সিটি নির্বাচন:

বিএনপি কি ঘুরে দাঁড়ানোর মওকা পাবে

টানা তিন মাসের বেশি সময় হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি থেকে সরে এসে সিটি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। দলটি বলছে, আন্দোলনের অংশ হিসেবেই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তারা। জনগণ তাদের সঙ্গে আছেন এটি প্রমাণ দিতে চায় নির্বাচনে জয়ী হয়ে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। কার্যত আন্দোলন-কর্মসূচিতে সফল হতে পারেনি বিএনপি। টানা আন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসার পথ হিসেবে সিটি নির্বাচনকে বেছে নিয়েছে দলটি, রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন সে কথা। সিটি নির্বাচনে দলের সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় নেমে একাধিকবার হামলার শিকার হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। খোদ দলীয়প্রধানের গাড়িতে হামলার পরও ওই অর্থে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি দলটি।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারলে আন্দোলনে কার্যত ব্যর্থ বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর মওকা পাবে। আন্দোলনেও গতি আসবে দলটির। হেরে গেলে ভবিষ্যতে সরকারি আন্দোলনের হালে কতটুকু পানি পাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে নির্বাচনে সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনে বিএনপি যে নতুন করে আন্দোলনে যাবে না সেই নিশ্চয়তাও নেই। আর আন্দোলনে গেলে সরকারের ভূমিকা যে সহজ হবে না, তা অনেকটা অনুমেয়। কারণ, বিগত সময় আন্দোলনে বিএনপিকে খুব একটা মাঠে নামতে দেয়নি সরকার। আন্দোলনের নামে সহিংসতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান ছিল খুব শক্ত।

কেবল দেশের দুটি এলাকায় ভোট হবে ২৮ এপ্রিল। কিন্তু নির্বাচনী এলাকা যদি হয় রাজধানী ঢাকা আর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামে, তাহলে গোটা দেশের নজর যে এখানে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। বিএনপি-জামায়াত জোটের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের পরবর্তী পরিস্থিতিতে নির্দলীয় এই নির্বাচন অনেকটাই এনে দিয়েছে জাতীয় নির্বাচনের আমেজ। নির্বাচনে আসা-না আসা নিয়ে দোলাচলের মধ্যে বিএনপি হঠাৎ ঘোষণা দেয় ভোটে অংশ নেওয়ার আর প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারে নামেন স্বয়ং খালেদা জিয়া। এই ভোটকে বিএনপি কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এটাই তার প্রমাণ-বলছেন দলের নেতারা।

সঙ্গত কারণেই সবার চোখ এখন ২৮ এপ্রিলের দিকে। কী ঘটতে যাচ্ছে সেদিন? সমসাময়িক রাজনীতির ভবিষ্যতের অনেক কিছুই নির্ভর করছে ভোটের ফলাফলের ওপর।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের জন্যই বার্তা বয়ে আনবে সিটি নির্বাচন। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে হার-জিত থাকবেই। কিন্তু তারপরও হারে কিংবা বিজয়ে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা দেবে সিটি নির্বাচন, যা দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের জন্যই কম গুরুত্বের নয়।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য নজরুল ইসলাম খানের ভাষায়, ‘আন্দোলন ছেড়ে নির্বাচনে যাওয়া মানে এই নয় যে, আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে। সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ আন্দোলনেরই অংশ।’

যদি তা-ই হবে, তাহলে বুঝতে আর বাকি থাকে না, সিটি নির্বাচনের ফল ঘিরে আবার রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের শুরুতে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থার রেখাপাত হয়েছিল শেষতক তা ধরে রাখা যায়নি। নির্বাচনে আসা না আসার প্রশ্নে বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো বারবারই ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের’ কথা তুলছিল। তারা নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। শেষে এসে সেই কারণটি একেবারে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকেনি।

বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্বাচনী প্রচারণায় তার গাড়িতে বারবার হামলার পর নির্বাচনী হাওয়া বিএনপির পক্ষে আসবে, দাবি নেতাদের। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিজয় নিজেদের ঘরে তোলার স্বপ্ন দেখছে বিএনপি। বোঝা যাচ্ছে বেশ আটঘাট বেঁধেই নেমেছে দলটি। বিপরীতে আওয়ামী লীগ শিবিরেও চরম উত্তেজনা নির্বাচনকে ঘিরে। দিন-রাত না মেনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটির মেয়র প্রার্থীরা শেষ মুহূর্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে।

লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ দুই শিবিরে

রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে হার-জিত দুটোই থাকবে। বিএনপি হেরে গেলে লাভ-ক্ষতি দুটোই আছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই রকম। বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা যদি বিজয়ী হতে না পারেন তাহলে নির্বাচনে সরকারি দলের হস্তক্ষেপের অভিযোগ বেশ জোরেশোরেই তুলবে তারা। এখন ওই অর্থে চুপ থাকলেও পরে ঠিকই খালেদা জিয়ার গাড়িতে ও গাড়িবহরে হামলার বিষয়গুলো বেশ ইস্যু করে সামনে নিয়ে আসবে দলটি। সরকার যে জোর করে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে তার উদাহরণ হিসেবেই তুলে ধরবে এসব ঘটনা। যা ক্ষমতাসীন দলের জন্য বুমেরাংই হবে বটে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, বিএনপি নেত্রীর গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় দলটির প্রতি সাধারণ মানুষের অনুকম্পা বা সহানুভূতি বাড়বে বৈ কমবে না। তিনি বলেন, ‘যে বা যারাই এই হামলা করুক না কেন, তা মোটেও ঠিক হয়নি। কারণ খালেদা জিয়া দেশের বড় একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। শেখ হাসিনার ওপরও একই ধরনের হামলা হয়েছিল। এখন তিনি ক্ষমতায় থাকতে অন্যজনের ওপর এটি হলো। রাজনীতিতে এসব নোংরা সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি মোটেও কাম্য নয়।’ এই অধ্যাপক মনে করেন, যে বা যারাই এই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকুন না কেন তাদের বিচার ও শাস্তি হওয়া উচিত। তা না হলে ভবিষ্যতের রাজনীতিতে এটি খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকবে।

তবে হেরে গেলে বিএনপির জন্য নেতিবাচক ভাবমূর্তিও অপেক্ষা করবে বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বিএনপি হেরে গেলে সরকারকে দোষারোপ করার সুযোগ হয়ত পাবে, কিন্তু জনগণের মধ্যে এ নিয়ে বিরূপ ভাবমূর্তি তৈরি হবে। সরকারও গলা উঁচু করে বলার সুযোগ পাবে, বিএনপির সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের মূল অনেকটাই আলগা হয়ে গেছে।

এখন প্রশ্ন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচনে বিজয়ী হলে তবে কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বিএনপি নেতারা নিজেই। তারা বলছেন, নির্বাচনে জয় আমাদের প্রতি জনগণের আস্থার জয়, বিগত সময়ের আন্দোলনে মানুষের সমর্থনের জয় বলেই ধরে নেওয়া হবে। পাশাপাশি বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে নিজেদের হারানো আস্থা অনেকটাই ফিরে পাবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে। কিন্তু শেষমুহূর্তে এসে সরকার পরিবেশ যেভাবে অস্থিতিশীল করে তুলছে তাতে সংশয় তো থেকেই যাচ্ছে। যদি নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়, জনগণ তাদের কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তাহলে সমর্থন বিএনপির পক্ষেই আসবে।’ তিনি বলেন, ‘সরকার যদি জোর করে ফল নিজেদের পক্ষে নেয় তাহলে জনগণ এই নির্বাচন মেনে নেবে না। সরকারের প্রতি মানুষের অনাস্থা আরও বাড়বে। তখন বিএনপির আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে। সরকার এখন নিজেরাই ঠিক করুক তারা কী চায়।’

তবে সরকারি দল এসব অভিযোগ এক বাক্যে নাকচ করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারাই বলছেন, খালেদা জিয়ার গাড়িতে হামলার ঘটনার সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। জনগণই বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তার বহিঃপ্রকাশ দলীয়প্রধানের গাড়িতে হামলা। তাই এই দায় কখনই আওয়ামী লীগের নয়।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, ‘খালেদা জিয়া যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেই বিক্ষোভ হচ্ছে এবং তিনি বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন। তাকে দেখলেই সাধারণ মানুষ উত্তেজিত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করার হীন উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি উসকানিমূলকভাবে বিভিন্ন জায়গায় হুটহাট বেরিয়ে পড়ছেন। মিথ্যা-বানোয়াট ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। কারণ তিনি এসব করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান।’

নির্বাচন নিয়ে নানা আলোচনা

নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে বিএনপির মধ্যে যেমন আগ্রহ রয়েছে, তেমনি এই আলোচনাও আছে বিজয়ী হলেও মেয়র হিসেবে দায়িত্বপালন করা কতটুকু সম্ভব হবে তা নিয়ে। কারণ এর আগে গাজীপুর, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও খুলনা সিটিতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী জয় পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু কেউ এখন আর পদে নেই। মামলা, মোকদ্দমার মারপ্যাঁচে এখন তারা কেউ কারাগারে, কেউ আছেন পালিয়ে। উপজেলা নির্বাচনে জয় পাওয়া বিএনপির চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের অবস্থাও একই। ঢাকা বা চট্টগ্রামে মেয়র পদে জয়ী হলে যে তাদের একই ভাগ্যবরণ করে নিতে হবে না, তার নিশ্চয়তা কি?

