬৫), শাহাজাদীসহ (৭০) প্রায় ৫০ জন হতদরিদ্র ব্যক্তির একই দশা। শুধুমাত্র পুকুরপাড়ের খাস জমিতে বসবাসকারীরা ওই প্রতিষ্ঠানের আমানত রেখেছিলেন প্রায় ১০ লাখ টাকা।

গোটা উপজেলায় প্রায় ১ হাজার আমানতকারীর ৩ কোটি টাকা নিয়ে আরডিপি ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ নামে এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা পালিয়ে যান। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৭ সালে নারায়নগঞ্জ জেলা সমবায় অফিসারের কার্যালয় হতে নিবন্ধিত হয়। যার নম্বর- ৩১৮। প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা দেওয়া হয় ৫৫/১-১ এসএম মালেহ রোড বিবি সড়ক নারায়নগঞ্জ।

বতর্মান ঠিকানা ৩২ পুনারা পল্টন, সুলতান আহমেদ প্লাজা নবম তলা ঢাকা-১০০০-এই পরিচয়ে ২০১২ সালে মিঠাপুকুর উপজেলার শঠিবাড়ী দক্ষিণ বাসস্ট্যান্ডে শাখা অফিস খুলে সদস্য ভর্তি ও আমানত সংগ্রহ শুরু করে। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার জন আমানতকারীর নিকট থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে। মিঠাপুকুর উপজেলা সদর বাজারের ব্যবসায়ি রুহুল আমিন ৬৬ হাজার, ওমর ফারুক ৬৭ হাজার, নুরুল আলম ৩৪ হাজার ৭শ, আব্দুল মালেকের ২৯ হাজার টাকা আমানত জমা করেছিলেন বলে জানান।

আমানতকারী গোলেনুর বেগম বলেন, “এক স্যার মোর দোকানোর চা খাবার আসি মোক সদস্য বানায়। মুই প্রতিদিন একশো ট্যাকা করি জমা করো। ম্যাল্যা ট্যাকা হইলে ফির (আবার) ওটিই থো। মোক শ্যাষ করি ওরা পালে গেল।”

আরেক আমানতকারী মর্জিনা বলেন, “মোর স্বামী নাই। কষ্ট করিয়া খোয়া (ইটের টুকরো) ভাঙ্গিয়্যা ওটি ট্যাকা থুছনু”। শাহজাদী বলেন, হামার কষ্টের ট্যাকা অটেকোনা (ওখানে) থুছনু। তারা মারি খাইল। হাসরের ময়দানে ট্যাকা দিব্যার নাগবে।” এর রকম একাধীক ব্যবসায়ি অধিক মুনাফার আশায় ওই প্রতিষ্ঠানে আমানত দিয়েছেন।

উপজেলা সমবায় অফিসার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আরডিপি ফাইন্যান্স নামের প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমে আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল। আমি একাধীকবার প্রতিষ্ঠানটির কাছে তথ্য চেয়েছিলাম। কিন্তু শাখা ব্যবস্থাপক সামিউল ইসলাম আমাকে কোন সহযোগিতা করেননি। আমানত হারানো কোন ব্যক্তি এ পর্যন্ত কোন অভিযোগ করেনি।

উপজেলা নির্বাহি অফিসার হারুন অর রশীদ বলেন, প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমে সন্দেহ দেখা দিলে উপজেলা প্রশাসন গত বছর ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটির প্রধান উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) মামুন অর রশীদ প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়- আরডিপি ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ এর কার্যক্রম সমবায় আইনের নীতিমালা পরিপন্থী। তদন্ত কমিটি মিঠাপুকুরে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু, ওই সময় হাইকোর্টের এক আদেশে শাখা বন্ধ সংক্রান্ত স্থগিত আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা থাকায় শাখা বন্ধের কোন ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন। তিনি আরও বলেন, কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেলে এ পর্যন্ত কোন আমানতকারী প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ দাখিল করেনি।



মন্তব্য চালু নেই