৪ নেতাতেই ঢাকা জেলা বিএনপি

রহস্যজনক কারণে দীর্ঘ ১৬ বছর পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই ঢাকা জেলা বিএনপির। ৯৮ সালে ৫ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালে আহ্বায়ক নাজমুল হুদাকে বহিষ্কারের পর আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সংখ্যা হয় চার। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। ফলে গত ১৪ বছর ধরে এই ৪ নেতাই জেলা বিএনপির সর্বেসর্বা।

অদক্ষতার কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে এ সাংগঠনিক কমিটি। এ নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের শেষ নেই। কমিটি না হওয়ায় অনেকেই রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছেন। যার প্রভাব পড়েছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলনে।

সেই আন্দোলনে সারা দেশে আন্দোলনের জোয়ার বইলেও রাজধানীর মতো আন্দোলনবিমুখ ছিলো ঢাকা জেলা বিএনপি। এর জন্য সাংগঠনিক স্থবিরতাকেই দায়ি করছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।

জানা গেছে, সংগঠন ঢেলে সাজানোর ধারাবাহিকতায় এবার ঢাকা জেলা বিএনপির ১৬ বছরের বয়োবৃদ্ধ কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন দলের হাইকমান্ড। আর নতুন কমিটিতে অভিজ্ঞ ও তরুণদের সমন্বয়ে নতুন কমিটি ঘোষণার প্রক্রিয়া চলছে। দেশের অন্যান্য সাংগঠনিক জেলার মতো গুরুত্বপূর্ণ এ জেলা কমিটি গঠনেও দলের হাইকমান্ড ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। আর এ প্রক্রিয়ায় বাদ পড়ছেন কমিটির বর্তমান সভাপতি আব্দুল মান্নান ও সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ আমান। দলের এ মনোভাবের অবস্থান বুঝতে পেরে ইতিমধ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন পদ প্রত্যাশী নেতা কর্মীরা।

অপরদিকে বর্তমান জেলা কমিটিকে বহাল রাখার জন্যও একটি পক্ষ চেষ্টা তদবির করছে বলে দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে।

নেতাকর্মীরা জানান, ১৯৯৩ সালে এক জাঁকজমক কাউন্সিলের মাধ্যমে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাকে সভাপতি এবং মরহুম প্রফেসর মহিউদ্দিন আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট ঢাকা জেলা কমিটি ঘোষণা করেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এরপর ১৯৯৮ সালে ওই কমিটি ভেঙে দেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় কমিটি আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কার্যালয়ে বসে তাকে পুনরায় সভাপতি এবং পূর্বের কমিটির সদস্য আমান উল্লাহ আমানকে সাধারণ সম্পাদক করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করেন। এই কমিটিতে সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে আবদুল মান্নান, সহ-সভাপতি হিসেবে ব্যারিস্টার জিয়াউর রহমান খান ও ডা. দেওয়ান মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বাবুকে রাখা হয়। এর মধ্যে নাজমুল হুদাকে দল থেকে বহিস্কারের কারণে ২০১০ সালের ২২ নভেম্বর কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুল মান্নানকে সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়।

এই কমিটিতে সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে আবদুল মান্নান, সহ-সভাপতি হিসেবে ব্যারিস্টার জিয়াউর রহমান খান ও ডা. দেওয়ান মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বাবুকে রাখা হয়। কিন্তু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যকার দ্বন্দ্বের জের ধরে প্রতিটি উপজেলা ও পৌর কমিটিতে গ্রুপিং সৃষ্টি হয়।

জানা গেছে, এই সাংগঠনিক এলাকার অধীনে ১০টি ইউনিট থাকলেও এসব ইউনিট কমিটিও গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছেন নেতারা। মূলত ঢাকা জেলা বিএনপি কমিটি কেন্দ্র থেকে শুরু করে নেতাকর্মীদের কাছে অগোচরেই ছিলো এতদিন। এমনকি ঢাকা জেলা বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা এ কমিটি আছে কি নেই তাও সঠিক জানে না। নেতাকর্মীরা জানে না- কত সদস্য বিশিষ্ট এবং কোন কোন নেতা দায়িত্ত্বে রয়েছেন এ কমিটিতে। এমনকি ঢাকা জেলা বিএনপির কয়েকজন দায়িত্ত্বশীল নেতার সাথে আলাপকালেও তারা সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি। অর্থাৎ তারাও জানেন না এই কমিটিতে কয়জন নেতা কর্মী রয়েছেন।

এক নেতা জানান, ঢাকা জেলার জাতীয় নির্বাচনী এলাকা নিয়ে জটিলতা ও একই উপজেলা বিভিন্ন থানায় বিভক্ত থাকার কারণে উপজেলাভিত্তিক কমিটি গঠনে জটিলতা রয়েছে। তবে তিনি এও বলেন, উপজেলা বিএনপির কমিটি গঠনে এটা অজুহাত।

জানা গেছে, নাজমুল হুদা, আব্দুল মান্নান, আমান উল্লাহ আমান, ব্যারিস্টার জিয়াউর রহমান খান ও দেওয়ান মো. সালাউদ্দিন বাবু ঢাকা জেলার এই পাঁচ শীর্ষ নেতার মধ্যে নাজমুল হুদা বহিস্কৃত হলেও তার এলাকায় তার প্রভাব রয়েছে। তার অনুসারিরা কমিটি গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে নির্বাচন করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বও চন্দ্র রায়। গয়েশ্বর ও আমানের দ্বন্দ্ব খুব পুরনো। ফলে গয়েশ্বরের নির্বাচনী এলাকায় কমিটি গঠনে জটিলতা আরো বেশি।

তিনি আরো বলেন, ঢাকা জেলা কমিটির বর্তমান সভাপতি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করলেও জেলা কমিটি থেকে অব্যাহতি নেননি। এক নেতা একাধিক পদ আঁকড়ে থাকার কারণে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

নেতাকর্মীরা জানায়, মহানগীর বিএনপির ব্যর্থতার পাশাপাশি আশপাশের এলাকা; বিশেষ করে ঢাকা জেলা বিএনপির সীমাহীন ব্যর্থতা এবং সংশ্লিষ্ট নেতাদের রহস্যময় নীরবতা কর্মীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। আর এসকল নেতাদের ব্যর্থতার কারণেই সরকারবিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। তাদের মতে, ঢাকা জেলার মতো ঢাকা মহানগর বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অবস্থাও তথৈবচ।

কর্মীরা জানান, বয়সের ভারে অসুস্থ জেলা সভাপতি আবদুল মান্নান নির্বাচন বর্জনের কঠিন আন্দোলনে ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি। এছাড়া তার সাংগঠনিক দক্ষতাও এখন আর আগের মতো নেই। ফলে ঢাকা জেলায় কোনো সভা-সমাবেশের মতো কোন কর্মসূচি ছিলো না।

অপরদিকে ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ আমানের অবস্থাও প্রায় একই রকম। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দরাজ গলায় কড়া বক্তব্য দিলেও এখন তিনি চুপ। মিছিল-মিটিং-আন্দোলনে ডাকসুর সাবেক এই ভিপিকে আগের মতো দেখা যায় না।

এসব বিষয়ে ডা. দেওয়ান মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন জানান, বিভিন্ন কারণে বর্তমান দায়িত্বশীল নেতারা ঢাকা জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করতে পারেননি। এটা অবশ্যই আমাদের ব্যর্থতা। তবে দলের কেন্দ্র যেভাবে সারাদেশের জেলা কমিটিকে পুনর্গঠন করছে সেরকমভাবে এই জেলারও কমিটি পুনর্গঠন করা হলে সমস্যা থাকবে না।

ঢাকা জেলা বিএনপির ১০টি ইউনিট কমিটি প্রসঙ্গে বলেন, আমার এলাকায় আমি কমিটি গঠন করেছি। এ ক্ষেত্রে সাভার পৌর বিএনপির কমিটি আংশিক করা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক বছর হয়েছে। ঠিক কবে কমিটি গঠন করা হয়েছে তা মনে নেই।

কমিটি না হওয়ায় তৃণমূল নেতাকর্মীর হতাশ বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন কমিটি না হওয়ায় নেতাকর্মীরা কিছুটা হতাশ। আরো আগেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা উচিৎ ছিলো। তবে নেতাকর্মীরা আন্দোলনে মাঠে আছে।

তিনি বলেন, কমিটি অনুমোদন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। এতো বছরেও কেনো তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেননি এটা তারা ভালো বলতে পারবেন। উনারা হয়তো দায়িত্বপ্রাপ্তদেরই উপযুক্ত মনে করছেন।

তিনি বলেন, ঢাকা জেলার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি গঠন করা হয়েছে। কোনটা পূর্ণাঙ্গ কোনটা আহ্বায়ক কমিটি। তবে অনেক কমিটিতেই যোগ্যদের স্থান দেয়া হয়নি। অফিসে বসে কমিটি করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যাদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে তাদের অনেককেই আন্দোলনে মাঠে পাওয়া যায় না। আমাকে কোণঠাসা করতেই আমার এলাকায় আমার সাথে আলোচনা না করে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, জিয়া ভাই বিএনপি ছেড়ে এলডিপিতে যোগ দিয়েছিলেন। পরে আবার বিএনপিতে ফিরেছেন। এছাড়া তার বয়সও হয়েছে তাই হয়তো যতটা সক্রিয় হওয়া দরকার তা হতে পারেন না। জিয়া ভাইয়ের অবস্থানকে মন্দের ভালো বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ঢাকা জেলা বিএনপি ও এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কোনো অফিস না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অফিস কখনোই ছিলো না। এছাড়া ঢাকা জেলা বিএনপির সীমানা অফিস না থাকার অন্যতম কারণ। এজন্য সাধারণত ঢাকাতেই মান্নান ভাই বা আমান ভাইয়ের বাসায় আমরা সাংগঠনিক মিটিংগুলো করে থাকি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। যার নির্বাচনী এলাকা কেরানীগঞ্জ। ঢাকা জেলা বিএনপি সম্পর্কে জানতে চাইলে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ঢাকা জেলা বিএনপি নিয়ে আমার কোনো ইন্টারেস্টই নাই। তারা কি করে না করে এসব নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নাই। আমার নির্বাচনি এলাকায় আমার মতো চলি। সেখানে থানা ও ইউনিয়নগুলোতে আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকায় কোনো সমস্যা নাই। লোকজন মিটিং মিছিলে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু এখন রাস্তায় নামা কঠিন। ৫ জানুয়ারির পরে নির্বাচনী এলাকার নেতাকর্মীদের নামে প্রায় ৫০টি মামলা হয়েছে। এখন জামিন করানো যাচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে সভাপতি আব্দুল মান্নান ও সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ আমানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।



মন্তব্য চালু নেই