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘সরকার তো জনপ্রতিনিধিদের ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে দিচ্ছে না। সরকারি দলের জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকলেও তারা বহাল তবিয়তে আছেন, অথচ বিএনপির লোকজনদের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এটা তো গণতান্ত্রিক কোনো আচরণ হতে পারে না।’ তিনি সংশয় প্রকাশ করে বলেন, ‘ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটিতে বিএনপি জয়ী হলেও একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তারপরও বিএনপি বিজয়ী হলে সরকারের থোতামুখ ভোঁতা হয়ে যাবে।’

নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার নিজেদের নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে পারে। পাশাপাশি বিএনপির নির্দলীয় সরকারের দাবি যে অযৌক্তিক তাও ফুটিয়ে তুলতে পারে।

রাজনীতি বোঝেন এমন বোদ্ধারা বলছেন, আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতার আসার শুরু থেকেই বিতর্ক কাঁধে নিয়ে শপথ নিয়েছে। এখন পর্যন্ত তারা নিজেদের গা থেকে সেই তকমা পুরোপুরি ধুয়ে ফেলতে পারেনি। এখন সিটি নির্বাচনে নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিয়ে তারা বিএনপিকে এই বার্তা দিতে পারে যে, তাদের অধীনেও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ হেরে গেলেও তা খুব খারাপ কিছু হবে না। নিরপেক্ষ থেকে যদি দল সমর্থিত প্রার্থী বিজয়ী হতে পারে তাও হতে পারে দলটির জন্য বড় অর্জন।

তবে কোনোভাবে যদি নির্বাচনে হস্তক্ষেপের নমুনা পাওয়া যায় তবে তা মোটেও ভালো কিছু হবে না। যদিও এখন পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপারসনের গাড়িতে হামলা ও তার প্রচারণার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় সরকারের হস্তক্ষেপের নজির স্পষ্ট হয়ে ওঠছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা।

জিতে গেলেও আওয়ামী লীগের জন্য বিএনপির দোষারোপের পাশাপাশি রাজনৈতিক অর্জন থাকবে বলে মনে করেন দলের নেতা-কর্মীরাও। তারা বলছেন, বিএনপি যে বারবার অহেতুক অভিযোগ করছে সরকারের ওপর থেকে জনগণের সমর্থন সরে গেছে, এই কথার সমুচিত জবাব দেওয়া সম্ভব হবে। তাছাড়া নামকাওয়াস্তে জাতীয় নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়ার অভিযোগও হালকা হয়ে আসবে। নির্বাচনের মাঠেও বা ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ যে জনপ্রিয় তাও প্রমাণ হয়ে যাবে।

দলের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ উল আলম লেনিন বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষই হবে। নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে বিএনপি ঠিকই কারচুপির অভিযোগ তুলবে। জিতে গেলে ঠিক আছে আর হারলে ঠিক নেইÑএটাই বিএনপি রাজনীতির সংস্কৃতি। এর আগে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলল। পরে দেখা গেল যেখান থেকে অভিযোগ তোলা হলো সেই উপজেলাতেই জয়ী হয়েছে বিএনপি প্রার্থী।’ তিনি বলেন, ‘কে কী বলল না বলল তাতে নির্বাচনের কোনো সমস্যা নেই। নির্বাচন ঠিকই অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে।’

তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গেলে কিছুটা বেকায়দায় পড়তে হবে তাদের। বিএনপি তখন বলে বেড়াবে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা দিনদিন কমছে। সরকারি দলের প্রার্থীদের ভাবমূর্তির জন্যও এটা বড় ধরনের ধাক্কা হবে।

আব্বাস-খোকা কোন্দল নিয়ে ভয়ে বিএনপি!

সিটি নির্বাচনের গোড়া থেকেই মেয়র প্রার্থী নিয়ে নানা মত ছিল বিএনপিতে। দলীয় সূত্র বলছে, বিশেষ করে দক্ষিণের প্রার্থী নিয়ে ভেতরে-ভেতরে ভিন্ন সমীকরণ ছিল। দক্ষিণে মির্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকা দুটি আলাদা শিবিরে বিভক্ত। খোকাপক্ষ কোনোভাবেই আব্বাসকে প্রার্থী করার পক্ষে ছিল না। যে কারণে খোকার ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত দলের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালামকে প্রার্থী করা হয়েছিল। দলীয় প্রার্থীকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিলেও ভেতরগত দ্বন্দ্ব পুরোপুরি মিটে গেছে এটা বলা যাবে না। তাই নির্বাচনে আব্বাসের প্রতিকূলে ফলাফল চলে গেলে এই দ্বন্দ্বের বিষয়টি আলোচনা আসতে পারে বলে মনে করছেন দলের নেতা-কর্মীরাই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘খোকা-আব্বাসের দ্বন্দ্ব মিটে যায়নি। খোকা বিদেশে থাকলেও তার অনুগামী-অনুসারীরা ঠিকই তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আব্বাস যদি ঢাকার মেয়র হন তাহলে ঢাকায় খোকার একক আধিপত্যে অনেকটাই চির ধরবে। খোকা সমর্থকরা সেই দিকটি বড় করে দেখছে।’

