অবরোধের শহরে ভালোবাসার দিবস

বছর ঘুরে দোরগোড়ায় আবার উপস্থিত ভ্যালেন্টাইন’স ডে, সহজ বাংলায় “ভালোবাসা দিবস”। পহেলা ফাল্গুন যখন প্রেমের ঋতু বসন্তের সূচনা জানান দেয়, ঠিক পিঠাপিঠি তখন ভালোবাসা দিবসের উপস্থিতিটা মিলেমিশে দারুণ উৎসবমুখর একটা পরিবেশ তৈরি করে এই যান্ত্রিক নগরীর বুকে।

পহেলা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস, একুশে বইমেলা… সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসটাই যেন উৎসবের। কেবল রঙিন পোশাক, উপহারের ঝাঁপি কিংবা হাতে হাত রেখে প্রেমিক-প্রেমিকার সময় কাটানোই নয়; একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন যে ক্রমশ ভালোবসা দিবসটি আমাদের দেশে হয়ে উঠেছে সার্বজনীন। বলতে গেলে প্রায় সব বয়সের, সব স্তরের মানুষের মাঝেই আজকাল দেখা যায় ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে একটু না একটু বিশেষ প্রস্তুতি। সকলেরই থাকে একান্ত ব্যক্তিগত একটুখানি বিশেষ আয়োজন।

অনেকেই বলতে পারেন, ভালোবাসার আবার দিবস কি! কিংবা ভালোবাসার জন্য কোন দিবসের প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ, ভালোবাসা চিরদিনের। ভালোবাসা জীবনের প্রতিটি দিনের জন্য। কিন্তু একটি বিশেষ দিনে সেই ভালোবাসাকে ঘিরে উৎসব পালন করার মাঝে কিন্তু আসলে ক্ষতিও কিছু নেই। ছোট্ট একটা জীবন, মাত্র একটিই তো জীবন। সেই ছোট্ট জীবনে আনন্দ করার, উদযাপন করার বাহানা পাওয়া গেলে ক্ষতি কি বলুন। সকলেরই তো আছে একজন কাছের মানুষ, একজন পাশের মানুষ। যার হয়তো পাশে কেউ নেই, তাঁরও আছে মনের গহীন লুকিয়ে থাকা একজন মানুষের আকাঙ্ক্ষা। হৃদয়ের একান্তে থাকা সেই মানুষটির জন্য কিছু মিষ্টি মুহূর্ত বিশেষ আয়োজনে পালন করা, নিজের ভালোবাসা আর স্বপ্নগুলো উদযাপন করা ভালোবাসা দিবসের বাহানায়-সব মিলিয়ে এই তো ভালোবাসা দিবস।

অন্যান্য দেশে হবে জানি, কদিন যাবতই ভাবছিলাম- এ বছর কি সত্যিই এই শহরের বুকে পহেলা ফাগুন কিংবা ভালোবাসা দিবস আসবে? অন্য বছরগুলোর মত পহেলা ফাগুনের বাসন্তী রঙে ভরে উঠবে শহর আর ভালোবাসা দিবসের মিষ্টি ছোঁয়া দেখা যাবে সর্বত্র? এই শহর এখন অবরোধের শহর, এই শহর এখন হরতালের শহর। এই শহর এখন ককটেল, পেট্রোল বোমা আর আগুনে ঝলসে যাওয়া মানুষের শহর। দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতায় এই শহর এখন ক্লান্ত, বিরক্ত, কিছুটা আতঙ্কিত আর অনেকখানি হতাশ। অবশ্য শুধু এই শহর বলছি কেন, পুরো দেশটা জুড়েই তো একই অবস্থা। এই চাপা আতংকের জীবনযাপনে ফাগুন কিংবা ভালোবাসা দিবসের জন্য আদতেই কোন প্রবেশ পথ খোলা আছে?

মজার বিষয়টি হচ্ছে, আমাকে ভীষণ বিস্মিত করে সমস্ত ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে মানুষের ভিড়ে হিজিবিজি এই শহরটা। হরতাল-অবরোধ-সহিংসতার এই নগরীতেও ফাগুন প্রবল ভাবে জানান দিচ্ছে নিজের উপস্থিতি, ভালোবাসা দিবসের তুমুল আয়োজন জানিয়ে দিচ্ছে যে ভালোবাসার উদজাপনেও কমতি হবে না কিছুই। প্রেমিক-প্রেমিকারা হাত ধরে নেমেছে রাস্তায়, মা-বাবার পাশে পাশে বেড়াতে বেরিয়েছে ছোট্ট ছেলেমেয়েরা, এখানে-সেখানে তরুণদের উপচে ভরা ভিড় আর তারুণ্যের কলতান। শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত আতঙ্ক আর ভয়কে উপেক্ষা করেই রাস্তায় নেমেছে মানুষ। তাঁদের বর্ণিল পোশাক, রঙিন ফুল আর হাসির কলতানে যেন ধুয়ে-মুছে গিয়েছে বিগত অনেকগুলো দিনের সমস্ত কালিমা। দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হচ্ছিল, বহুকাল পর যেন এই শহরের মানুষকে হাসতে দেখলাম।

হ্যাঁ, হয়তো এই স্বস্তি এই আনন্দ সবই সাময়িক। ভালোবাসা দিবসের উচ্ছ্বাস ফুরিয়ে গেলেই আবার এই শহরটি বদলে যাবে আতঙ্ক আর মৃত্যুর নগরীতে। কিন্তু একথা অস্বীকারের কোন উপায় নেই যে ভালোবাসার শক্তি অনেক অনেক বেশি। এতটা বেশি যে দুঃসহ দিনযাপনের গৎবাঁধা রুটিনের মাঝেই ভালোবাসার প্রিয়মুখগুলো আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, বাঁচিয়ে রাখে আগামীর প্রত্যাশায়। ঘুরেফিরে জীবনটা তো এই ভালোবাসাই, ঘুরেফিরে জীবনটা তো প্রিয় মানুষদের পাশাপাশি বেঁচে থাকারই নাম।

একদিন নয়, ভালোবাসা ঘিরে থাকুক সবাইকে জীবনের প্রতিটি দিন। অবরোধের এই শহরে সকলের জীবন যাপন হোক নিরাপদ, পেট্রোল বোমার আগুনে আর একটি মানুষের জীবনও ঝলসে না যাক, দিনশেষে নিরাপদে ঘরে ফিরে আসুক সকলের প্রিয়জন- ভালোবাসা দিবসে সকলের জন্য এটুকুই শুভকামনা।

ভালো থাকুন, ভালবাসুন, স্বস্তির হোক সকলের আগামী দিনগুলো।

-রুমানা বৈশাখী
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫



মন্তব্য চালু নেই