ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে যেসব প্রাচীরের শহরগুলো

একটি শিশু জন্মের পর খাদ্য ছাড়া আর যে জিনিসটার চাহিদা সবচেয়ে বেশি অনুভব করে তা হলো নিরাপত্তা। মায়ের কোলে শিশু যেমন নিজেকে নিরাপদ মনে করে, মাতৃভূমির কাছেও সে নিরাপত্তা আশা করে। তাই তো মায়ের পরেই দেশমাতৃকা স্থান পায়। শুধু মানব শিশু না, এমনকি একটি বৃক্ষেরও নিরাপত্তা প্রয়োজন। তাই পশু-পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা জন্য সেটিকে প্রাচীরে আবদ্ধ করা হয়।

ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার জন্য বিভিন্ন সময় নানা ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করে আসছে। কালের আবর্তনে পাথরের ভোঁতা হাতিয়ার থেকে আজ তৈরি হয়েছে আধুনিক সব ধারাল হাতিয়ার। আক্রমণ প্রতিরোধের পদ্ধতি হিসেবে একসময় শহরজুড়ে দীর্ঘ সব প্রাচীর তৈরির প্রচলন ছিল।

চীনের প্রাচীরের নাম সবারই জানা। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু সুরক্ষাপ্রাচীর। এই প্রাচীরগুলো স্ব স্ব স্থানের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে।

ডুবরোভনিক, ক্রোয়েশিয়া
এটি আকর্ষণীয় সমুদ্রতীরবর্তী স্থান এবং সহজ বিমান পরিবহণের জন্য জনপ্রিয়। ডুবরোভনিকের প্রাচীরটি ‘ইউরোপিয়ান ওয়াল অব চায়না’ নামে পরিচিত।

মধ্যযুগীয় এই প্রাচীরটি ১৬ শতাব্দীতে নির্মিত হয়। এর দৈর্ঘ প্রায় ৫.৫ কিলোমিটার। এতে ৪০টি টাওয়ার (এখন ২০টি টিকে আছে) এবং পাঁচটি দুর্গ আছে।

1424

ডুবরোভনিক প্রাচীরের একাংশ

পর্যটকদের ক্রমাগত আগমনে দিনকে দিন প্রাচীরঘেরা এ শহরে বেশ পরিবর্তন আসছে। যেসব স্থানীয়রা শহর ছেড়ে গেছে তাদের বাড়িগুলো এখন পর্যটকদের ভাড়া দেওয়া হয়। শহরটি ছোট হলেও তুলনামূলক আন্তরিক ও সুরক্ষিত পরিবেশ থাকায় অনেক পরিবার এখন এ শহরে তাদের সন্তান নিয়ে ফিরে আসছে।

জেরুজালেম
জেরুজালেমের প্রাচীরঘেরা শহরটি ওল্ড সিটি নামে পরিচিত। প্রাচীরের নাম ওয়েস্টার্ন ওয়াল। যদিও প্রাচীন জেরুজালেম নগরের এই প্রাচীর ১৫ শতাব্দীতে নির্মিত, এটি মূলত বাইবেলে উল্লিখিত সময়ের ইতিহাস বহন করে।

231

জেরুজালেমের ওল্ড শহরে ওয়েস্টার্ন ওয়াল

কারো কারো মতে, জেরুজালেমে একটি তীব্র রাজনৈতিক আবহ আছে। যদিও কিছু অঞ্চলে বেশ কিছু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে, প্রাচীরটির ভেতর এবং বাইরের প্রতিবেশীরা তাদের জাতীয়তা এবং ধর্ম দ্বারাই নির্দেশিত হন। ওল্ড সিটিতে ইহুদিরা বসবাস করে।

আভিলা, স্পেন
আভিলার প্রাচীরটি ১২ শতাব্দীতে নির্মিত হয়। নিম্ন শ্রেণির প্রজাদের সঙ্গে লিওন সা¤্রাজ্যের যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে স্থানীয়দের রক্ষার জন্য এটি নির্মিত হয়। প্রাচীরের সঙ্গে নিরাপত্তা চৌকি আছে। প্রায় ১ হাজার বছর পর পুরো শহরটি প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। তবে মধ্যযুগীয় সেই প্রাচীর টিকে আছে আজো।

213

 

আভিলার প্রাচীর

এখন নিরাপত্তাপ্রাচীরে ঘেরা এই শহরটি খুব শান্ত এবং এর পরিবেশ খুবই আন্তরিক। রাতে একদম স্তব্ধ থাকে। তবে শহরের দক্ষিণে বর্তমানে দ্রুত গতিতে উন্নয়ন হচ্ছে। যে কারণে প্রাচীরঘেরা শহর ছেড়ে নতুন প্রজন্ম সেদিকেই ঝুঁকছে।

কার্টাগেনা, কলম্বিয়া
কার্টাগেনার এই প্রাচীরটিও নির্মিত হয় স্প্যানিশদের হাতে। কার্টাগেনার ক্যারিবিয়ান বন্দরনগরী স্পেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল। এই শহরের দখল নিয়ে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের মধ্যে সংঘাত হয়। পরে ব্রিটিশদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য কয়েক লাখ স্প্যানিশ রিয়াল খরচ করে প্রাচীরটি নির্মাণ করে স্পেন, যা এখনো দাঁড়িয়ে আছে।

2132

কার্টাগেনার প্রাচীর, যার সঙ্গে যুক্ত ক্লক টাওয়ার

কার্টাগেনা নানা কারণেই বিখ্যাত। তবে শহরের সুরক্ষাপ্রাচীর দেখে বিস্মিত হবে যে কেউ। যারা শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চায়, তাদের জন্য প্রাচীরের সৌন্দর্যই যথেষ্ট। মধ্যযুগীয় স্থাপত্যশৈলীর নির্দশন পাওয়া যায় কার্টাগেনার প্রাচীরে। তবে প্রাচীরের সঙ্গে স্থাপিত ক্লক টাওয়ার সত্যিই মুগ্ধ করার মতো একটি বিষয়।

কারকাসন,ফ্রান্স
ফ্রান্সের কারকাসন শহরের মধ্যে ‘লা সিটি’ অঞ্চলঘিরে এই প্রাচীর অবস্থিত। এর দৈর্ঘ ৩ কিলোমিটার। মধ্যযুগীয় দুর্গের মতো প্রাচীরবেষ্টিত কারকাসন শহরটি একটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে সমাদৃত।

322

প্রাচীরঘেরা কারকাসন বসতি, যা দেখতে দুর্গের মতো মনে হয়

লা সিটিতে হাজার বছর ধরে বসবাস করা মানুষের জীবন ব্যবস্থা, কাজের কৌশল, তাদের বানানো দুর্গ, বাড়িঘর এমনকি লা সিটির প্রাচীর বানানোর ইতিহাস জানা যায় এখানে এলে।

লা সিটির ভেতরে আছে প্রায় ৫০টি স্থায়ী বসতি। প্রাচীরঘেরা এই বাড়িগুলো দেখতে প্রতিবছর প্রায় ৪০ লাখ দর্শনার্থী আসে। তবে মজার ব্যাপার হলো, সুরক্ষাপ্রাচীর দিয়ে বাড়িগুলো এমনভাবে বেষ্টিত যে, তা পতিত বাড়ি মনে হয়। বেশির ভাগ দর্শনার্থী বুঝে উঠতে পারেন না যে, দুর্গের মতো এই বাড়িগুলোতে এখনো মানুষ বাস করে। মনে হয়, এই বাড়িগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে শুধু দর্শনার্থীদের জন্য।

লেখক : শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও গণযোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।



মন্তব্য চালু নেই