২০ বছরেও হিস্যা অনুযায়ী পদ্মায় পানি পায়নি বাংলাদেশ

মরণ ফাঁদ ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বাংলাদেশের প্রমত্তা পদ্মাসহ দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের নদ-নদীগুলো শুকিয়ে গেছে। যার ফলে এ অঞ্চলের চার কোটি মানুষের কৃষি জমিতে চাষাবাদ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

অথচ পানি সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য ১৯৯৬ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের গঙ্গা পানি চুক্তি হয়। কিন্তু এ চুক্তির ২০ বছরেও ন্যায্য হিস্যা অনুযায়ী কোনো বছরই পানি পায়নি বাংলাদেশ। চলতি বছরে বর্ষা মৌসুম প্রায় এসে গেছে। এখনও পানির অভাবে পদ্মায় জেগে উঠেছে ধূ ধূ বালুচর। এ বালুচরে হাল চাষ করছেন এখানকার কৃষিজীবী মানুষ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ৬ জুন বাংলাদেশ সফরে আসছেন। এ সফরের আলোচ্য সূচিতে নেই গঙ্গা পানি চুক্তির ন্যায্য হিস্যার বিষয়টি।

pic-3

পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকা পরিদর্শন করে ও ভুক্তভোগী মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৬১ সালের ৩০ জানুয়ারি ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে ভারত। ৭০-এ বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হয়। তখন পরীক্ষামূলকভাবে ভারত কিছু কিছু পানি ছাড়ে। আর ৭৫-এ আনুষ্ঠানিকভাবে ফারাক্কা বাঁধের সবকটি গেট খুলে দেওয়া হয়। ওইবারই মূলতঃ বাংলাদেশ চাহিদা অনুযায়ী পানি পেয়েছিল। ৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ চাহিদা অনুযায়ী পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। ফারাক্কা নির্মাণের আগে শুষ্ক মৌসুমেও পদ্মা নদীতে ৪০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত পানি পাওয়া গেছে। এদিকে, বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও যশোরের ১ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে আউশ-আমন ধান আবাদের লক্ষ নিয়ে ষাটের দশকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় নির্মাণ করা হয় জিকে সেচপাম্প। আর এ পাম্পটি সচল রাখার জন্যই প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় পদ্মা নদীর পানির। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবেই পানি সংকটে ১৯৯৩ সালে পাম্পটি বন্ধ হয়ে যায়। যা পুনঃচালুর লক্ষ্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ভারতের সাথে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা পানি চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত নায্য হিস্যা অনুযায়ী পানি পাওয়ার কথা থাকলেও ২০ বছরেও বাংলাদেশের ভাগ্যে তা মেলেনি। ভেড়ামারার পদ্মা তীরবর্তী কৃষক আলমগীর হোসেন আক্ষেপ করে জানান, ২০ বছর ধরে ভারতের সাথে পানি চুক্তির কথা শুনে আসলেও শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় চুক্তির কোনো পানি দেখা যায় না। বর্ষা মৌসুম ঘনিয়ে এলেও এখনো পদ্মায় জেগে উঠা চরেই কৃষি কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

কৃষক ছানোয়ার হোসেন প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী পানি পেলে পদ্মায় শুধুই বালু চর থাকবে কেন?’

পদ্মা নদীর জেলে জহুরুল ইসলাম জানান, নদীতে পানি না থাকার কারণে একমাত্র পেশা মাছ ধরা সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। যার ফলে কষ্টে দিন কাটছে জেলে পরিবারের।

গড়াই এরিয়া ওয়াটার পার্টনারশীপ চেয়ারম্যান ও নদী গবেষক নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপ-উপাচার্য ড. আনোয়ারুল করীম মুঠো ফোনে বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী যে পরিমাণ পানি পাওয়ার কথা ছিল তা দেয়নি ভারত। যার কারণে নদীগুলো শুকিয়ে গেছে। পদ্মায় পানি কম থাকায় এবং পানির গতি না থাকার কারণে গড়াই, মধুমতি, হিসনা, আড়িয়াল খাঁ, নবগঙ্গা, কপোতাক্ষ সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। এ কারণে নদীগুলোতে লবণের পরিমাণ বেশি হয়ে গেছে এবং আর্সিনেকের মাত্রাও বেড়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে নৌ-চলচল।’

তিনি বলেন, ‘কোনো বছরই পানি পায়নি। যার ফলে পদ্মা নদীতে ইলিশ মাছের অভাব দেখা দিয়েছে। আমরা ভারতের সাথে বন্ধুত্ব চাই, তাদের সাথে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। আমরা ভারতের সাথে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু আমাদের সে হাত তারা ফিরিয়ে দিয়েছে। যদি তিস্তা নদী চুক্তি বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে আমাদের পানিহীন অবস্থায় পড়তে হবে। আমাদের শস্য, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নৌ-চলাচল সবই ধংস হয়ে যাবে।’

pic-4

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাম্প স্টেশন ডিভিশন (সেচাগার বিভাগ) ভেড়ামারার নির্বাহী প্রকৌশলী আনিছুর রহমান জানান, ১ জনুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত চুক্তি অনুযায়ী ভারত থেকে পানি পাওয়া যায়। পানি পাওয়া গেলেও শুষ্ক মৌসুমে বালির স্তূপ উঁচু হয়ে যাওয়ার কারণে পদ্মার উৎস মুখের ইনটেক চ্যানেলে প্রতি বছর ড্রেজিংএর মাধ্যমে খনন করে ১ জানুয়ারি থেকে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ পাম্পের সাহায্যে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার ব্যাপক এলাকা সেচ কার্যত্রুম শুরু করা হয়।

অন্যদিকে কৃষকদের দাবি, চুক্তি অনুযায়ী ভারত থেকে পানি না পাওয়ায় প্রতি বছর ইনটেক চ্যানেলসহ পদ্মা-গড়াই নদীতে শতশত কোটি টাকা ব্যয়ে খনন কাজ পরিচালনা করা হয়। জিকে সেচ প্রকল্পের প্রধান খালে পানি স্থিতি রাখা হলেও এ প্রকল্পের আওতাধীন অধিকাংশ কৃষক সেচের পানি না পেয়ে ইঞ্জিন চালিত স্যালো মেশিনের মাধ্যমে জমিতে সেচ দিয়ে খরিপ-১ মৌসুমে ইরি বোরো ধান চাষ করে আসছেন।দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই