ক্ষমা না চাওয়ার মনস্তাত্ত্বিক কারণ

ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয় “Sorry” বলতে। নিজেদের ছোট ছোট ভুলগুলো শুধু এই একটা শব্দে শুধরে নিই যেন! সামনের মানুষটি যতই আহত হোক, একটা সরি তার ক্ষতটা পূরণ করে অনেকখানি। কারণ “Sorry” মানে নিজের ভুল বুঝতে পারা। “Sorry” মানে সম্পর্কের জট খুলে সহজ স্বাভাবিকতা বজায় রাখা। তবু কিছু মানুষ কেন ক্ষমা চায় না? এমনকি যখন পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে, দোষ তারই ছিল!

এটা শুধু জেদ নয়, সমস্যা আরও গভীর। মতামত দিয়েছেন মনোবিজ্ঞানী গাই উইডচ পি এইচ ডি।

এমন কি কখনো খেয়াল করেছেন, সকালে ফোন করলেন প্রিয় মানুষটিকে, ফোন ধরেই রূঢ় স্বরে কথা বলল সে। আপনি মন খারাপ করলেন, কিন্তু বুঝতেই পারলো না কিসে আপনার খারাপ লেগেছে! আপনি হয়ত দৈনন্দিন খোঁজ নিচ্ছেন। এক প্রশ্ন ২ বার করাতেই বিরক্তি প্রকাশ করলো মানুষটি। কেন? এটা তার স্বভাবের অংশ! কোন ‘Sorry’ বলার প্রয়োজন বোধ করল না সে। পাল্টা আপনার খারাপ লাগাকেই অযৌক্তিক ঘোষণা করল।

অথচ ছোট একটা ‘sorry’ হয়ত বদলে দিত সময়টা। এমন অনেক সময় হয়, ছোট ছোট বিষয় নিয়ে আমরা ঝগড়া করে যাই ঘন্টার পর ঘন্টা। যার কোন মানে নেই। সামান্য ব্যাপার, কিন্তু একে অপরকে দোষারোপ করে করে তর্কটাকে আরও দীর্ঘ করি। একটা ছোট্ট শব্দের বিনিময়ে আমরা বিসর্জন দিই দিনের অনেকগুলো সময়।

কেন এমন হয়? কি চলে এই মানুষগুলোর মাথায়? নিজের ভুল স্বীকার করা সহজ কাজ নয় মোটেও তাদের জন্য। তাঁরা বরং আপনার মণ ভাল করতে আরও ১০টা কাজ করবে, উপহার দেবে, বেড়াতে নিয়ে যাবে। কিন্তু সমাধান না হওয়া বিষয়টি সমাধান করবে না। আপনি সে প্রসঙ্গে গেলে আবারও বিরক্তই হবে।

জেনে নিব কারণগুলো-

১। নিজের ভুল স্বীকার করা এই মানুষদের জন্য একটি বড় সমস্যা, কারণ তারা আসলে নিজেদের প্রতিক্রিয়াগুলোকে নিজেদের চরিত্র থেকে আলাদা করতে পারেন না। তারা ভাবেন, এগুলো তার স্বভাবের অংশ। আর যদি তারা ভুল কিছু করেই থাকেন তাহলে নিশ্চই তারা খারাপ মানুষ। তারা বুঝতে পারেন না যে, ছোটখাট ভুল সবাই করে। এটা দিয়েই সম্পূর্ণ ব্যাক্তিত্ব বিচার করা যায় না। ক্ষমা চাওয়া তাদের কাছে নিজের ব্যক্তিত্বের উপর আঘাত বলে বোধ হয়।

২। বেশীভাগ মানুষের ক্ষেত্রে ক্ষমা চাওয়ার সাথে জড়িয়ে থাকে অপরাধবোধ। যেমন ভুল অপরাধবোধের মাত্রাও তেমন কম-বেশী। কিন্তু কখনোই ক্ষমা না চাওয়া এই মানুষেরা বোধ করে লজ্জা। যেখানে অপরাধবোধ থেকে আমরা আমাদের প্রতিক্রিয়ার দিকে নজর দেই, সেখানে তারা নিজেকে নিয়ে লজ্জিত বোধ করতে থাকেন। নিজেকে দোষী ভাবার চেয়ে নিজেকে নিয়ে লজ্জিত হওয়া বেশী কষ্টদায়ক।

৩। যেখানে আমরা চিন্তা করি, সরি বললে আমাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন কমবে, সেখানে ক্ষমা চাইতে ভীত এই মানুষেরা মনে করেন, ক্ষমা চাওয়া আরও অভিযোগের দ্বার খুলে দেবে। তারা মনে করেন, এতে সম্পর্কের তিক্ততা আরও বাড়বে। কারণ অভিযোগকারী তখন পুরোনো আরও বিষয়কে টেনে আনবেন যেগুলো জন্য তিনি সরি বলেন নি।

৪। এ ধরণের মানুষেরা মনে করেন ক্ষমা চাইলে তাদেরকে পুরো ঘটনার সম্পূর্ণ দায় নিয়ে নিতে হবে। এতে তারা তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। বাস্তবে যে কোন সম্পর্কে দায় থাকে দুই পক্ষেরই। কোন ভুলত্রুটি হলে বা রেগে গেলে তার সবকিছুরই কোন না কোন কারণ থাকে। যে কারণের দায় অভিযোগকারীর। সুতরাং একজনকেই দোষী হয়ে অবনত হয়ে থাকতে হবে এমন আওলে কিছু নেই।

৫। ক্ষমা চাইতে না চাওয়া এই মানুষেরা আসলে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। রেগে যাওয়া, বিরক্তি প্রকাশ, আবেগের দূরত্ব এসবকিছুই মেনে নেওয়া তাদের জন্য সহজ। কিন্তু ক্ষমা চাওয়া নয়। ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গটি তাদের হতাশ করে। নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে যে সংকট তাদের মধ্যে তৈরি হয় সেটি তারা কাটিয়ে উঠতে পারে না।

সমাধান কি? সমাধান হল সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা। আপনার সাথে সম্পর্ক যত কাছের হবে ততোই ভাঙবে এই দেয়ালগুলো। আপনি যে কোনভাবেই তাকে ছোট করছেন না, করবেন না এই আস্থা তৈরি হলে মানুষটি নিজের আবেগ প্রকাশে সহজ হবে। সম্পর্কের দায়িত্ব দু’জনের। এখানে কেউ ছোটবড় নেই। মন থেকে শংকা দূর হয়ে গেলে থাকবে শুধুই ভালবাসা। মাঝে মাঝে টোকা দেবে অভিমান, অনুযোগ। ফিরে যাবে ছোট একটি শব্দে ‘SORRY’ ।



মন্তব্য চালু নেই