মিনায় পদদলিত হয়ে ৭৬৯ হাজির মৃত্যু

২৫ বছরে ভয়াবহ ঘটনা

সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা নগরীর অদূরে মিনায় পদপিষ্ট হয়ে ৭৬৯ জন হাজি নিহত ও আরও ৯৩৪ জন আহত হয়েছেন। হতাহত হাজিদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিক।

গত ২৫ বছরের মধ্যে সৌদি আরবে হাজিদের হতাহতের ঘটনার মধ্যে এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ। এর কয়েক দিন আগে ১১ সেপ্টেম্বর মক্কায় পবিত্র মসজিদুল হারামে নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বিশাল আকারের এক ক্রেন ভেঙে নিহত হন অন্তত ১১১ জন। হজের সময় সংঘটিত দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৯০ সালে মক্কার এক টানেলে। সে সময় পদদলিত হয়ে মারা গিয়েছিলেন ১ হাজার ৪২৬ জন হাজি।

এদিকে বিপুলসংখ্যক হাজির মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়েছে সৌদি আরব। এ ঘটনার জন্য দেশটির হজ ব্যবস্থাপনার তীব্র সমালোচনা করে জাতিসংঘের তদন্তের দাবি জানিয়েছে ইরান। তবে সৌদি আরব এসব সমালোচনা নাকচ করে দিয়েছে। খবর বিবিসি, এএফপি, রয়টার্স, আল-জাজিরা ও আল-আরাবিয়ার।

সৌদি সিভিল ডিফেন্সের পরিচালকের দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, হজের শেষ পর্যায়ের আনুষ্ঠানিকতা মিনার বড় জামারাকে (বড় শয়তানের প্রতীকী স্তম্ভ) লক্ষ্য করে কঙ্কর মারতে যাওয়ার পথে গত বৃহস্পতিবার সকালে পদদলিত হয়ে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে। হতাহতের উল্লিখিত সংখ্যা নিশ্চিত করেছেন দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী খালেদ আল-ফালিহ। দুর্ঘটনায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ।

মিনা থেকে আল-জাজিরার সংবাদদাতা বাসমা আতাসি জানান, মিনায় হাজিদের অবস্থানের জন্য নির্মিত তাঁবুগুলোর মাঝের একটি সড়কে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা ঘটে। সড়কটি ‘স্ট্রিট ২০৪’ নামে পরিচিত। শয়তানকে লক্ষ্য করে কঙ্কর নিক্ষেপের স্থানটিতে দুর্ঘটনা ঘটেনি।

আল-আরাবিয়ার খবরে বলা হয়, ওই সড়কের কাছে জামারাত ব্রিজের প্রবেশপথের কাছাকাছি স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিছু গণমাধ্যমে জামারাতের স্থানে (শয়তানের উদ্দেশ্যে পাথর নিক্ষেপের স্থান) পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে বলা হলেও সেটি সঠিক নয়।

মিনায় গত বৃহস্পতিবার পদদলিত হয়ে নিহত হাজিদের মরদেহ সরিয়ে নিচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা l ছবি: রয়টার্সঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিও দৃশ্যে ঘটনাস্থলে শত শত হাজির মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পাশাপাশি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল বেশ কিছু ভাঙা হুইলচেয়ার ও পানির বোতল। দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল থেকে হতাহত ব্যক্তিদের দ্রুত সরিয়ে নিতে কাজ শুরু করেন কমলা ও হলুদ রঙের পোশাক পরিহিত উদ্ধারকর্মীরা।

সৌদি সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র বলেন, হতাহত হাজিদের উদ্ধারকাজে অংশ নেন প্রায় ৪ হাজার কর্মী। আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য ঘটনাস্থলে ছুটে যায় দুই শতাধিক অ্যাম্বুলেন্স। হতাহত হাজিদের চারটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ঘটনাস্থল থেকে আল-জাজিরার আরেক সংবাদদাতা ওমর আল-সালেহ বলেন, ‘আমি এমন কিছু দৃশ্য দেখেছি, যা সত্যিই হৃদয়বিদারক। একজনের ওপর আরেকজন এভাবে স্তূপাকারে মৃতাবস্থায় পড়ে ছিলেন হাজিরা।’
আল দিয়ার নামে একটি আরব দৈনিকে বলা হয়, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আল-সউদ বৃহস্পতিবার মিনায় বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল-সউদের সঙ্গে বৈঠক করতে যান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ৩৫০ সদস্যের নিরাপত্তা বাহিনী। যুবরাজের নিরাপত্তার কারণে চলাচল একমুখী করা হয়েছিল এবং এত বড় ঘটনার জন্য এর দায় আছে। যদিও সৌদি আরব এ খবর ঠিক নয় বলে জানিয়েছে।

দুর্ঘটনার দিন সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মেজর জেনারেল মানসুর আল তুর্কি বলেছিলেন, যে সড়কটিতে ওই পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে, সেখানে আগে কখনো এত হাজির একত্রে সমাগম ঘটেনি। গত শনিবার সৌদি গেজেট-এর খবরে বলা হয়, অন্তত ৩০০ ইরানি হাজি নির্দেশনা ভাঙার কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

মিনায় হাজিদের অবস্থানের জায়গা সম্প্রসারণ কেন করা হচ্ছে না, এ প্রশ্নের জবাবে মানসুর বলেন, হজ পালন-সম্পর্কিত ইসলামি নীতিমালায় এ সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবছরই হাজিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাপক ও নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে সৌদি সরকার। কিন্তু তারপরও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেই চলেছে। এ অবস্থায় কর্তৃপক্ষের হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন ও অভিযোগ তুলেছে বিশেষত ইরানসহ কয়েকটি দেশ।

চাপের মুখে সৌদি আরব: মিনায় পদপিষ্ট হয়ে ৭৬৯ জন হাজির মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়েছে সৌদি আরব। ইরানসহ কয়েকটি দেশের অভিযোগ, সৌদি কর্তৃপক্ষ হাজিদের নিরাপত্তার বিষয়টি ঠিকভাবে দেখভাল করতে পারেনি। এই কাজে তাদের গাফিলতি ছিল। তবে এটি উড়িয়ে দিয়ে দুর্ঘটনার জন্য ইরানের হাজিরা দায়ী বলে মন্তব্য করেছে সৌদি আরব।

ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বিপুলসংখ্যক হাজির হতাহতের ঘটনার জন্য সৌদি আরবের প্রতি ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘দুঃখজনক এ ঘটনার দায়িত্ব সৌদি সরকারের নেওয়া উচিত। আমাদের উচিত হবে না যে অব্যবস্থাপনা ও ভুলের কারণে এ বিপর্যয়, সেটি এড়িয়ে যাওয়া।’

আয়াতুল্লাহ খামেনির এই বক্তব্যের আগে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি গত শনিবার জাতিসংঘে গুরুত্বপূর্ণ এক ভাষণে এ ঘটনার তদন্ত দাবি করেন। পদদলিত হয়ে এত হাজির হতাহত হওয়ার ঘটনাকে তিনি ‘হৃদয়বিদারক’ বলে বর্ণনা করেন। ভাষণে তিনি যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান তাতে এ ইঙ্গিত মেলে, ইরান তার আঞ্চলিক এ প্রতিদ্বন্দ্বীর সমালোচনায় এতটুকু ছাড় দিতে নারাজ।

আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেন, এ ইস্যু ভোলার মতো নয়। দুর্ঘটনার শিকার হাজিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এটি গুরুত্বের সঙ্গে নেবে। তিনি বলেন, এ ঘটনার জন্য একে-ওকে দায়ী না করে সৌদি আরবের উচিত, এর দায়দায়িত্ব গ্রহণ করা এবং মুসলিম সম্প্রদায় ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কাছে ক্ষমা চাওয়া।

খামেনি আরও বলেন, মুসলিম বিশ্বে অনেক প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। এক হাজারের বেশি (ইরানের দাবি অনুযায়ী) হাজির মৃত্যুর ঘটনা কোনো ছোটখাটো ইস্যু নয়।

ইরানের প্রসিকিউটর জেনারেল সৈয়দ ইব্রাহিম রাইসি শনিবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলেছেন, সৌদি রাজপরিবারের ‘অপরাধের’ জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিচার চাইবে ইরান।

এদিনই ইরান সে দেশে নিযুক্ত সৌদি চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে দুর্ঘটনার পর থেকে তৃতীয়বারের মতো তলব করে। এ সময় হতাহত ও নিখোঁজ হাজিদের উদ্ধার এবং তাঁদের পরিবারগুলোকে তথ্য দিতে আরও সহযোগিতা করতে সৌদি আরবকে চাপ দেওয়া হয়।

