২০১৪’তেই নিষিদ্ধ পিস টিভির বক্তাসহ ৪ ইসলামি ব্যক্তিত্ব

দু’বছর আগেই ইসলামের নামে উগ্রবাদের প্রসার ঠেকাতে সতর্ক অবস্থান নিয়েছিল সরকার। ২০১৪ সালেই বিতর্কিত ইসলামি ব্যক্তিত্বদের দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে চার জনের ব্যাপারে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সতর্কতা জারি হয়েছিল। এছাড়া সেবছরই আরেকজনকে মালয়েশিয়া ফেরত পাঠানো হয়েছিল।

তবে এই কাগজ কলমের সতর্কতায় কাজ হয়নি। একের পর এক সিরিয়া, আফগানিস্তান ও তুরস্ক থেকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরেছে অনেকেই। কেউ কেউ ইমিগ্রেশনে আটকা পড়লেও পরে আইনের ফাঁক গলে জামিনে বেরিয়ে গেছে। এরপর তারা নির্বিঘ্নে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে বা যাচ্ছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিতর্কিত আন্তর্জাতিক ইসলামি ব্যক্তিত্বদের বাংলাদেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাটি জারি করা হয় ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর।

গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব হাবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত নির্দেশনাটিতে বলা হয়, বিতর্কিত কিছু আন্তর্জাতিক ইসলামি ব্যক্তিকে সংগঠন/সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা ক্লাবের পক্ষ থেকে ২০১৪-১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে আনা হতে পারে। এই ব্যক্তিত্বরা হলেন- জাকির নায়েক প্রতিষ্ঠিত পিস টিভির বক্তা যুক্তরাজ্যে বসবাসরত তানজানিয়ার নাগরিক আব্দুর রহিম গ্রিন, জেদ্দায় বসবাসরত সৌদি নাগরিক শেখ আসিম আল হাকিম, অস্ট্রেলিয়া বসবাসরত সৌদি নাগরিক ড. শেখ তৌফিক চৌধুরী এবং কানাডায় বসবাসরত সৌদি নাগরিক শেখ মুসলেহ খান। এরা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অপব্যাখ্যাসহ নিজস্ব যুক্তি ও আদর্শ বিভিন্ন দেশে প্রচারের কাজে নিয়োজিত।

এছাড়া ২০১৪ সালের ১৭ জুন পিস টিভির বক্তা কানাডীয় নাগরিক ড. আবু আমেনাহ বিলাল ব্র্যাডলি ফিলিপস জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত প্রতিষ্ঠান সিয়াম একাডেমির আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সরকারি অনুমতি না থাকায় ১৮ জুন তাকে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দেয়া হয়।

বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আগামী দিনগুলোতে এ জাতীয় বিতর্কিত আন্তর্জাতিক ইসলামি ব্যক্তিত্বকে বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন বলে ওই নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়।

এ ধরনের ব্যক্তিরা যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয় ইমিগ্রেশন পুলিশকেও।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয় থেকে জারি করা নির্দেশনাটি ইমিগ্রেশন মহা পরিচালকের পক্ষে নাদিয়া আক্তার স্বাক্ষর করে গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে এই নির্দেশনা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ওসি ইমিগ্রেশনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের একটি নির্দেশনা পেয়েছিলাম। তারপর থেকেই আমরা বিতর্কিত আন্তর্জতিক ইসলামি ব্যক্তিদের বাংলাদেশে প্রবেশের বিষয়ে সতর্ক হই।’

সতর্কতা সত্ত্বেও সিরিয়া, আফগানিস্তান ও তুরস্কের মতো দেশ থেকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে তরুণ যুবকরা বাংলাদেশের প্রবেশ করছে। এখানে কি ইমিগ্রেশনের কোনো দুর্বলতা আছে? এমন প্রশ্ন এড়িয়ে তিনি বলেন, ‘এটা আমি বলতে পারবো না। এ বিষয়ে জানতে আমাদের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের সাথে যোগযোগ করুন।’

এরপর ইমিগ্রেশনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এলিজা শারমীনের সাথে যোগযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘যদিও আমি এই নিদের্শনার পরে ইমিগ্রেশনে এসেছি। তারপরও আমরা নির্দেশনার বিষয়টি শতভাগ গুরুত্বের সাথে পালন করি।’

কিন্তু এর পরেও অনেকেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে প্রবেশ করছেন, সেক্ষেত্রে কি আপনাদের কোনো দুর্বলতা আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুর্বলতা ঠিক না। আমরাতো সন্দেহভাজনদের আদালতে সমর্পণ করি। পরে তারা আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে যায়। এখানে তো আমাদের কিছু করার নেই।’

গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে হামলায় অংশ নেয়া নিবরাস ইসলামসহ বাংলাদেশি সাত তরুণ চার মাস আগে তুরস্ক থেকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরেছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। বিমানবন্দরেই এদের তিনজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে পুলিশ। অন্য চারজন ফাক গলে বেরিয়ে যায়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই ওই তিন তরুণ আদালতে জামিন নিয়ে মুক্তি পায়। এই তরুণরা ভ্রমণ ভিসায় তুরস্ক গিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তুরস্ক দিয়ে সিরিয়ায় যাওয়া। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় তুরস্কেই একটি স্থানীয় জঙ্গি শিবিরে কিছু দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। তবে এই সাত তরুণের ক’জন গুলশানের হামলায় অংশ নিয়েছে সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। শুধু নিবরাসের পরিচয় নিশ্চিত করেছেন গোয়েন্দারা। গুলশানে নিহত রোহান ইবনে ইমতিয়াজও ওই গ্রুপে ছিল বলে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন।

গোয়েন্দা সূত্রে আরো জানা যায়, তুরস্ক ফেরত যুবকদের কয়েকজন এখনও পলাতক। এছাড়া মালয়েশিয়া থেকে কয়েকজন ছাত্র দেশে ফিরে এসেছে। তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের যোগাযোগ রয়েছে। এই পলাতক জঙ্গিদের খোঁজার চেষ্টা চলছে। আবার বিমানবন্দরে ধরা পড়ার পর কীভাবে জঙ্গিরা জামিনে ছাড়া পেল, আদালতে তাদের সেই নেটওয়ার্ক খুঁজছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

উল্লেখ্য, গত ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারি রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় জঙ্গিরা। জঙ্গি হামলার প্রাথমিক প্রতিরোধেই প্রাণ হারায় পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গি নিহত হলেও তারা আগেই ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে।

পরদিন শনিবার সকালে কমান্ডো অভিযান চালিয়ে জিম্মি সঙ্কটের অবসানের পর দুপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, সন্দেহভাজন পাঁচ হামলাকারী নিহত হয়েছে এবং একজন ধরা পড়েছে।

এই ঘটনায় জড়িতদের দু’জন পিস টিভির প্রতিষ্ঠাতা জনপ্রিয় ইসলামি বক্তা জাকির নায়েকের ভক্ত ছিলেন। অপরদিকে গুলশান ঘটনার সপ্তাহখানেক পর ভারতীয় পুলিশের গুলিতে নিহত কাশ্মীরে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী তরুণ বুরহান মুজাফ্ফরও জাকির নায়েকের ভক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। এর ভিত্তিতে জাকির নায়েককে উগ্রবাদের উসকানিদাতা চিহ্নিত করে ভারতে পিস টিভির সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভারতের পরপরই পিস টিভি নিষিদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশেও।-বাংলামেইল



মন্তব্য চালু নেই