অন্যদিকে উত্তরে তাবিথ আউয়ালকে অনেকটা নিরুপায় হয়েই সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। সামান্য ভুলে আবদুল আউয়াল মিন্টুর প্রার্থিতা বাতিলের পর বিএনপির আর কিছুই করার ছিল না। মিন্টুর মতো একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক এ ধরনের সামান্য ভুল করতে পারেন এখন বিশ্বাস হয় না দলের নেতা-কর্মীদের। তারা মিন্টুকে এখনো সন্দেহের চোখ থেকে আড়াল করেননি। কারণও আছে, মিন্টু মূলত আওয়ামী লীগ থেকে যোগ দিয়েছিলেন বিএনপিতে। কিন্তু তাই বলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সম্পর্ক যে পুরোপুরি ম্লান হয়ে গেছে তা নয়, নিজের ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীর মেয়ের সঙ্গে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও মিন্টুর নিয়মিত যোগাযোগ-সম্পর্ক রয়েছে এমন তথ্যও চাউর আছে বিএনপিতেই। তার ইঙ্গিতেই মিন্টু নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এ কথাও শোনা যায় দলীয় নেতাদের মুখে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের কারণে বিএনপি যদি উত্তরে হেরে যায় তবে মিন্টুকে নিয়ে সন্দেহ-অবিশ্বাস আরও শক্ত হবে। তবে জিতে গেলে কিছুটা সুবিধা পাবেন মিন্টু।

আওয়ামী লীগেও দানা বাঁধবে বিশ্বাস-অবিশ্বাস!

নির্বাচনে পরাজয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরেও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। ঢাকা দক্ষিণ থেকে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিম। মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন, পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন সংসদ থেকে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ‘মনোকষ্ট’ নিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে তাকে। তিনি বিষয়টি ঠিকঠাক মেনে নিলেও তার অনুসারী-অনুগামীরা কতটুকু স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কোনো কারণে দক্ষিণে পরাজিত হলে তাদের দিকে আঙুল তাক করা হলে বলার কিছু থাকবে না।

নিরপেক্ষতাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ

সিটি নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা সরকারের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, গত কয়েকদিনে খালেদা জিয়ার গাড়িতে হামলার ঘটনায় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। অভিযোগ ওঠছে, সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা বিএনপির জয় নিশ্চিত জেনে খালেদা জিয়ার প্রচারাভিযানে বাধা দিতে চাইছে। অন্যদিকে বিএনপিও অনড় প্রচারণা থেকে। একাধিকবার গাড়ি বহরে হামলার পর তৃতীয়বারও খালেদা জিয়া নেমেছিলেন প্রচারে। আর তখনই নিজের গাড়িতে হামলার শিকার হতে হয় তাকে।

তারপরও নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে যাননি খালেদা। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন তো বলেই দিলেন, ‘সরকার কতদূর করতে পারে আমরা দেখতে চাই। এসব করে নির্বাচন থেকে আমাদের সরিয়ে দেওয়া যাবে না। সরকার যদি বাকশাল কায়েম করতে চায় তাহলে সেটা বলে দিক। আমরা গণতান্ত্রিক উপায়ে আমাদের করণীয় ঠিক করে নেব।’

অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের অন্যতম পরামর্শক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘সরকার চায়নি বিএনপি নির্বাচনে আসুক। বিএনপি যদি নির্বাচন থেকে সরে যেত তাহলে সরকার খুব খুশি হতো। এখন যখন বিএনপিকে কোনোভাবেই নির্বাচন থেকে সরানো যাচ্ছে না তখন হামলা করে পিছু হটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এগুলো করে বিএনপিকে পিছু হটানো যাবে না।’

বর্তমান নির্বাচন কমিশনেরও মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন তারা করেছেন। কিন্তু সুনামের চেয়ে দুর্নামই জুটেছে বেশি। এখন শেষ বেলায় এসে কমিশন নিজেদের ভালো কাজের স্বীকৃতি আদায় করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তীর মত, ‘গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তার পছন্দের প্রতিনিধিকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেয়। এটা যতটা স্বচ্ছ ও জবাবদিহি হবে ততই জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে।’-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।



মন্তব্য চালু নেই