ঘটনার প্রতিবাদে ইরানের রাজধানী তেহরানে বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ মানুষ। তাঁরা সৌদি আরবের রাজপরিবারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন এবং তাঁদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। দুর্ঘটনায় নিহত ৭৬৯ জন হাজির মধ্যে ১৪০ জনের বেশি ইরানের নাগরিক।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো বলেছেন, হজ ব্যবস্থাপনার অবশ্যই উন্নতি হওয়া উচিত, যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। নাইজেরিয়ার হজ প্রতিনিধিদলের প্রধান বলেন, মিনার ঘটনার জন্য (আফ্রিকার) হাজিদের দায়ী করে সৌদি সরকার ভুল করেছে। তিনি বিবিসির রেডিও ফোরকে বলেন, সৌদি কর্তৃপক্ষের প্রতি আবেদন, (হাজিরা) নির্দেশ মানেননি, এই ভুল অভিযোগ যেন তারা না করে।

ইরানের প্রতি পাল্টা দোষারোপ: মিনা দুর্ঘটনার পর হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইরানের সমালোচনা নাকচ করে দিয়েছে সৌদি আরব। তা ছাড়া, ঘটনার জন্য ইরানি হাজিরাই দায়ী বলেও অভিযোগ করে দেশটি। ঘটনাটির তদন্ত ও এ ঘটনায় ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানানোর পর সৌদি আরব তার এ অবস্থানের কথা ব্যক্ত করল।
সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবায়ের দৃঢ়ভাবে সব অভিযোগ-সমালোচনা নাকচ করে বলেন, ইরান এ মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করছে। কিন্তু রাজনীতি করার মতো পরিস্থিতি এখন না। শনিবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সঙ্গে এক বৈঠকের আগে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ইরানি নেতারা আরও দায়িত্বশীল ও চিন্তাশীল হবেন।

ইরানি হাজিদের দেখভালে নিয়োজিত তাওয়াফা এস্টাবলিশমেন্টের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সৌদি গেজেট-এর খবরে বলা হয়েছে, প্রায় ৩০০ ইরানি হাজির ‘হজ নির্দেশনা’ ভাঙার কারণেই ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা ঘটে।

গত বৃহস্পতিবার সকালে এ দুর্ঘটনার পরপরই একজন সৌদি যুবরাজ এর জন্য আফ্রিকার হাজিদের দায়ী করে বিবৃতি দিয়েছিলেন বলেও গণমাধ্যমে খবর বের হয়। তবে এই বিবৃতির কথা অস্বীকার করেছে সৌদি আরব।

কোন দেশের কত: নিহত হাজিদের মধ্যে কতজন কোন দেশের নাগরিক, সে বিষয়ে সৌদি সরকার গতকাল রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো তথ্য সরবরাহ করতে না পারলেও বিভিন্ন দেশ তাদের নিহত হাজিদের সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সে অনুযায়ী এএফপি জানায়, পদদলিত হওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ইরানের অন্তত ১৪৪ জন (নিখোঁজ ৩২৩), মরক্কোর ৮৭ (স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর), মিসরের ৫৫, ভারতের ৩৫, নাইজারের ২২, ক্যামেরুনের অন্তত ২০, পাকিস্তানের ১৮, আইভরি কোস্টের ১৪ (নিখোঁজ ৭৭), চাদের ১১, সোমালিয়ার ৮, আলজেরিয়ার ৭, সেনেগালের ৫, তানজানিয়ার ৪, ইন্দোনেশিয়ার ৩, কেনিয়ার ৩, নাইজেরিয়ার ৩, বুরকিনা ফাসোর ১, বুরুন্ডির ১, নেদারল্যান্ডসের ১ ও তিউনিসিয়ার একজন হাজির মৃত্যু হয়েছে। নিহত হাজিদের মধ্যে রয়েছেন বেনিনের নাগরিকেরাও। তবে তাঁদের সংখ্যা জানানো হয়নি।

পবিত্র হজ শেষে দেশে ফিরছেন হাজিরা: হজের চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিকতা পালন শেষে গত শনিবার থেকে দেশে ফিরতে শুরু করেছেন হাজিরা। দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই দিন বিপুলসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করে সৌদি কর্তৃপক্ষ। সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, হাজিদের নির্বিঘ্নে দেশে ফেরাকে নিশ্চিত করতে ১ লাখ পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই