৫৪ বছর পর চূড়ান্ত আলোচনায় গঙ্গা ব্যারাজ

প্রথম জরিপের ৫৪ বছর পর চূড়ান্ত আলোচনার পথে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ প্রকল্প। অবশেষে এ বিষয়ে আলোচনা করতে ঢাকায় আসছে ভারতীয় প্রতিনিধিদল।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, চার দিনের সফরে আট সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধিদল আজ বিকেলে ঢাকায় পৌঁছাবে।

গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের বিষয়ে প্রথম জরিপ হয় ১৯৬২-৬৩ সালে। ব্যারাজ তৈরির সম্ভাবনা তৈরি হয় ১৯৯৬ সালে। এরপর অনেকবার ঘুরেফিরে এসেছে ব্যারাজ প্রসঙ্গ। কিন্তু অপরপক্ষ ভারতের অনাগ্রহের কারণে পরিকল্পনা হালে পানি পায়নি। দেশটির ইতিবাচক সাড়ায় এবার চূড়ান্ত আলোচনায় আসছে মেগা প্রকল্পটি।

১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের ফলে বাংলাদেশের জন্য গঙ্গা ব্যারাজ তৈরির সুযোগ হয়। গঙ্গা অববাহিকার পানি সংরক্ষণ করে তা দেশের কৃষিসহ বহুমুখী কাজে ব্যবহারের লক্ষ্যে এই ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনা করে বাংলাদেশ। কিন্তু শুরু থেকেই এই ব্যারাজ নিয়ে ভারত কোনো সাড়া দেয় না। ২০০১ সালের পর থেকে আনুষ্ঠানিক আলোচনা এবং যৌথ নদী কমিশনের বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকেও এ প্রসঙ্গে দেশটি কথা বলেনি। এমনকি গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় যৌথ ঘোষণায় এ নিয়ে ইতিবাচক ফলের প্রত্যাশাও করেছিল বাংলাদেশ। তাতেও সাড়া মেলেনি।

ভারত বরাবরই বলে এসেছে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সে দেশে নেতিবাচক প্রভাবের কথা। কিন্তু ভারতের উদ্বেগ যে অমূলক, তা প্রতিবারই বোঝাতে চেয়েছে বাংলাদেশ।

কূটনীতিকরা জানিয়েছেন, তিন বছর ধরে ভারতের অবস্থান পাল্টেছে। আলোচনা সেমি-চূড়ান্ত পর্যায়ে রূপ নেওয়ার পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রকল্পের চূড়ান্ত সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। এরপরও ভারতের অনাগ্রহের কারণে কাজ আটকে ছিল অনেক দিন। অবশেষে এই প্রকল্পে আলোচনা করতে রাজি হয়েছে ভারত। আর এই পরিস্থিতি বজায় রেখে ভারতকে নিয়েই গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইছে বাংলাদেশ।

এই অবস্থায় আজ সোমবার বিকেলে গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে আলোচনার জন্য ভারতের সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের পরিচালক ও প্রধান প্রকৌশলী (এইচএসও) ভুপাল সিংয়ের নেতৃত্বে দেশটির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পশ্চিম অঞ্চল) প্রকৌশলী আবদুল হাই বাকী বলেন, প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারাজের খসড়া ডিজাইন অনুমোদন করা হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাঠানো ডিপিপি প্রস্তাব এরই মধ্যে চূড়ান্ত করেছে পরিকল্পনা কমিশন। সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, চার দিনের সফরে আসা আট সদস্যের এই প্রতিনিধিদলটি ঢাকা পৌঁছাবে আজ বিকেলে। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সাভার-মানিকগঞ্জ হয়ে পাটুরিয়া যাবেন তারা। মঙ্গলবার তারা ফরিদপুর সার্কিট হাউসে অবস্থান করবেন। বুধবার তারা পাংশায় প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারাজ এলাকা পরিদর্শন করবেন।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সকাল সাড়ে ১০টায় আলোচনায় বসবে। শুক্রবার সকালে প্রতিনিধিদলটি দিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বে।

ভারতের সঙ্গে গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশের ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুল হাই বাকী।

সরকারের বর্তমান অবস্থান : ভারত এ প্রকল্প নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানালেও সরকার এখন তাদের নিয়েই প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও এ প্রকল্পে ইতিমধ্যে চীন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। বিশ্বব্যাংকও আগ্রহী। কিন্তু এ ক্ষেত্রে উজানের দেশ হচ্ছে ভারত। তাই ভারতের সম্মতি না পেলে তাতে অর্থায়ন করবে না সংস্থাটি।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ঢাকা সফরের সময় গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পটি অন্যতম আলোচ্য বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছিল। তা ছাড়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময় গঙ্গা ব্যারাজসহ কয়েকটি প্রকল্পের বিষয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। গঙ্গা ব্যারাজে জাপানের অর্থায়নের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে বাংলাদেশ। তবে মূল আলোচনায় রাখা হচ্ছে ভারতকে।

গত সেপ্টেম্বরে দিল্লি সফরের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতীর সঙ্গে দেখা করেন। আলোচনায় এ প্রকল্পে ভারতের সহযোগিতা চান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এরই মধ্যে মেগা প্রকল্প হিসেবে সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় এটি স্থান পেয়েছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে, ভারতকে আস্থায় না নিয়ে বাংলাদেশ এই ব্যারাজ নির্মাণ করতে আগ্রহী নয়। এর মূল কারণ হলো, ভবিষ্যতে যাতে এ নিয়ে দুদেশের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না থাকে। বিষয়টি মাথায় রেখে আলোচনা চালিয়ে যেতে মন্ত্রণালয়ের প্রতি নির্দেশনা রয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায়ের।

প্রকল্পের বর্ণনা : গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প এলাকার পূর্বে পদ্মা ও মেঘনা নদী, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরে রাজশাহী বিভাগের আংশিক এলাকা ধরা হয়েছে।
সরকার গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের সম্ভাব্য সমীক্ষা ও পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির জন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠান ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্ট লিমিটেডের (ডিডিসি) সঙ্গে ২০০৯ সালে একটি চুক্তি সই করে। গত বছর ডিডিসি কাজটি শেষ করেছে।

সমীক্ষা শেষে বলা হয়েছে, গঙ্গা ব্যারাজের দৈর্ঘ্য হবে ২ দশমিক ১ কিলোমিটার। প্রকল্পে ২ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধারণযোগ্য জলাধার তৈরি করা হবে। রাজবাড়ীর পাংশা থেকে ভারত সীমান্তের পাংখা পর্যন্ত বিস্তৃত জলাধারের দৈর্ঘ্য হবে ১৬৫ কিলোমিটার।

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ওই এলাকায় জলাধারের পানি বিভিন্ন মৌসুমে সেচ, মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ, অব্যাহত নৌপরিবহন ও লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হবে। প্রকল্প এলাকায় বছরে ২৫ লাখ টন অতিরিক্ত ধান উৎপন্ন হবে, প্রায় ১০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে, বছরে মাছ উৎপাদন হবে প্রায় আড়াই লাখ টন।



মন্তব্য চালু নেই